মিথোলজিকে কতখানি সময়ে নিবিড়তায় উৎকীর্ণ করা যায়, বাংলা সাহিত্যে এ বিষয়ে কালকূটের 'শাম্ব' একটা মাইল ফলক। সেই কালজয়ীর সৃষ্টির অনুসন্ধান--
কৃষ্ণ এক ইতিহাস প্রসিদ্ধ মহামানব। তাঁকে নিয়ে যত ভাব ও ভক্তি, যদি ইতিহাস আর পুরাণ খুঁজেই দেখা হয়, এই বিশাল মহামানবের কাছে বিশ্ব সভ্যতা অনেকাংশেই ঋণী। “ কৃষ্ণ কেমন? যার মন যেমন !” এই মহা সংসারে সহজ কথায় কৃষ্ণকে বুঝে উঠবে কে? তাঁকে আপন করে , প্রিয় করে পাওয়ার আশায় যুগে যুগে কত মানুষের আকুলতা। মানব কখন দেবতা হয়ে ওঠেন?
“ 'দিবি আরোহণ' বলে একটা কথা আছে। এসব শুনলে, তোমার কুসংস্কার ঘুচবে, সত্যকে জানতে পারবে, পুরাণকে বিস্মিত শ্রদ্ধায় প্রণাম জানাতে শিখবে। এর নাম জ্ঞান। দিবি আরোহণ, মানুষেরই দেবত্ব- লাভের কথা। উত্তম মানুষ প্রতিলোম ক্রিয়ায় দেবতা হন। প্রতিলোম ক্রিয়ার আশ্চর্য সূত্র হলো, উত্তম মানুষ প্রথমে মানুষ রূপেই পূজিত হন, তারপরে তিনি দেবতা হন, তারপরে তাঁকে জ্যোতিষ্ক রূপে কল্পনা করা হয়।…”
শাম্ব আখ্যান শুরু থেকেই এমন পুরাণের ইতিবৃত্তের পথ খুঁজে চলা। কালকূট ছদ্মনামের জন্ম ১৯৫২ সালে। লেখকের আসল নাম নিষ্প্রয়োজন, শতবর্ষে তাঁর বহু কালজয়ী আখ্যান আসছে আবার চর্চায়। নেহাতই তাৎক্ষণিক একটি রাজনৈতিক রচনার প্রয়োজনে নেওয়া কালকূট নামটি বাংলা সাহিত্যে চিরস্থায়ী হয়ে গেল “অমৃতকুম্ভের সন্ধান” থেকে। শুধুই কী ভ্রমণ আখ্যান? পুরাণ আর ইতিহাসের স্মৃতি, মানুষ, তাদের ভাষা, পোশাক, খাদ্য আর ধর্মীয় আচরণ। হাজার বছর ধরে এই ক্রম বিবর্তনের যে গহন যাত্রা, কালকূটের লেখায় সেই মহা দর্শনের ছোঁয়া বিভিন্ন আখ্যানে।
শাম্ব আখ্যান এমনই এক কালের যাত্রা। এই আখ্যানকে পণ্ডিতরা কোন পর্যায়ে ফেলবেন? পুরাণ খোঁজা ইতিবৃত্ত না নিছক এক ভ্রমণ আখ্যান, উপন্যাস আশ্রিত দর্শন ? এইসব অ্যাকাডেমিক কূট কৌশল সাধারণ পাঠকের জন্য নয়। অস্বীকার করার বরং কোনও অবকাশ নেই, শাম্ব বহু পঠিত, বহু আলোচিত। সেটা কী শুধু একটি সাহিত্য অ্যাকাডেমি প্রাপ্তি, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমের প্রশ্ন উত্তরের বানানোর নিরস কারণে! মহাভারত এবং কৃষ্ণ জীবন আশ্রিত লেখা বাংলা সাহিত্যে বহু লেখা হয়েছে। বরং কৃষ্ণ পুত্রকে নিয়ে কালকূটের এই আখ্যানে পুরুষোত্তম পার্শ্ব চরিত্র। কৃষ্ণ আর জাম্ববতীর পুত্র শাম্ব অসামান্য রূপবান। অপরূপ দেহসৌষ্ঠব আর ব্যক্তিতের শাম্ব ছিলেন দ্বারকা নগরীর রমনীমোহন পুরুষ, তাঁর সেই রূপ যৌবন অস্তমিত হল পিতার অভিশাপে। কৃষ্ণ পুত্রের কুষ্ঠ ব্যাধি, আর নগর ত্যাগ ,শাপমুক্তির যাত্রা এক কঠিন কঠোর সংযম তপস্যার মত। এই আখ্যানে যে পরিমিতি বোধের সঙ্গে অতিকথনকে সযত্নে পরিহার করে শুধু শাম্বকে নিয়েই পথ চলেছে, পাঠককেও পুরাণ ইতিবৃত্ত ঘুরিয়ে এক চরম সত্যের সামনে দাঁড়িয়ে যাবেই। এই পথ অন্ধকার থেকে আলোর পথ। রোগ মুক্তি নাকি আত্মদর্শন!
