প্রতিদিনের মত সকাল সাতটায় হাওড়া স্টেশনের ঠিক পাঁচ নম্বর প্লাটফর্মের সামনে অপেক্ষায় বিকাশ দাস তাঁর সহযাত্রী কুন্তলের জন্য।দুজনেই একসঙ্গে সাতটা দশের হাওড়া বর্ধমান কর্ড লাইন লোকাল ধরেন। দুজনের গন্তব্যই বর্ধমান।দুজনেই সরকারি চাকুরে ,একজন রয়েছেন রাজ্যের এক সরকারি অফিসে ,আর একজন রেলে।
প্রতিদিন বর্ধমানে নেমে একটা চায়ের দোকানে চা খান তারা। বহুদিন ধরে সেই ছোট দোকানের মালিক বান্টি দেখে আসছে তাদের। তাই আসা মাত্রই দু কাপ স্পেশাল লাল চা নামিয়ে দেয় তাদের। চা খেয়ে তারা যে যার অফিসে চলে যায়। আজ কিছুটা বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল বিকাশ বাবুকে, এ নিয়ে কুন্তল ট্রেনে বার দুয়েক প্রশ্নও করেছিল,কিন্তু কোনও কারন বলেননি বিকাশবাবু।
দুপুর সাড়ে তিনটে নাগাদ একটা ফোন আসে কুন্তলের কাছে। ফোনে বিকাশবাবু বলেন, এখন কি একটু বেড়িয়ে আসতে পারবেন আধ ঘণ্টার জন্য? কুন্তল বেশ বিচলিত হয়, বলে কি ব্যাপার বলুন তো বিকাশদা?
বিকাশবাবু জানান, সাক্ষাতে বলব।
আসতে হবে কোথায়? প্রশ্ন করে কুন্তল।
বিকাশবাবু বলেন, তোমার অফিসের আশেপাশে কোথাও একটা জায়গায়।
অগত্যা রাজি হতে হয় কুন্তল কে। অফিসে ম্যানেজ করে বেড়িয়ে পরে কুন্তল। কথা মত তিনকোনিয়া বাস স্ট্যান্ডের সামনে অপেক্ষা করতে থাকে সে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই হাজির হন বিকাশবাবু।
কুন্তল কে দেখে ডেকে নেয় তাকে পাশের একটি খালি চায়ের দোকানে।
কুন্তল বলে, কি ব্যাপার বিকাশদা?
বিকাশ বাবু বলেন,দেখ কুনাল তুমি তো জান,আমি সাদা সিধে মানুষ আর আমার প্রয়োজন খুব সীমিত, তাই চাহিদাও কম। কিন্তু গত বছর মেয়ে বেঁকে বসে বিদেশে ম্যানেজমেন্ট পড়তে যাবে বলে। অনেক বোঝানোর পরেও গোঁ ধরে থাকায় শেষে বাধ্য হয়ে রাজি হই।
তখন একসঙ্গে প্রায় তের চোদ্দ লাখ পাবো কোথা থেকে? বিভিন্ন লোণ চলায় ব্যাঙ্ক লোণের আশাও প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলাম। এমন সময় একজনের একটা কেস আমার হাতে আসে,দলিল সংক্রান্ত নথিপত্রে কিছু চেঞ্জ করার অনৈতিক কাজের প্রলোভন। আমার টাকার প্রয়োজন জানা ছিল তাদের,তাই তারা বলে আপনার চাকরি তো আর মাত্র এক বছর, এটা একটু চেঞ্জ করে দিন, ব্যাস। আপনার টাকা আমরা জোগাড় করে দেব।
লোভ সামলাতে না পেরে জীবনে প্রথমবার এভাবে টাকা রোজগার করে বিদেশে পাঠাই মেয়েকে উচ্চ শিক্ষার জন্য। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে একটা মামলায় কোর্ট সম্প্রতি রায় দিয়েছে সেই সমস্থ নথিপত্র খুঁটিয়ে দেখতে। আমি এবার কি করব বলতো? আর মাত্র হাতে গোনা কয়েকমাস চাকরি আছে। ধরা পড়লে আমার সমস্ত টাকা পয়সা আটকে যাবে যে। তখন আমি কোথায় দাঁড়াব? কুন্তলকে কিছুটা চিন্তিত দেখাল। সে বলল, ঠাণ্ডা মাথায় একটু ভাবতে হবে। আমার এক উকিল বন্ধু আছে,রাতে তার সাথে একবার কথা বলে দেখি আগে।
