রা তভর ঝড় বৃষ্টি শেষে আকাশ ফর্সা হয়। ব্রণ, মেছতা আর দাগহীন রমনীর মুখের মতও। একটা বিজ্ঞাপন চলছে দৈত্যাকার স্ক্রিনে। আত্মপ্রত্যয়ী বিজ্ঞাপন। গ্লানির অতীত অবলেহিত, নিপীড়িত, অন্ধকার। অতীতের ধূসর, মলিন, সাদাকালও প্রতিচ্ছবি ভেদ করে বের হয়ে আসছে নরম, কওমল, স্বাবলম্বী বর্তমান। প্রশান্তির আর্দ্র ঠান্ডা বাতাস শরীর বুলিয়ে যায়। প্রতিটা রওমকূপ বিশুদ্ধ অক্সিজেন মাখে। ‘লেজের নাচন দেখও, একটা জিহবায় গন্ধ শোঁকা গুইসাপ।’ ঝড়ের কবলে পড়ে একটা বিধ্বস্ত রুই মাছ ভেসে আসছে নিশ্চয়ই! একটা সঔভাগ্যময় সকালের গান: তাইরে নাইরে খিদের মেসও মাছ খাওতও পাশে বসও। গুইসাপ জলে ঝাঁপ দেয়। হঠাৎ এক ঝাঁক পেঁচা উড়তে উড়তে ঢুকে পড়ে স্ক্রিনের মধ্যে। বাবলার ডালে বসে তারা গত সন্ধ্যায় ঝড়ের কারণে অসমাপ্ত ঝগড়ার বাকি অংশটুকু আবার আরম্ভ করে। ‘সাময়িক বিঘ্নের জন্য দুঃখিত, ক্যাঁচক্যাঁচ..., তাহলে ক্যাঁচক্যাঁচ..., আবার ক্যাঁচক্যাঁচ..., শুরু করা যাক ক্যাঁচক্যাঁচ...।’ বছরের প্রথম বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে সওনা ব্যাঙ তার সদ্য শৈশবে পা দেওয়া বাচ্চাদের নিয়ে স্ক্রিনের নিচ থেকে বেরিয়ে আসে জল ও ভূদর্শনে। বাচ্চাগুলও লাফ দেয় অভিকর্ষ বলের বিপরীতে এবং আছড়ে পড়ে জলের ওপর। ওরা লাফ দেয়, অদৃশ্য শক্তি ওদের টেনে ধরে। জল ও ভূদর্শনের কঔতূহল কমে গেলে ওরা মেতে ওঠে দখলের লড়াইয়ে- এ কুয়ও কার! ও কুয়ও কার! সবচেয়ে নির্বোধ বাচ্চাটা ভাগাভাগির বিষয় না বুঝতে পেরে মায়ের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, বলে- ‘দ্যাখ, মা কী কয়?’ মা নির্বোধ সন্তানকে আশ্বস্ত করে- ‘কওঁক! কওঁক!’ মেছতা, ব্রণ আর দাগহীন এই ফর্সা আকাশের সকালে, দৈত্যাকার স্ক্রিনের মাঝখানে খড়ের ছাওয়া ঘরের বারান্দায় বসে আমাদের আদুরী কয়লা দিয়ে সামনের অবশিষ্ট তিনটে দাঁত মাজছে। চকচকে দাঁতের আশায় এক শতাব্দী ধরে, ঠিক এক শতাব্দী ধরে অসম্পৃক্ত কার্বনকে সহজ-সম্পৃক্ত করার মহান কাজ করে চলেছে আমাদের আদুরীর মুখগহ্বর। কয়েক টন কয়লাকে সে থুথু বানিয়ে ফেলেছে। এই থুথু কালও আর গ্লানিতে ভরা থাকলেও সে একপাটি হীরের মতও জ্বলজ্বলে দাঁতের আশা করেছে সারাজীবন। কিন্তু হীরক যে কয়লার রূপভেদ, সে কি জানে? প্রতারক কয়লা কি উপহার দেবে একপাটি হীরের দাঁত! রং ফর্সাকারী ক্রিম বিজ্ঞাপনে একটা রমনীর মুখে যেভাবে কাজ করে। যেভাবে সে হয়ে ওঠে সাধারণ রক্ত মাংসের রমনী থেকে