আমাদের ইতিহাস প্রায় সবটাই পশ্চিমী আরকে ভেজানো। যেহেতু এক বিরাট জনজাতি বহুকাল শ্রুতি নির্ভর জীবনাচারন করেছে, ধর্ম, দর্শন, সমাজ মিলে মিশে গেছে পুরাণের অতিরঞ্জনের গোলক ধাঁধায়। এই উপমহাদেশে কৃষ্ণাব্দ নেই। আমরা খ্রিস্টাব্দ দিয়েই মেপে চলেছি সময়কাল। প্রায় সাড়ে তিনহাজার বছর আগের অনুমানিক কৃষ্ণ জন্মকাল নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। স্থান নিয়েও নেই তেমন কিছু ভৌগলিক সূক্ষ্ম হিসাব কিতাব। মথুরা থেকে দ্বারকা , এই দীর্ঘ পথ পারি দেওয়া পর্বত,নদ নদী, জঙ্গল, অশান্ত প্রকৃতি ডিঙিয়ে সম্ভব অসম্ভবের দোলায় দোলা তাই অপ্রয়োজনীয়। প্রাচীন বৃন্দাবন আর মথুরা, পশ্চিম সাগরের কোন গভীরে তলিয়ে আছে প্রাচীন দ্বারকা নগরী? প্রাচীন রৈবতক এখন কী কচ্ছের রানের সঙ্গে সিন্ধুপ্রদেশের প্রলয়ঙ্কর ভূমিকম্পের জন্য বিচ্ছিন্ন এক অংশ মাত্র! পশ্চিমের এই অংশের ভূমিকম্প প্রবণতা আধুনিক ভূতাত্ত্বিকদের কাছে তো প্রমাণিত সত্য। ঠিক যেমন নবীন হিমালয় আর তার হিমবাহ, গিরিখাত, নদী সবই অবিরাম পরিবর্তিত হচ্ছে। আমাদের সভ্যতার ইতিবৃত্তে কিছু ধ্বংসের গল্প থাকবে হয়তো, এই তো চিরকালীন।
শাম্ব আখ্যানে কালকূট এই সময়কাল নিয়েই লিখেছেন –
“সৃষ্টি, প্রলয়, বংশ, মন্বন্তর, বংশানুচরিত পুরাণের কাছে এই পাঁচ বিষয় ইতিহাসের মূল উপাদান। তার বিশ্বাস, যে দেশ প্রথম সৃষ্ট হলো, তখন থেকেই তার হিস্টরি (পুরাণ) বা ইতিবৃত্ত লেখা হওয়া উচিত। ইংল্যান্ডের ইতিবৃত্ত কেউ কেউ নিওলিথিক ও পোলিওলিথিক অধিবাসীদের দিয়ে শুরু করেছেন। তারও আদিমকালের অতীতে যেতে হলে, ভূতত্ত্বের কথা আসে। ওয়েলস, তাঁর ইতিবৃত্ত সেখান থেকেই শুরু করেছিলেন। অনেকটা পূরাণের মতোই। কিন্তু হিসাবের কালবিন্দু যীশু জন্মকাল। পুরাণের কি কোনো কালবিন্দু নেই? নেই। তার আদিবিন্দু আছে, তাকে বলা হয়েছে মানবকল্পের আদিবিন্দু। স্বয়ম্ভুর মনুকাল, পাঁচ হাজার নশো আটান্ন খ্রিস্ট পূর্বাব্দ। এই আদিবিন্দুর অতীতে আর কিছু নেই। থাকলেও তা ইতিবৃত্তে আসেনি।
মুশকিল! বলে তো যাচ্ছি ইতিবৃত্ত। বিষয়টা কী? পণ্ডিত বলছেন, ইতিবৃত্ত শব্দের অভিধা ইতিহাস শব্দের অনুরূপ হওয়ায়, তা হিস্টারি অর্থে অচল। হিস্টরির সংস্কৃত অর্থ ইতিবৃত্ত। ইতিহাস শব্দের অর্থ, সংস্কৃতে আর বাঙলায় ভিন্ন। পুরাণের বিচারে ভুলের সম্ভাবনায় ভরা। ইত অর্থে' যা গত হয়েছে, বৃত্ত অর্থে বর্ণনা। ইতবৃত্ত, এই পারিভাষিক প্রয়োগে ভুলের সম্ভাবনা নেই।….”
