একফালি বসবার ঘরটাতে যখন ঢুকছি, দেখি, বেশ লম্বা, স্বাস্থ্যবান একজন মানুষ বেরিয়ে গেলেন। ঘরে ঢুকতেই তিনি বললেন; চিনিস? না বলাতেই উত্তর দিলেন; মিহির সেন। আর কোনও কথা না বলেই ছুটলাম সিঁড়ির দিকে। উদ্দেশ্য অটোগ্রাফ শিকার। মিহির সেন ততক্ষণে সিঁড়ি বেয়ে একতলায় অটোগ্রাফ দিলেন।
আবার উঠে আসবার পরে বললেন, দেখা হল? ক্ষমতার বৃত্তের বাইরের মানুষ তখন তিনি। জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে জয়প্রকাশ নারায়ণের আর এস এসিয় বৃত্তের বাইরে এই রাজ্যে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সমস্ত অকংগ্রেসি, ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে পথে নামানোর ক্ষেত্রে সবথেকে কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছেন। নীতিগত প্রশ্নে যে বামেদের সঙ্গে তাঁর আসমান-জমিন ফারাক ছিল, সেই বামেদেরকেও বন্ধুত্বের ডোরে বেঁধেছেন ইন্দিরার তানাশাহীর অবসানের লক্ষ্যে। কিন্তু না, নিজের জেদ ছাড়েননি। কারণ, ক্ষমতার লোভ তাঁকে কখনও স্পর্শ করতে পারেনি। '৭৭ এর বিধানসভা ভোটে কিছু বাড়তি আসনের জন্যে একদম জেদ ধরে যদি না শেষ পর্যন্ত তিনি অনড় হয়ে থাকতেন, তবে বাম-জনতা জোটের পক্ষ থেকে সেদিন তিনিই আবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হতেন।
প্রফুল্লচন্দ্র সেন। ঘরে বাইরে যাঁর কেবল আক্রমণই সহ্য করতে হয়েছিল। বিদূষণকে গলায় ধারণ করে নীলকন্ঠ হয়ে যাওয়া মানুষটি যখন কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে জীবনের অন্তিমপর্বে চিকিৎসাধীন, তাঁর অতি আপনজন ছানাবাবু, পোষাকী নাম, অখিলেশ ভট্টাচার্য, প্রফুল্লদা ছাড়া তাঁর জীবনে আর দ্বিতীয় কিছু ছিল না, সেই ছানাবাবু (তিনি তখন বৃদ্ধ) সারারাত হাসপাতালে থেকে বাড়ি গিয়েছেন নিউ আলিপুরে। এমন সময়েই প্রফুল্লচন্দ্রের শারীরিক অবস্থা অতি সঙ্কটময় হয়ে পড়ল। তখনই দরকার টেম্পোরারি পেসমেকার বসানোর। কেউই নেই অনুমতি পত্রে সই করবার। ছানাবাবু এসে সই করা পর্যন্ত সময় হয়তো রোগী দেবেন না। ফোনেই ছানাবাবু বললেন; তুই সই করে দে।
কেবল ভাবছিলাম তখন, রাজনৈতিক ভাবনাতে একেবারে বিপরীত অবস্থানে থেকেও যে স্নেহ পেয়েছি, একটা সইতে তো তার প্রতিদান হয় না। হবেও না কোনওদিন। চলে যাওয়ার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওঁর চিকিৎসার টাকা নিতে চায়নি। ছানাবাবুর চেষ্টায় প্রায় ভিক্ষা করে আমরা সবাই সেই টাকা মিটিয়েছিলাম। জানতাম, ওই হাসপাতালের মালিক তখন যাঁরা, তাঁরাই ওঁকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দিতে সবথেকে বড়ো ভূমিকা নিয়েছিল। কেন নিয়েছিল? ওঁর মুখ্যমন্ত্রীত্ব কালে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গুলজারিলাল নন্দা কলকাতায় এলেন। প্রটোকল অনুযায়ী তাঁকে স্বাগত জানাতে মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র পাঠালেন তাঁর মন্ত্রী বিজয় সিং নাহারকে। নন্দা সৌজন্য বিনিময় করলেন বিজয়বাবুর সঙ্গে। কিন্তু প্রটোকল ভেঙে রাজ্য সরকারের গাড়িতে উঠলেন না। উঠলেন এক শিল্পপতির গাড়িতে। যে শিল্পপতিই পরবর্তীকালে ওই হাসপাতালটির মালিক হয়েছিলেন।
বিজয় সিং নাহার মহাকরণে ফিরে সবটা জানালেন মুখ্যমন্ত্রীকে। মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দিলেন, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কলকাতায় থাকাকালীন রাজ্যের একজনও মন্ত্রী তাঁর অনুষ্ঠানে যাবেন না। নন্দাকে এই কাজের জন্যে দিল্লি ফিরে গিয়ে শ্রীমতী গান্ধীর চাপের মুখে পড়তে হয়েছিল, যে চাপের পাল্টা চাপ পড়েছিল সেই শিল্পপতির উপর। ফলে প্রফুল্লচন্দ্রকে ক্ষমতাচ্যুত করতে তাঁর দলের ভিতরে এবং দলের বাইরে সবথেকে সক্রিয় ছিলেন সেই শিল্পপতি। তারই মস্তিষ্কপ্রসূত ছিল প্রফুল্লচন্দ্রের স্টেফেন হাউস কেনা, সুইস ব্যাঙ্কে লক্ষ লক্ষ (তখন 'কোটি' বিষয় আজকের মত আসেনি) টাকা জমানোর গল্প, যা লুফে নিয়েছিল সেই সময়ের বিরোধীরা।
জন্মদিন কেটে যাওয়ার কয়েকদিন পর, বৈশাখ মাস হবে, ঘরে এসি নেই। লোডশেডিংয়ে ফ্যান বন্ধ। খাটের উপরে টেলিফোন সেটটা নামিয়ে দিয়েছে সেবক বিশু। নিজেই ডায়াল ঘুরিয়ে বললেন; বিনয়? কজনকে পাঠালাম তোমার কাছে। একটু সেন্ট্রাল গেটে বলে দাও।
জানতে চাইলাম; বিনয় চৌধুরী?