হাওড়ার শালকিয়াতে একটা ছোট দোতলা বাড়ি বিকাশবাবুর। তার এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে জন্ম থেকেই পঙ্গু। তার পেছনে বিকাশবাবুর প্রচুর পয়সা খরচ হয়েছে,কিন্তু লাভ হয়নি কিছুই। দেশের বাড়িতে যা কিছু জমি জমা ছিল সেটাও বেচে দিতে বাধ্য হয়েছেন ছেলের চিকিৎসায়। এখন সম্বল বলতে এই বাড়ি আর চাকরিটুকু। সংসারে তার স্ত্রী যেন লক্ষ্মী। খুব কম পয়সায় সবাইকেই সন্তুষ্ট রাখতে চেষ্টা করেন তিনি। বেশিরভাগ দিনই হাওড়া স্টেশন থেকে হেঁটেই ফেরেন বিকাশবাবু,সবাইকে বলেন; হাঁটা তার নিজের ইচ্ছেতেই,কিন্তু উদ্দেশ্য দুটো পয়সা বাঁচানো,ভাবেন, যা অটো ভাড়া হয়েছে আজকাল।
সেদিন ঘরে ঢুকেই স্ত্রী মলিনাকে তিনি বললেন,মলিনা,আজ আর চা খাব না।তুমি এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল আনো। স্ত্রী জল নিয়ে এসে দেখলেন বিকাশবাবু ফোনে কাকে যেন কিসব বলে চলেছেন। জামাকাপড় না চেঞ্জ করে বিকাশ বাবুকে এভাবে ঘামতে দেখে মলিনা প্রশ্ন করে,অফিসে কিছু ঝামেলা হয়েছে নাকি? বিকাশ বাবু বলে, না না আর বল না। এবার সরকারি চাকরি আর বেসরকারি চাকরি এক জায়গাতেই এসে গেছে। বাড়িতে এসেও শান্তি নেই, বড়বাবুর ফোন, কাল ফিরতে দেরি হবে অফিস থেকে, অনেক কাজ বাকি আছে, শেষ করতে হবে কালকে।
রাত নটায় আবার ফোন বেজে উঠল তার।এবার অন্যপ্রান্তে কুন্তল।সে জানাল, উকিল বন্ধুর সাথে কথা হয়েছে, আপনার চিন্তার বিশেষ কিছু নেই, আপনি শুধু কেউ জানতে চাইলে বলে দেবেন, আপনি জানেন না কিছুই কে এসব করেছে। কারন, আপানার কথা মত আপনি ছাড়াও ওই কম্পুটারে অনেকে কাজ করেন। তাই বিষয়টি সামনে আসা সহজ হবে না।
কুন্তলের মুখে একথা শুনে কিছুটা শান্ত হলেন বিকাশ বাবু। রাতে শুয়ে ভাবতে লাগলেন, কাজটা ঠিক করেন নি তিনি। যাইহোক আর মাত্র তিনটে মাস চাকরি আছে, দেখতে দেখতে কেটে যাবে। ঘুম এলো না তার সারা রাত।মনে পড়তে লাগল,তার বাবা গ্রামের স্কুলের ইংরাজির মাস্টার মশাই বটুকেশ্বর বাবুর কথাগুলো, যিনি বলতেন; যত কষ্ট করতে হয় কর কিন্তু মিথ্যার আশ্রয় বা বাঁকা রাস্তায় পা দেবে না কখন। বিকাশবাবু নিজের মনকে শান্ত করার চেষ্টা করে চললেন এই বলে যে একটা ভুল হয়ত মাপ করে দিতেন বাবা থাকলেও।
দেখতে দেখতে তিন মাস কেটে গেল।এসে গেল সেই অবসরের দিন। অফিসের সবাই মিলে অনেক বক্তৃতা দিয়ে ফুল মালা সহ বিদায় করল তাকে। বাড়ি ফিরে এলেন তিনি। সারা রাত ভাবতে লাগলেন কাল থেকে আবার বেকার তিনি। যথা সামান্য সঞ্চিত টাকা আর পেনশনেই কাটাতে হবে বাকি জীবন।ছোট বেলায় ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন তিনি,কিন্তু পরবর্তীকালে সে বাম আন্দোলনের অনেকেরই আজ জীবন যাত্রায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু আন্দোলন ছেড়ে দেবার পরেও একই রয়ে গিয়েছেন তিনি। ঘরের দেওয়ালে ঝুলতে থাকা আবছা হয়ে আসা কার্ল মার্ক্স বা লেলিনের ছবিটা আজও তাকে মনে করায় জীবন পাল্টে দেওয়ার আন্দোলনের সেই দিনগুলোকে। ভাবতে থাকেন,সত্যি কি সম্ভব এ জীবনের পরিবর্তন? মনে পরে যায় তার স্বাধীনতা সংগ্রামী দাদুর কথা, যিনি বলতেন, সত্যের জয় হবেই। তাহলে কি সবটাই মিথ্যা? প্রশ্ন জাগে তার মনে।