অনেকে বলতেই পারেন কাহিনীর আগে এত ব্যাখ্যা, একে কী করে বলি উপন্যাস? এ তো প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য! মুশকিল হল, সাহিত্যি আর শিল্পকে যখনই একটা বীজগাণিতিক ফর্মুলায় বাঁধার চেষ্টা হয়েছে, সাধারণ “অবুঝ” পাঠক সম্পূর্ণ অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়েছে। গল্প, উপন্যাস, কাহিনী- যে তকমার মধ্যেই গিয়ে আটকে যাকনা, পাঠকপ্রিয়তা উপেক্ষা করতে পারবে কেউ? ইতিহাস আশ্রিত সব আখ্যান পুনর্নির্মাণ। শাম্ব তথাকথিত ইতিহাসের না পুরাণের মিথ , এই তর্কের মধ্যে প্রবেশ করেননি কালকূট। শাম্বর পিতার অভিশাপে কুষ্ঠ রোগগ্রস্ত হওয়া, রোগ মুক্তির জন্য সৌর উপাসনা,যার মধ্যে তন্ত্র সাধনার তত্ত্ব এনেছেন অনেক তাত্ত্বিক। শাম্বর মুষল প্রসব এবং যদু বংশ ধ্বংসের যে সকল পৌরাণিক কাহিনী, সেই সব সযত্নে পরিহার করেছেন কালকূট। এই আখ্যান নিছক কুষ্ঠ নিরাময়ের কাহিনী তো নয়। কৃষ্ণর রূপ আর যৌবন পুত্রের কাছে ম্লান হয়ে যাওয়া, সংসারের অমোঘ সত্য, আর পুত্রের যৌবনদীপ্ত রূপে আকুল দ্বারকার রমনীকূল। পিতার ঈর্ষা, ক্রোধ, অভিশাপ, শাম্বর কুষ্ঠ রোগে শারীরিক বিকৃতি এই সব কিছু অতিক্রম করছে এই আখ্যান এক জীবন যাত্রায়। অন্তরের সমস্ত হলাহল, স্বল্পকালীন এই রূপ যৌবন যে মোহ মায়ায় আচ্ছন্ন করে মানুষ থেকে দেবতা সকলকেই, ত্যাগ আর বিশ্বাসের মিলিত শক্তি তাকে নিয়ে যেতে পারে অন্য উত্তরণের পথে।
রোগ মুক্তি মানব ইতিহাসে এখন আর নতুন কী? জীবন তো আসলে পদ্ম পাতায় জল! চিকিৎসা বিজ্ঞানের পথেও কিন্তু এই সাধনা আর গবেষণার দীর্ঘ পথ চলা। মহামারী, মারণ রোগ, জীবন যৌবনকে জীর্ণ দীর্ণ করে দিলেও, মানুষ পথ খুঁজে নিয়েছে, কেউ না কেউ পথ দেখিয়েছে। মৃত্যু থেকে জীবনের দিকে এই যাত্রায় শাম্ব কিন্তু একা নয়। ব্যক্তি নয়, বিশ্বের মুক্তি। এই কিছুদিন আগেই এক মহামারির কোপে আমরা যখন আগামীর কথা ভেবে এই অতি আধুনিক কালেও শিহরিত হচ্ছিলাম, বিস্ময় জাগে এক পৌরাণিক যুগপুরুষ পথ কিন্তু দেখিয়েছিলেন। পথটা বিশ্বাসের শুধু নয়, এক কঠিন সংযম যাত্রা, যার শেষেও আছে অমৃতের সন্ধান।