শতোর্ধ্ব আচার্য সুনীতিকুমার পাঠকের প্রয়াণ যেন আমাদের শিকড়ে একটা টান। আমরা যেন হৃদয়ের তন্তুতে যাপিত এক অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি টানতে বাধ্য হলাম মহাকালের আদেশে-
“আমরা বৌদ্ধ, আমাদের হৃদয়ে করুণা, বিনয়সম্মত আচরণ ও ভিক্ষচারিকা —এছাড়া আর আছে কী? বলুন? জীবন মানে তো শুধু চলা—শুধু পথচলা— অনির্দেশের সন্ধানে।” —মৃদুমন্দ হাসিতে বহু গূঢ় বৌদ্ধতত্ত্ব অব্যক্ত বৌদ্ধব্যঞ্জনায় বাঙ্ময় করে তুলতেন। ভারতীয় বৌদ্ধসংস্কৃতির ধারক, বহুভাষাবিদ, বিরল সারস্বত প্রতিভার অধিকারী বরেণ্য আচার্য সুনীতিকুমার পাঠক।
১৯২৪ সালের ১ মে বৃহস্পতিবার অবিভক্ত মেদিনীপুরের মনিঘাটির মাতুলালয় থেকে শান্তিনিকেতনের নিজস্ব নীড় অবনপল্লীর ‘আকাশদীপ’ পর্যন্ত এই শতবর্ষের যাত্রাপথে যাঁরাই তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন তাঁর ‘করুণাঘন’ হৃদয়ের আহ্বানে সকলেই ‘আত্মীয়’। নিজেই রসিকতা করে বলতেন ‘আমরা সকলেই তো বোধিসত্ত্ব —কেউ জাগ্রত, কেউ নিদ্রিত, কেউ অচেতন। সকলকে উজাগর করে তোলাই বৌদ্ধ সাধনা। পাঠশালায় হাতেখড়ি ও বিদ্যাচর্চা শুরু ও নানা আঁকা-বাঁকা পথে চলতে চলতে ১৯৪০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পালিতে স্নাতকোত্তরে প্রথম স্থান অর্জন। মূল বিষয়ের পাশাপাশি মঙ্গোলীয় লামা গেশে সাঙ্গ্পোর (Geshe sSangpo) কাছে সযত্নে তিব্বতি ভাষা ও সংস্কৃতির পাঠগ্রহণ চলত। প্রধান উৎসাহদাতা বরেণ্য অধ্যাপক ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। ১৯৪১ সালে প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি নিয়ে পালি, সংস্কৃত ও পুরাণাদি বিষয়ে গবেষণা করতে করতে ‘Sino-Tibetan scholarship’ প্রাপ্ত হয়ে কালিম্পং-এ আসেন ও বিখ্যাত তিব্বতি বিশেষজ্ঞ রুশ অধ্যাপক ড. জর্জ এন. রোয়েরিচের (Dr. George N. Roerich) কাছে তিব্বতিবিদ্যার পাঠ (১৯৫১—৫৪) সম্পন্ন করেন। ভারত-চীন সীমান্তের দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে পায়ে হেঁটে দুর্গম অঞ্চলের ইন্দো-তিব্বতি জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় জীবনযাত্রার অমোঘ আকর্ষণে ঘুরে বেড়াতেন। বৌদ্ধতত্ত্ব ও তিব্বতিয় বৌদ্ধতত্ত্বের যুগপৎ অনুশীলনসহ তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের চর্যার ব্যবহারিক প্রয়োগের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুসন্ধান ও প্রায়োগিক সুফল তাঁর নিরন্তর গবেষণার ফলে দিনের আলোয় এসেছে। এই অভিজ্ঞতার পূর্ণ নির্যাসটুকু নিংড়ে নিতে গিয়ে কোনও দিকে না তাকিয়ে ব্রাহ্মণ্য অস্মিতার প্রতীক উপবীতটি নিঃসঙ্কোচে তুলে দিয়েছিলেন তান্ত্রিক গুরুর হাতে। ১৯৫৬ সালে হিমালয়ের এক গুহায় তাঁর বজ্রযানে বৌদ্ধদীক্ষা সম্পন্ন হয়েছিল। এই সুনীতিকুমার পাঠক আবার তাঁর তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক তিব্বতি ভাষা ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির ব্যবহারিক জ্ঞানভাণ্ডার উজাড় করে দিয়েছেন দেশের সেবায় যখন ইন্দো-চিন যুদ্ধের সময় ভারত সরকার তাঁকে সেনাবাহিনীতে যোগদানের আহ্বান জানিয়েছে (১৯৬১—৬৮)। সেনাকর্মীদের তিব্বতি ভাষা প্রশিক্ষণ ও তিব্বতি নথির ইংরাজি অনুবাদ ছিল তাঁর কাজ।