বেশ কিছুদিন পরে একদিন সকালে খবরের কাগজের একটা পাতায় একটা খবর ভীষণ ভাবে বিচলিত করল তাকে। কাগজে লেখা ঘুস নেওয়ার অপরাধে তারই এক জুনিয়ার অফিসারকে বরখাস্ত করা হয়েছে কদিন আগে। চঞ্চল হয়ে উঠলেন তিনি, তৎক্ষণাৎ ফোন করলেন তারই এক অফিসের কলিগ সুমনকে। সুমন জানাল যে কোর্টের নির্দেশে যে তদন্ত তার থাকাকালিন শুরু হয়েছিল সে বিষয়েই তার নাম সামনে আসে। ব্যাস তারপরই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঊর্ধ্বতন পক্ষ। সুমন এও বলে, চিন্তার কিছু নেই ও তো সক্রিয়ভাবে রাজনীতিটা চুটিয়ে করে,তাই কিছু একটা ব্যবস্থা হবে অন্যত্র।
বিকাশবাবু বলে রাজনীতি করলে কী হবে? ওর সংসার চলবে কি করে? সুমন বলে, বিকাশদা আপনাদের সময়কার রাজনীতি এখন কেউ করে না। আর এখনকার রাজনীতির মানুষরা এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। এগুলো তো হতেই থাকে তাদের জীবনে। রাতে শুয়ে বিকাশ বাবু ভাবতে থাকেন তার জন্যই হয়তো তার এই জুনিয়র বরখাস্ত হয়েছে। নিজেকে কী ভাবে ক্ষমা করবেন বুঝে উঠতে পারলেন না তিনি। সারা রাত বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে লাগলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত এত বড় অন্যায় করলেন তিনি। মনে মনে ঠিক করলেন না কালকেই কোর্টে গিয়ে সবটা জানিয়ে আসবেন তিনি। প্রয়োজন হলে বাড়িটা বিক্রি করেও দায়মুক্ত হবেন নিজের বিবেকের কাছে। সকালে উঠেই ফোন করলেন কুন্তলকে,জানালেন সবটা। সব শুনে কুন্তল বলল, বিকাশদা আপনি কি পাগল হয়েছেন ?আপানার পরিবারকে কে দেখবে ?কে দায়িত্ব নেবে আপানর পঙ্গু ছেলের? আপনার স্ত্রীর ওপর কি আঘাত আসবে ভেবে দেখেছেন একবার?
কুন্তল এবার বেশ গম্ভীর ভাবেই বলল, দেখুন আপনাকে আমি দাদার মত দেখি,আপনি পরিবারের জন্য এই সর্বনাশ ডেকে আনবেন না প্লিজ। বিকাশবাবু, সব শুনলেন,বললেন, আমি কী ভাবে নিজেকে সান্ত্বনা দেবো বলতে পারো কুন্তল? কুন্তল জানাল, সে কাল আসবে তার সাথে দেখা করার জন্য।
পরেরদিন কাজ থাকায় আসতে পারল না কুন্তল। তার পরিবর্তে একটা রবিবার না বলেই বিকাশবাবুর বাড়িতে চলে আসে সে। বাড়ির বাইরে মানুষ জনের ভিড় বিচলিত করে তাকে। ভিড় ঠেলে এগিয়ে যায় সে। পাড়ার স্থানীয় কিছু লোকজন বেড় হচ্ছে তাদের বাড়ি থেকে। জানতে চাইলে,তারা জানায়, গতকাল রাতে ঘুমের মধ্যে হার্টএট্যাক এ মারা গেছেন বিকাশবাবু। ঘরে প্রবেশ করে কুন্তল,তার স্ত্রী তাকে দেখে কেঁদে ওঠেন আরও একবার। শুধু বলেন, কাল রাতে হঠাৎ শরীর খারপ করছিল বিকাশবাবুর,কিন্তু ডাক্তার ডাকতে বললে বাঁধা দেন তিনি। শুধু একটা কথাই বলছিলেন পাগলের মত বার বার, “বাবা আমাকে ক্ষমা করে দিও”।