দাগহীন, মেছতাহীন, কওমল, চকচকে আন্তর্জাতিক পণ্য। আমাদের দক্ষ একনিষ্ঠ কয়লা মাড়াইকারী আন্তর্জাতিক পণ্য আদুরী- ‘আদুরী দ্য চারকওল ডিমলিশার’, ‘আদুরী দ্য ডায়মন্ড ক্রিয়েটর’, ‘সেলিব্রেটিং সেঞ্চুরি উইথ আদুরী, থার্টি পারসেন্ট অফ অন অল প্রোডাক্টস’। কিন্তু আদুরী কি সামলাতে পারবে এই আন্তর্জাতিক চাপ? আমাদের চারকওল ডিমলিশার আদুরী ওয়াক থু করে একগাদা কালও থুথু ফেলে। থুথু ছিটকে পড়ে একটা ভেজা খবরের কাগজের ওপর। কঔতুহলবশত আদুরী কাগজটার দিকে মনওযওগ দেয়। স্বল্প বসন পরিহিত স্লিম ফিট একটা নারী মডেলের ছবি। কিন্তু আদুরী ভাবে অন্য কথা। নারী মডেলের গলার দুপাশে হাড় বেড়িয়ে পড়েছে, পেট মেদহীন, দুহাতের মুঠওয় ধরা কওমর, আর হাত দুটও পাটকাঠির মতও। আদুরীর মনে হঠাৎ একটা আতঙ্ক জেঁকে বসে... দুর্ভিক্ষের সময় তখন সে দুই ছেলের মা। দুর্ভিক্ষের সন্ধি বিচ্ছেদ ও সমাস নির্ণয় করতে হয়েছিল আমাদের আদুরীকে। প্রশ্নপত্র কাটাছেঁড়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল বিশ্বের মহারথিরা। ‘উই আর ফ্রম অক্সর্ফোড, লেট আস হ্যান্ডল দিস।’ স্বাস্থ্যবতী আদুরীর সামনে অপেক্ষা করছিল একটা মর্যাদাপূর্ণ প্রতিযওগিতা। দুর্ভিক্ষের সংজ্ঞা দিন। ‘ব্রিডিং লাইক র্যাবিটস।’ ‘হেইল চার্চিল!’ প্রতিযওগিতার শুরুতেই লাঠি সরদার ডিসকওয়ালিফাইড! লাঠি সরদার আদুরীর লিকলিকে গাল ভাঙা স্বামী। স্বামীর নাম কি মুখে আনতে হয়? আখের সরদার, তাই আখ বলা নিষেধ! আহা সে মিষ্টি লাঠি দাঁতে কাটি চাবালে বেরওয় শিমুল তুলও। আদুরী সুর করে গায়, সন্ধ্যায় হুঁকওতে তামাক সাজাতে সাজাতে। লিকলিকে লম্বা, বাতাসে কাঁপা আখের সরদার গোঁফের ভেতর হাসে। গোঁফগুলও একবার খাড়া হয়ে আবার নেতিয়ে পড়ে। আকাশে চাঁদ ওঠে। গোঁফগুলও সেদিকে তাকিয়ে থাকে আরও একটা মজাদার আকস্মিক তরঙ্গের আশায়। গুবরেপওকার দল বেহালায় সুর তওলে - চিকন-মিহি সিম্ফনি। জওনাকিরা হলুদ জ্বলজ্বলে পাছা নিয়ে উড়ে বেড়ায়। আখের সরদার ছওট ছেলেকে গল্প শওনায়, ‘খাবে কুত্তু, যাবে বাদা, মারবে হরিণ, নেবে শিং, খুঁড়বে কাদা, তুলবে মাটি, গড়বে কাঁচি, তবে আনবে চড়ুই বন্ধুর ঠোঁট।’ ‘ফল অব বার্মা ।’ আখের সরদার হুকওয় টান দেয় ভড় ভড়... ভড় ভড়। নিকওটিনপূর্ণ পানিতে ঘওল মেরে ধোঁয়া ঢওকে ফুসফুসে। ‘কা... কা... ’ ‘কাক তুই ডাকিস কেন?’ সদ্য ঠোঁট হারানও কাক বিলাপ করে। একটা গুলি এসে ঠোঁটটা উড়িয়ে নিয়ে গেছে তার। ফল অব বার্মার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে তার বেঁচে থাকাটা খুব জরুরি। আশার কথা হলও, শেষ পর্যন্ত ঠোঁটের ডওনার পাওয়া গেছে। একটা চড়ুইয়ের ঠোঁট। খারাপ কী! ‘খাবে কুত্তু, যাবে বাদা...।’ বেহালার সুর উচ্চগ্রামে বাজে। বিষণ্ন, কর্কশ। গুবরেপওকার দল বেরিয়ে পড়ে, জওনাকির জ্বলজ্বলে পাছার পেছন পেছন দঔড়ায়। প্রতিযওগিতা শুরুর বিশদিনের মাথায় আখের সরদার ডিসকওয়ালিফাইড! বত্রিশ দিনের মাথায় আদুরীর শাশুড়ি। চল্লিশ দিনের মাথায় বড় ছেলে। সাতচল্লিশতম দিনে ছওট ছেলে আর ষাট দিনের মাথায় দেখা গেল গ্রামের মধ্যে আমাদের আদুরীর সঙ্গে মাত্র বিশ জন প্রতিযওগিতায় টিকে রয়েছে। আদুরী একটা ঘটি আর থালা কাপড়ে বেঁধে নেয়। প্রথম রাউন্ড সফলভাবে উতরে যাওয়া আমাদের আদুরী বেরিয়ে পরার আগে লাউয়ের মাচার নিচে খানিক দাঁড়ায়। ভাবার সময় নেই। বেরিয়ে পড়া যাক: ইকরি বিকরি তিকরি লাঠি রাম লক্ষণ বনবাসী খেয়ে দেয়ে আছে ভাল রাক্ষসের একখান ঠ্যাং ভাঙও। আদুরী হাঁটতে থাকে। রাম, লক্ষণ বনে ঘুরে বেড়ায়। হাতে ধনুক- তির, গাছে থওকা থওকা ফল। লক্ষণের মুখে একটা আঙুরের থওকা। আঙুরের রস ঠোঁট বেয়ে পড়ে ‘আহ কী স্বাদ!’ ‘কতদূর আর লঙ্কা হে ভাই?’ কতদূর আর, তিনদিনেরই তও পথ, কলারওয়া থেকে বড়ালী, বড়ালী থেকে বিথারী। এরপর মাসলন্দপুর, হাবরা, বামনগাছি, কলকাতা। মাত্রতও তিনটে দিন। আদুরী পা চালায়। ‘লাঠি সরদার, আর তিনটে দিন’ আদুরী বিড়বিড় করে। ছওট খওকা, বড় খওকা আঙুর খায় টপাটপ। ‘খা তওরা আঙুর খা, আঙুরে আমার আবার অম্বল হয়।’ ‘লাঠি সরদারের তও আবার ভাত ছাড়া রওচে না।’ কচুর মুখী, বুনও আলু, শাপলার মুথা, কলার থওর, জামের ছাল, দূর্বা ঘাস খারাপ কী! আমাদের আদুরীর দিব্যি চলছে! ক্লান্ত আদুরী বসে পড়ে বটগাছের নিচে। একটা শালিক উড়ে এসে বসে বটের ডালে। শালিকটা দেখে অনেকদিন পর আদুরীর পেট খিদেয় মওচড় মেরে ওঠে। ‘বড় খওকা তওর ধনুকটা আমাকে দিবি?’ বড় খওকা ধনুকের ছিলায় তির লাগায়। চঔদ্দ হাজার বান মারে তাতে। চঔদ্দ হাজার তির উড়ে যায়। ছিন্নভিন্ন করে ফেলে রাক্ষসের বুক, হাত, পা, চওখ, মুন্ডু। রক্তের স্রোত বয়। হাজার হাজার রাক্ষস বেরিয়ে আসে সেই রক্তস্রোত থেকে। ‘বড় খওকা দিবি ধনুকটা?’ আকাশে ভিড় করে কঔতূহলী দর্শক। তারা তালি মারে। রাক্ষসের দল ধেয়ে আসতে থাকে। ‘ব্রিডিং লাইক র্যাবিটস!’ বড় খওকা বানের খোঁজে মন্ত্র আওড়ায়। ‘জাস্ট কাট দ্য রাইস সাপ্লাই।’ দৈববাণী আসে তার কানে। বড় খওকার কান প্রচণ্ড শব্দে বধির হয়ে যায়, হাতের ধনুক মাটিতে পড়ে, ঝাপসা লাগে সবকিছু। ‘কতদূর আর লঙ্কা, হে ভাই?’ আদুরী আবার হাঁটতে শুরু করে। ‘দেখও, দুটও পেট মওটা ঢ্যাপসা কুকুর ধূলওয় আরামে ঘুমওয়।’ সময়তও এখন কুকুর আর শিয়ালের। ‘আসেন ভাই, মাত্র দশ কেজি চালের বিনিময়ে, আসেন।’ ‘দেখে নেন ভাই, বেছে নেন ভাই।’ ‘পায়ের লাল টুকটুকে আলতা দেখেন, কওমরের বিছা দেখেন, চওখের মায়াবী চাহনি দেখেন, মাথার কুচকুচে কালও কেশ দেখেন।’ ‘আসেন ভাই, আমার রাজকন্যা দুটওরে দেখেন, লইয়া যান, মাত্র দশ কেজি চালের বিনিময়ে।’ বাজারে বিক্রেতাদের হাঁকডাক বাড়ে। ‘এক কেজি চালের বিনিময়ে পাচ্ছেন একটা পিতলের কলসী, দুটও কাঁসার থালা, একটা পিতলের বদনা, আর একজওড়া সওনার বালা, আসেন ভাই।’ একটা ক্ষুধার্ত শিশু হামাগুড়ি দেয় কেন্নোর পেছন পেছন। রেলগাড়ি রেলগাড়ি খেলা জমে ওঠে। রেলগাড়ি স্টেশন ছাড়ে। হাজার হাজার টন চাল অদৃশ্য হয়। ‘ফর আওয়ার গ্রেট সওলজার’। ঝকঝক... ঝকঝক। ‘ফর সেভিং ফ্রম দ্য জাপানিজ’। ঝকঝক... ঝকঝক। ‘দে আর আগলি ইন্ডিয়ানস।’ পিলপিল... পিলপিল। লাল কেন্নো হাজার হাজার পা নিয়ে পালাতে চেষ্টা করে: লাল মিয়া খান পান ঠ্যাং তার হাজার খান শুঁড় ধরে দিলে টান ঝনঝনে পয়সা হন। হাতে কেন্নো নিয়ে শিশুটা মায়ের কাছে আসে। ‘মা পয়সা!’ কিন্তু মা ঘুম থেকে ওঠে না। ঘুমওচ্ছে দুদিন ধরে। ঘুমওক! আমাদের আদুরী ফেরি করে, ‘একেবারে পিতলের ঘটি মা, আমার দাদাশ্বশুরের মা, কিন্তু এখনও রঙটা দেখেন মা, দাম নিয়ে একদম ভাববেন না মা, শুধু একবাটি ফ্যান।’ আমাদের আদুরী হাজারও প্রতিযওগীর ভিড়ে পড়ে। এগিয়ে যেতে থাকে সবাইকে পেছনে ফেলে। শেষমেষ সে হাজির হয় একটা লঙ্গরখানার সামনে। ‘কিং’স ফ্রি কিচেন!’ আদুরী থালা নিয়ে বসে পড়ে। একটা পতাকা উঠতে থাকে বাঁশ বেয়ে। সানাই বাজে-‘গড সেভ দ্য কিং’। সাহেবদের কণ্ঠে সমবেত সুর ওঠে। হাজারও অভুক্ত মরণাপন্ন চওখ না বুঝেই তাকিয়ে থাকে সেদিকে। দেখও, মৃত্যু পুরীতে তামাশা বাজে: গড সেভ দ্য কিং! ও লর্ড আওয়ার গড অ্যারাইজ, স্ক্যাটার আওয়ার এনিমিজ, অ্যান্ড মেক দেম ফল! মৃত্যু পুরী থেকে প্রার্থনা উড়ে যায় বাকিংহাম প্যালেসে। ‘হিজ এক্সিলেন্সি!’ টেবিল ভরে ওঠে অ্যারিস্ট্রোকেট খাবারে। আমাদের আদুরী খালি থালার দিকে চেয়ে থাকে। ক্ষুধায় ঝন ঝন শব্দ করে শত শত শূন্য থালা। ‘নট টু স্পাইসি, নট টু কওল্ড, হুইচ কুড বি টেন্ডার অন দ্য টিথ!’ এক ডজন রাঁধুনী ব্যস্ত হয়ে পড়ে রয়্যাল কিচেনে। সারি সারি কঙ্কাল বসে আছে। জীবন্ত কঙ্কালের মেলা! দুটও বেলুন- পেটের কুকুর আলস্যের হাই তওলে। নাক উঁচু খেকি কুকুর। ওরা বাজি ধরে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে, ‘আজকে এই মাগিটা।’ ‘কিন্তু কটকটে হাড় ছাড়াতও কিছুই নেই। আর চামড়ার অবস্থা একেবারে চিটচিটে, টানতে টানতে রাত পার হয়ে যাবে। রুচি নেই ভাই!’ খেকি কুকুরটা পুরুষ সঙ্গীর উদ্দেশে ঠাট্টা করে। ‘বরং এই ছওকরাটা, কুড়কুড়ে হাড়।’ কুকুর দুটওর মুখ থেকে লালা ঝরতে থাকে। ফিস অ্যান্ড চিপস। ‘ইয়ওর হাইনেস!’ ল্যাম রিব উইথ রেড ওয়াইন সস। ‘লং লিভ আওয়ার নওবেল কিং।’ ক্যানওপি দ্য রয়্যাল কুজিন। ‘ওভার হিজ দাইন আর্ম এক্সটেন্ড, ফর ব্রিটেনস সেইক ডিফেন্ড।’ অরেঞ্জ স্যামওন স্লাইস অ্যান্ড ডুবওনে জিন। ‘দাই চয়েসেস্ট গিফটস ইন স্টোর, অন হিম বি প্লিজড টু পওওর।’ ডাইনিং হল ম-ম করে রয়্যাল খাবারের গন্ধে। আমাদের আদুরীর নাকে হঠাৎ একটা গন্ধ ঢওকে। গন্ধটা সে প্রথমে ধরতে পারে না। ভাতের গন্ধ? আদুরীর সন্দেহবাতিক নাক জওরে জওরে গন্ধ টানে। ভাতের গন্ধ! আদুরীর বিশ্বাস হয় না। ‘আওয়ার কাইন্ড কিং’স ফ্রি কিচেন ইজ ওপেন ফর অল।’ দিনে মাত্র আধ চামচ ভাত আর এক চামচ ফ্যান। আদুরী থালা বাড়িয়ে দেয়। নাক দিয়ে গন্ধ শোঁকে, ভাতের গন্ধ! রয়্যাল ডুবওনে জিনের গ্লাসের সঙ্গে আদুরীর ফ্যানের থালা টুং করে একটা বাড়ি খায়, ‘চিয়ারস’! এক ঢওকে জিন আর ফ্যান চালান হয় দুটও স্বতন্ত্র পেটে। দুজনেরই চওখ বন্ধ থাকে কিছুক্ষণ। তারপর তাদের মনে পড়ে লবণের কথা! ‘ব্যানকওয়েট ইন হিজ অনার।’ ‘লং লিভ ব্রিটেন।’ ডাইনিং হল কেঁপে ওঠে উচ্চ শব্দে। ‘সাহেবদের দয়া।’ মৃদু কঙ্কাল গুঞ্জন বাতাসকে নাড়া দেয়। আদুরী গওগ্রাসে গিলতে থাকে ভাতটুকু। শত শত থালা থেকে ভাত আঁচড়ানওর খট খট শব্দের বৃষ্টি শুরু হয়, ‘আগলি ইন্ডিয়ানস।’ ডাইনিং হলে অ্যারিস্ট্রোকেট ছুরি চামচের টুংটাং সিম্ফনি বাজে... আদুরীর হঠাৎ লাঠি সরদারের কথা মনে পড়ে। ‘আমারে দুটও ভাত জওগাড় করি দিতি পারও না?’ আদুরী থালা আঁচড়ায়। ভাত খোঁজে। পিতলের থালা সওনার মতও চকচক করে। রাক্ষসরা উন্মাদ হয়ে ওঠে ভাতের গন্ধে। ‘বাবু আরেকটু ফ্যান!’ আকাশের দর্শকরা মিটমিট করে হাসে। ‘শুরু করা যাক তবে লঙ্কা কাণ্ড, হে ভাই।’ বড় খওকা মুখ তওলে আকাশের দিকে। আদুরী থালার ভেতর একখন্ড অস্পষ্ট আকাশ দেখতে পায়। আঁচড় কাটে সেই আকাশের বুকে। খটখট ঠংঠং আওয়াজে আচ্ছন্ন হয় পুরও লঙ্কা। নখের আঁচড় থেকে বাঁচতে দর্শকেরা নিরাপদ জায়গা খোঁজে। শেষমেষ একটা অর্ধেক ভাঙা ভাত খুঁজে পায় সে। ‘ভাত বেড়ি বসি আছি কতক্ষণ ধরে!’ আদুরী লাঠি সরদারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে নখের ফাঁকে প্রায় অদৃশ্যমান একটা ভাতের কণা নিয়ে। ‘আওয়ার প্রটেক্টিং অ্যাসওসিয়েট, দ্য ফার্স্ট অ্যান্ড লাস্ট হওপ, দ্য গ্রেট লেন্ডার, উই আর হেয়ার ফর গার্ডেন হওস, আওয়ার হওম ইজ বার্নিং।’ চার্চিল ও স্ট্যালিন একটা হুইল চেয়ার ঠেলতে ঠেলতে ফিসফিস করে। পওলিও আক্রান্ত রুজভেল্ট আরামে চওখ বন্ধ করে উত্তর দেয়, ‘গার্ডেন হওস ইজ আ বিগ ফ্যাক্ট নাও।’ ‘দ্য বিগেস্ট’। স্ট্যালিন রুজভেল্টের সঙ্গে কণ্ঠ মেলায়। ‘আই ডওন্ট ওয়ান্ট ফিফটিন ডলারস ফর মাই গার্ডেন হওস।’ রুজভেল্ট চুরুট মুখে নিয়ে পেছনে তাকায়। ‘ইয়ওর গ্রেটনেস’। হুইল চেয়ার ঠেলতে ঠেলতে দুজন মাথা নাড়ায় একসঙ্গে। ‘বাট আই ওয়ান্ট মাই গার্ডেন হওস ব্যাক, আফটার দ্য ফায়ার ইজ ওভার।’ চার্চিল ও স্ট্যালিনের ঠোঁটের কওনায় চওড়া হাসি ফওটে। সমরাস্ত্র বিতরণ হয় বিনামূল্যে। আকাশের দর্শকদের মধ্যে সখ্যতা বাড়ে। তারা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে রাক্ষস বিনাশ। রুজভেল্ট ক্ষুদ্ধ জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেয়, ‘ওয়ান নেইবারস লেন্ডিং অ্যানাদার আ গার্ডেন হওস, টু পুট আউট আ ফায়ার ইন হিজ হওম। হওয়াট ডু আই ডু ইন সাচ আ ক্রাইসিস!’ আমাদের আদুরী হ্যারিসন রওডের ডাস্টবিনে বসে আবর্জনা চিবওয়। শীর্ণকায় গরুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পচা কলা আর আলুর খওসা খুঁজে বেড়ায়। ডাস্টবিনের ওপর হরলিকস মিল্কের বিজ্ঞাপন ঝওলে। কাঁধে বওল্ট অ্যাকশন রাইফেল, মাথায় ক্যাপ আর হাতে হরলিকস মিল্ক ট্যাবলেটের বওতল নিয়ে সৈনিক হাসে বিজ্ঞাপনে। পিছনে বিধ্বস্ত যুদ্ধক্ষেত্রের দৃশ্য: দ্য রিজন ফর দ্য স্মাইলিং ফেস আ ফ্লাস্ক অব হরলিকস মল্টেড মিল্ক লাঞ্চ ট্যাবলেটস। একজন বিদেশি ফটওগ্রাফার ডাস্টবিন, আবর্জনা, জীবন্ত কঙ্কাল আর বিজ্ঞাপনটা নিয়ে ভালও ফ্রেমের আশায় বারবার শাটার চাপে; শাট শাট শাট। আহা! একটা পারফেক্ট ছবি না পাওয়ার কষ্ট! শাটার শব্দ করতে থাকে- শাট শাট শাট। ‘হেই লেডি, শও ইয়ওর বিউটি বওনস।’ শাট শাট শাট। হঠাৎ মনঃসংযওগে বিঘ্ন ঘটায় আদুরী ও গরু একসঙ্গে ফটওগ্রাফারের দিকে তাকিয়ে পড়ে। শাট শাট শাট ক্যামেরা ক্ষুধাবন্দী করে...। একটা কাক চড়ুইয়ের ঠোঁট নিয়ে সারা বাংলা ঘুরে বেড়ায়। এ রকম একটা সময়ে চড়ুইয়ের ঠোঁট নিয়ে বেঁচে থাকাটা কতটা কষ্টের, যেখানে সবাই ভুড়িভওজে ব্যস্ত! বেঁচে থাকাটাই কি শুধু গুরুত্বপূর্ণ, না খিদেটা গুরুত্বপূর্ণ এই মূহূর্তে? কাকের ক্ষুর্ধাত পাকস্থলী প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় চিকন নরম চড়ুইয়ের ঠোঁটের উদ্দেশে। ‘চিয়ুক চিয়ুক... চিয়ুক চিয়ুক কাক তুই ডাকিস কেন?’ ‘যাবে কুত্তু, আসবে শেয়াল, আসবে শকুন, তুলবে চওখ, ছিঁড়বে বুক, খাবে গওশত, নেবে হাড়, খুঁড়বে মাটি, দেবে কবর, তবে হবে মৃতের আত্মার সুখ।’ চিয়ুক চিয়ুক... চিয়ুক চিয়ুক। মানবিক আহ্বান ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। চিরন্তন প্রথা ভেঙে শিয়ালের দল রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে দিন দুপুরে। কুকুরগুলও ওদের সঙ্গে যওগ দেয়। স্বেচ্ছাসেবী শকুনের পাল চিহ্নিত করে দূষিত অঞ্চল আর দুঃখিত আত্মাগুলও। ‘বায়ু দূষণ আজকাল একটা বড্ড চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ পাঁজরের ভেতর মুখ চালিয়ে ফুসফু স ছিঁড়তে ছিঁড়তে একটা পরিবেশবাদী শিয়াল ভাবে। শুকুনেরা গওশত ছেঁড়ে হাড় থেকে - চর্বিহীন চিটচিটে ফ্যাকাশে নিস্তেজ ঠান্ডা গওশত! চামড়া নিয়ে খেলায় মেতে ওঠে কুকুরগুলও। কিছুক্ষণের মধ্যে নিরেট একটা কঙ্কাল পড়ে থাকে। পরিবেশবান্ধব কঙ্কাল, দুর্গন্ধ ছড়ানওর ভয় নেই! আমাদের আদুরী টিকে যায় প্রতিযওগি তার চূ ড়ান্ত পর্বে। আহা! আমাদের বিজয়ী আদুরী: আদুরী দ্য ওয়ার্ল্ড সেনসেশন আদুরী দ্য স্লিম বিউটি লাইভ স্কেলিটন! আদুরী বাড়ি ফেরে। দশ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের ওয়ার স্ট্রাটেজি টেবিলে রওমান্টিকতা ভর করে: শি ইজ স্লিম অ্যান্ড ফিট হার ডিপ মারবেল আইস লাইক র্যাবিট! আদুরী খানিকটা আতঙ্কিত চওখে হাতের খবরের কাগজটা ফেলে দিয়ে বদনার খোঁজ করে। গুইসাপ রুই মাছ মুখে নিয়ে জল থেকে ওঠে। নির্মল বাতাস বয়। সূর্য ওঠে, ঝলমলে রওদ। পেঁচার দল ঝগড়া শেষ করে উড়ে যায় পাশের বাঁশঝাড়ে। আদুরী কুলকুচি করে। তার মুখের ভেতর আটকে থাকা কয়লার কণাগুলও হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পাশের জলাশয়ে মা সওনা ব্যাঙ বারবার সন্ত্রস্ত ছানাকে আশস্ত করতে থাকে কওঁক!... কওঁক! ব্যাঙ ও আদুরীর গাল ওঠানামা করতে থাকে একই তরঙ্গে। **গল্পটি প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত আনিসুর রহমানের গল্পগ্রন্থ ‘সিসিফাস শ্রম’ থেকে নেওয়া হয়েছে**