১৯৪৪ সাল থেকে প্রফেসর পাঠকের বিশ্বভারতীর সঙ্গে যোগাযোগ। প্রথমে ২০৫ টাকা বেতনে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুঁথি গবেষণা বিভাগে যোগদান করেন। ওই বছরেই সি. আর. লামার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ‘ইন্দো-তিব্বতি অধ্যয়ন বিভাগ’ -এর শুভারম্ভ করেন। ১৯৮৪ সালের ৩০ এপ্রিল প্রথাগত বা আনুষ্ঠানিক অবসর নিলেও শেষদিন পর্যন্ত এই সম্পর্ক ছিল অটুট। শুধু নির্দিষ্ট বিভাগ নয়, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ও গুরুত্বপূর্ণ দায়ভার পালন করেছেন। অবসর গ্রহণের পর পাঁচ বছর (১৯৮৪—৮৯) সম্মানীয় অতিথি অধ্যাপক পদে বিভাগের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। ১৯৮৪—৮৭ ও ১৯৮৯—৯২ পর্যন্ত কলকাতার দি এশিয়াটিক সোসাইটির তিব্বতিচর্চা পরিদর্শনকারী অধ্যাপক পদে আসীন ছিলেন। ১৯৯২—৯৭ সালে এখানে চোমা ডি কোরস (Csoma de Kores) গবেষণা অধ্যাপক পদটি অলংকৃত করেন। ২০০৭—২০১৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যকালীন স্ব-অর্থায়ন পাঠক্রমের প্রধান বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ছিলেন। পালি বিভাগের অধীনে এই বৌদ্ধবিদ্যা অধ্যয়ন পাঠক্রমটি একবছরের ডিপ্লোমারূপে ও পরবর্তী পর্যায়ে ২০১১ সাল থেকে দু’বছরের ধারাবাহিক স্নাতকোত্তর পঠন-পাঠন চালু হয়। তারপর ২০১৪ সাল থেকে স্বাধীন বিভাগের স্বীকৃতি অর্জন করে। অধ্যাপিকা মণিকুন্তলা হালদারের উপদেষ্টা ও অভিভাবকরূপে আচার্য পাঠক ছিলেন এই বিভাগের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। ২০১৭ সাল পর্যন্ত তাঁর অধ্যাপনায় ও পরিচালনায় এই বিভাগ ছিল আলোকিত।
সারস্বত ভ্রমণে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য বিশেষত চিন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ অধ্যুষিত দেশসমূহ ভ্রমণ করেছেন ও বহু সম্বর্ধনাসহ সম্মাননা অর্জন করেছেন কিন্তু তাঁর সংগৃহীত গ্রন্থবেষ্টনীতে জ্বলজ্বল করত সুবিশারদ স্বর্ণপদক, কাব্যবিশারদ ও পুরাণরত্ন স্বর্ণপদক প্রেমচাঁদ ও রায়চাঁদ বৃত্তি শংসাপত্র, মোয়াট গোল্ড মেডেল, রাষ্ট্রপতি সম্মাননা শংসাপত্র (২০০৭: তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিল), আর্যমঞ্জুশ্রী সম্মান (ইন্ডিয়ান সোসাইটি ফর বুদ্ধিস্ট স্টাডিস্) প্রভৃতি।
আচার্য পাঠকের সারস্বতচর্চার সামূহিক গ্রন্থণ ও পঞ্জিকরণ চলছে। বড় অনীহা ছিল বৃহৎ সংস্করণ প্রকাশে। সংক্ষিপ্ত অথচ তথ্যবহুল, গবেষণানির্ভর প্রবন্ধ রচনায় অনেক আরাম বোধ করতেন। রূঢ় সত্যকে কত সহজে গ্রহণ করতেন। তাই রচিত বহু মূল্যবান ত্রয়োদশ গ্রন্থের পাশাপাশি বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি, তিব্বতি, পালি ও অপভ্রংশ ভাষায় বিরচিত ত্রি-শতাধিক নিবন্ধ বা গবেষণা প্রবন্ধ এখন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে। এই ‘জীবনচারিকা’ -র শক্তিরপে সর্বদাই পাশে ছিলেন সহধর্মিনী শ্রীমতী গীতা পাঠক। আচম্বিতেই সেই ছন্দপতন হয় ২০২২ সালের ২৯ মে। শ্রীমতী পাঠক পাড়ি দেন অমৃতলোকের পথে।
বহুমুখী সারস্বত অবদান অচঞ্চল অনির্বাণ অগ্নিশিখার মতো দেদীপ্যমান রেখে আপন কর্মের বিভায় বিভূষিত জ্ঞানতাপস আচার্যবর সুনীতিকুমার পাঠকের পঞ্চস্কন্ধ বিলীন হয়েছে অনিত্যতার সরণী বেয়ে ২০২৪ সালের ৪ ডিসেম্বর ঘুমের মাঝে ঘুমের দেশে। ধন্য এ জীবন পূর্ণ এই মানবসত্তা -অনিন্দ্য, আলোকিত ও প্রদর্শক।