বরফের ঘর


টাকাটার গায়ে কেমন যেন শ্যাওলা-শ্যাওলা গন্ধ। অনেকদিন ধরে জমলে যেমন হয়। স্মৃতির মত। সবুজ রঙের। মিতা কৌতূহলী চোখে তাকায়। অনেকগুলো পাঁচশ টাকার নোট। শিউলি গুনছে। পার্লারের পেছনদিকে একফালি সরু জায়গা। দেওয়াল জুড়ে ছোট-ছোট খোপ। ওদের লকার। সারাদিন দশ বাই বারো ফুটের ঘরটায় সাবান, শ্যাম্পুর গন্ধের পাশাপাশি আরেকটা গন্ধ মাখে শিউলি। সবুজ নোটগুলোর গন্ধ। টাকাগুলো জমিয়ে লকারে রাখে। মিতু অনেকবার ব্যাংকে রাখার কথা বলেছে। শিউলির ইচ্ছে করে না। ব্যাংকে রাখতে গেলেই বাড়ির লোক জানবে। রোজ এভাবে ছুঁয়ে দেখা যাবে না। ওদের গায়ে একবার হাত না দিলে শিউলি রোদ দেখতে পায় না। 

পার্লারের সামনের দিকে যেখানে কাস্টমাররা বসে তাদের চামড়া, চুল, শরীর গন্ধে মাখামাখি করে নেয় তার পেছনদিকেই ছোট্ট, সরু এক ফালি জায়গাটা। পার্লারের নির্ধারিত পোশাক পরেই ওদের কাজ করতে হয়। মূলত ছেড়ে রাখা পোশাক এবং খাবার-দাবার রাখার জন্য লকারগুলো বরাদ্দ। মাস-মাইনে থেকে টাকা জমিয়ে এখানেই রাখে শিউলি। কাজের ফাঁকে এসে গন্ধ শোকে। মিতালী আর শিউলির সাধারণত একই শিফট থাকে। শিউলির ঘনঘন লকার খোলা দেখে ও মুখ টিপে হাসে। শিউলি চোখ নামিয়ে নেয়। 

-"বরফ! বুঝলি তো! সাদা বরফের উপর দিয়ে স্বপ্নচারিণীর মত হেঁটে যাব। একেবারে সিনেমার মতো! বুঝলি মিতু!"

-"ধুর অত সিনেমার কথা মনে রেখে কি করব বল তো। আগে তো যাওয়াটা হোক। কাশ্মীরে টিউলিপ ফুলের বাগানটা নাকি দারুন সুন্দর! ওটা দেখব। তুই ট্রাভেল এজেন্টের থেকে সব জেনে রাখবি।"
 ঘরটায় বরফের গন্ধ লেগে। ফ্রিজের ভেতর থেকে হেয়ার জেলটা বের করে মিতু শিউলির হাতে দেয়। কতগুলো বরফের টুকরো মেঝেতে এসে পড়ে। শিউলি হাতে তুলে নেয়। সবুজ রঙের স্বপ্ন কাগজগুলোর কথা মনে পড়ে। বরফ গলে ওর হাত বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। 

-"এই তোরা দুজন আবার কাশ্মীরের গল্প জুড়েছিস? শিউলি তোর কাস্টমার এসেছে। ভুরু করাবে। চুলের স্পাও করাবে। তাড়াতাড়ি যা।  দুজনে সারাদিন কাজ ছেড়ে কাশ্মীর যাওয়ার গল্প করছিস কেউ যদি জানতে পারে না! এমন করলে পুজোর বোনাস আর পাবি না।"
স্বপ্নাদি গজগজ করে। রাস্তার ওপরেই এই বিউটি পার্লারটা। স্বপ্নাদি ম্যানেজার। মালকিনের সবচেয়ে পছন্দের। অদৃশ্য লাঠির মত সব মেয়েদের চোখে চোখে রাখে। শিউলি একটু বেশি কাজ করার চেষ্টা করছে। এখনো প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার টাকা কম। মাইনের টাকায় সংসার, বাবার অসুখ সামলে কণাটুকুই পড়ে থাকে। সেগুলোই ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে শিউলি। স্বপ্নাদির বকুনিতে চোখে জল আসে। ওয়াক্স গরম করতে বসিয়ে চুলের ক্রিম রেডি করে ঝটপট। বাড়ি যাওয়ার আগে লকারে আরেকবার টাকাগুলো গুনে নিতে হবে। সকলের অলক্ষে। কাজের ফাঁকে টুং করে মেসেজ আসে। ট্রাভেল কোম্পানির ছেলেটা কয়েকটা ছবি পাঠিয়েছে। সঙ্গে কাশ্মীর বেড়াতে যাওয়ার দিনলিপি। সারি সারি তারিখের পাশে এক একটা জায়গার নাম। টিউলিপ গার্ডেন, জম্মু, শিকারায় নাইট স্টে, বৈষ্ণো দেবীর মন্দির দেখা আর সবশেষে বরফে মাখামাখি করা রাস্তায় পিছলে যাওয়া। বছরে দুবার কাশ্মীর নিয়ে যায়। তিন মাস আগের ট্যুরটার ছবিগুলো পাঠিয়েছে। শিউলির চোখে জল আসে। "তুই কাশ্মীর নিয়ে এমন আদিখ্যেতা করিস আমার খুব হাসি পায় কিন্তু।" মিতু চিমটি কাটে। শিউলি ওর কাঁধে হাত রাখে "তুই যাবি তো? বাড়িতে কিছুতেই একা যেতে দেবে না আর তুই গেলে ঘরটাও শেয়ার করতে পারব। এই দেখ ট্রাভেল এজেন্ট ছবি পাঠিয়েছে।" মিতু কিছু না দেখেই শিউলির থুতনিটা নাড়িয়ে দেয়। 