মাথা নাড়লেন।
বললাম, ওঁর দল আজও তোমাকে এত উপহাস করে, তবু ওঁদের লোকেদের কাছেই সবাই কে তুমি পাঠাও?
হাসলেন। আমার জীবনে দেখা সেরা হাসি। যে হাসিকে স্বর্গীয় হাসি বললে সত্যের অপলাপ হবে না। নব্বই উত্তীর্ণ এক বৃদ্ধের তোবড়ানো গালের হাসি যে এত নিষ্পাপ হতে পারে, এত পবিত্র হতে পারে -তাঁর সেই হাসি না দেখলে কখনো বিশ্বাস করতে পারতাম না।
রাজনীতি যাই হোক, মানুষের দরকারটাই তো আসল রে। আমার কথা এখন আর সরোজ (মুখোপাধ্যায়), বিনয় ছাড়া কে শুনবে? তাঁর সেই কথারই মূর্তরূপ দেখেছিলাম তাঁর চলে যাওয়ার পরে, চৌরঙ্গীর এক্সসাইডের মোড়ে পাশে কংগ্রেস ভবন। নিথর দেহে তিনি শুয়ে আছেন।একদম শিশুর মত কাঁদতে কাঁদতে সিঁড়ি দিয়ে উঠছেন বিজয়কৃষ্ণ মোদক। প্রফুল্লদা ছিলেন যাঁর অন্যতম রাজনৈতিক গুরু। সেই প্রফুল্লদাকেই যিনি '৮০ র লোকসভা ভোটে হারিয়েছিলেন আরামবাগ থেকে। সেদিন আর দেখেছিলাম একজনকে। যাঁকে নিয়ে অন্দরে বাইরের প্রচারে কম হেনস্তা হতে হয়নি প্রফুল্লচন্দ্রকে। দেখলাম, একতলায় ছানাবাবুর সঙ্গে কথা বলছেন। সেই মহিলার সাজ দেখে মনে হচ্ছিল না তিনি কোনও শোক জানাতে এসেছেন। মনে হচ্ছিল, বিয়ে বাড়িতে এসেছেন। 'মুক্তি' ফিল্মে কানন দেবীর স্টাইলে বেড়া বিনুনি বেঁধে খোঁপা করেছেন।
ছানাবাবুকে জিজ্ঞাসা করলাম, কে?
ছানাবাবুর সংক্ষিপ্ত উত্তর; মায়া ব্যানার্জী।
প্রফুল্লচন্দ্র গান্ধীবাদী। কিন্তু মৌলবাদী গান্ধীবাদী নন। তাই স্বাধীনতার পরে জেসপের ব্ল্যাস ফার্নেসে সাহেব ফেলে যিনি বিপ্লব করেছিলেন, সেই পান্নালাল দাশগুপ্তের কারাবাস থেকে মুক্তি সম্ভব হতো না মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র উদ্যোগ না নিলে। আর সেই পান্নাবাবুই পরে অতি গান্ধীভক্ত হয়ে বাঁশের চরকা ঘিরে অতিগান্বীবাদী হয়ে যখন পত্রযুদ্ধে নেমেছিলেন প্রফুল্লচন্দ্রের সঙ্গে, তখন আমার কেবল দাদাঠাকুর ফিল্মে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া,' কন্ঠে আমার কাঁটার মালা, ফুলের মালা নয়। দুঃখ যাদের মাথার মুকুট ঝড় কে কি বা ভয়' গানটার কথাই মনে পড়ছিল। '৮০ সালে শ্রীমতী গান্ধী আবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রফুল্লচন্দ্রকে বলেছিলেন; আপনি বাবার সময়ের মানুষ। ভালো কোনও রাজ্যে রাজ্যপাল হোন। একটু আরামে থাকুন।
শ্রীমতী গান্ধীর মুখের উপরে প্রফুল্লচন্দ্রে একটু নাসিক্যবর্ণের সেই দীপ্ত উচ্চারণ; আরাম হারাম হ্যায়, এখনও কানে বাজে। শ্রীমতী গান্ধী এই কথা শুনেই উঠে গেলেন। ফিরে এলেন, নিজের হাতে করে একগ্লাস ঠান্ডা দুধ নিয়ে। বললেন; জানি আপনার পেপটিক আলসার আছে। দুধ টা খেয়ে নিন। আজ যখন রাজ্যের মহিলা মুখ্যমন্ত্রীকে কুৎসিত গলার আওয়াজে অরাজনৈতিক আক্রমণ করেন প্রধানমন্ত্রী মোদি,থেকে গৃহমন্ত্রী শাহ, তখন শাহ আবদুল করিমের সুরেই বলতে হয়; আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।