-''বাবার পায়ের জন্য ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। নতুন ওষুধটাও লাগবে। এই মাসে এনে দিতে পারবি তো? তুই মাইনে পেয়েছিস তো।" 

বঁটিতে সবজি কাটছিল শিউলি। ‌ কালো রঙের মেঝে তাই আঠা পড়েছে। ঢ্যাঁড়শটা বড্ড হড়হড়ে। মেঝেতে আঠা লাগলে যেতে চায় না। শিউলিদের অবস্থার মত। কালো রঙের মেঝেটা থেকে শিউলি আঠা তোলার চেষ্টা করে। শেষ বেলার বাজারে সস্তায় পাওয়া সবজিগুলো বাড়ি ফিরে নিজেই কাটতে বসেছে। মা যদিও রাতের রান্না এগিয়ে রেখেছে। মা নকথাগুলো বলে শিউলির উত্তরের অপেক্ষায় রয়েছে। মায়ের দিকে তাকাচ্ছে না ও। প্রায় প্রতিদিনই মা এরকম কিছু উত্তরের অপেক্ষা করে শিউলির থেকে। এই বাড়িটার একমাত্র উত্তর। মা উত্তর না পেয়ে অধৈর্য হয়। 
-"কিরে, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবি তো? বাবার কিন্তু ডায়াবেটিক ফুট। ফেলে রাখলে হবে না।"
ঢ্যাঁড়সটা আরো পিচ্ছিল লাগে শিউলির। 

শিউলিরা দুই বোন। শিউলি আর মেহুলি। বোন এই সময়টা রিলের ঝিলিমিলি দেওয়া দুনিয়ায় মশগুল ছিল।

-''দিদি কী করে সবজি কাটছিস! হাত কেটে যাবে তো? আমি কেটে দেবো?"

মোবাইলটা পাশে রেখে মেহুলি এগিয়ে আসে। শিউলি বঁটিটা ওর দিকে এগিয়ে দেয়। মেহুলির ফোনে টুকটাক মেসেজ আসে। পাকা টমেটোর মত গালের রং হয়। ফর্সা গালে গুপ্ত হাসি, আরো নিটোল মনে হয়। নিপুণ তো বটেই। ভগবান মেহুলিকে এমনভাবেই তৈরি করেছে। শিউলি তাকিয়ে থাকে।  এমন সুন্দরী, ঝিলিক দেওয়া হাসি। ছোট থেকেই মেহুলি মোহময়ী। ছেলে পেতে অসুবিধা হয়নি। নিজেই পছন্দ করেছে। ভালো চাকরি করে। অবস্থাপন্ন পরিবার। মেহুলির দিকে তাকালেই নিশ্চিন্ত, শান্ত হাসি দেখতে পায় মার মুখে। "বড় মেয়ের বিয়ে হয়নি, এখনই কেন ছোট মেয়ের বিয়ের কথা ভাবা হবে?" এই প্রথাগত ভাবনাকে কেউ প্রশ্রয় দেয়নি। শিউলিও না। বাবা মাও না। পরের বছর ওদের বিয়ে। সবজি কাটতে কাটতে মেহুলি বারবার ফোনে চোখ বুলোয়। মাঝে মাঝে  হাসির ঝিলিক। লজ্জা-মাখা মুখ। 

-"এখন থেকেই হানিমুনের কথা বলছিস নাকি?"
মা একটু দূরে উঠে যেতেই শিউলি মেহুলিকে জিজ্ঞেস করে। শিউলির গলায় থাকা শ্লেষ ধরতে না পেরে মেহুলি আরো লজ্জা পায় ।

-"তুই কী করে বুঝলি দিদি? মাঝে মাঝে ও এত তাড়া দেয় না, যেন পারলে কালই বিয়ে করে! এখন থেকে জায়গাও ঠিক করে রাখতে চাইছে। ওর পাহাড় খুব পছন্দ।"

ফ্রিজ থেকে উচ্ছে বের করে শিউলি মেহুলির কাছে দেয়। 

-"কোথায় যাবি?"

-"এখনো কিছু ফাইনাল হয়নি। তবে দার্জিলিং, হিমাচল নইলে কাশ্মীর। কিন্তু কাশ্মীরে এত খরচ! ও বলছে এখন থেকে টাকা জমাচ্ছে। খরচ নিয়ে নাকি ভাবতে হবে না।"

-কি রে দিদি, তুই চলে যাচ্ছিস কেন! আমার এই হঠাৎ করে বিয়ে ঠিক হওয়ায় তোরা খুব চিন্তায় পড়েছিস না রে? দিদি খাবি না!"

রান্নাঘর পার করে শিউলি তখন বাবার ঘরে এসে পড়েছে। এই ছোট্ট ঘরটা বাবার জন্য বরাদ্দ। একটা অন্ধকার প্রকোষ্ঠ। তবুও এটাই বড় আপন শিউলির। সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ হওয়া যায় এখানে। প্রায় দু'বছর বাবা বিছানায় শয্যাশায়ী। একটু আগে মা খাইয়ে পিঠে পাউডার মাখিয়ে শুইয়ে দিয়ে গেছে। পাটা ফুলে রয়েছে। চোখ বন্ধ। ঘরে ওষুধ গন্ধ। এই ঘরটা যেন পৃথিবীর বাইরের কোনো দেশ। শিউলি বাবার পাশে এসে বসে।

(পরের সংখ্য়ায় সমাপ্য)

  • পায়েল চট্টোপাধ্যায়
  • প্রথম