আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়

জ্ঞানতাপস সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় আজ অনেকটাই বিস্মৃতির আড়ালে চলে যাওয়া এক মনীষী। বাংলা সাহিত্য, ভাষাতত্ত্বের ছাত্র-শিক্ষক-গবেষকদের কাছে তাঁর গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু ভারতের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ঘিরে তাঁর অবজারভেশন ঘিরে আর প্রায় চর্চাই হয় না-

 

 

আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়(১৮৯০,২৬  নভেম্বর-১৯৭৭,২৯ মে) বাংলা ও বাঙালির নিজস্ব অহঙ্কার। হাওড়ার শিবপুরে মামারবাড়িতে সুনীতিকুমারের জন্ম। পিতা হরিদাস চট্টোপাধ্যায়ের শিক্ষাব্রতী হিসেবে খ্যাতি ছিল। অসমাপ্ত আত্মজীবনী "জীবন কথা" (বইটি প্রথম জিজ্ঞাসা প্রকাশ করেছিল। পরবর্তীতে প্রকাশ ভবন এই অমূল্য গ্রন্থটির পুনঃমুদ্রণ করেন)তে শৈশব, কৈশোরের মামার বাড়ি এবং শিবপুরের বড়ো মর্মস্পর্শী বিবরণ সুনীতিকুমার রেখে গিয়েছেন। ওঁদের কলকাতার  পৈতৃক বাড়িতে তখনও শান বাঁধানো মেঝে হয়নি। মামার বাড়ি শিবপুরে নতুন (এই বানানটিও সুনীতিবাবুর একান্ত নিজস্ব) শান বাঁধানো মেঝে হয়েছে। মা এবং অন্যান্য ভাই বোনদের সঙ্গে সুনীতিকুমার গেছেন মামার বাড়ি শিবপুরে। সেখানে পরিস্কার শান বাঁধানো লাল মেঝেতে ঢেলে দেওয়া হয়েছে একরাশ মুড়ি। তার উপরে আস্তে আস্তে পড়লে ঘন করে জ্বাল দেওয়া দুধ,সকরি কলা, চিনি। পরিস্কার সেই মেঝেই যেন খাবার পাত্র। হাপুস হুপুস করে সবাই খাচ্ছেন ফলার।

 

 

এই সহজ, সরল অনাবিল জীবনের ভিতর দিয়ে শুরুটা হয়েছিল বলেই বুঝি বা অসাধারণ হয়েও অতি সাধারণ থেকে গিয়েছিলেন মনীষী সুনীতিকুমার। আত্মজীবনীতেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, হোমারের প্রভাব নয়, গ্রীক পুরাতাত্ত্বিক হেসিয়েডের "থিয়োগনিয়া" -এর প্রভাব আছে ভারতের রাম কাহিনীতে। দশরথ জাতক উল্লেখ করে দশরথনন্দনদের সম্পর্কে যে ধারণার ইঙ্গিত তিনি করেছিলেন, সেই সত্যকথনের জন্যে হিন্দু মৌলবাদীদের দ্বারা কম হেনস্তার শিকার হতে হয়নি এই মানবপ্রকৃতিবেত্তার।

                     

 

সুনীতিকুমারের শিক্ষাজীবন শুরু সহয়েছিল মতিলাল শীলের ফ্রি স্কুলে(১৯০৭)। সে যুগের স্কুলের পরীক্ষায় তিনি ষষ্ঠ স্থান অধিকার করেছিলেন। পরে ভর্তি হলেন স্কটিশ চার্চ কলেজে। সেখানে এফ এ পরীক্ষাতে অর্জন করলেন তৃতীয় স্থান। ১৯১১ সালে তিনি ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স সহ স্নাতক হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে। কলেজে তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। এই সময়কালে তাঁর বাল্যবন্ধু তথা সে যুগের বিশিষ্ট্য শিল্পপতি নগেন্দ্র নাথ দাস (পাওয়ার টুলের জন্মদাতা) তাঁর জীবনে অনেকখানি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। ১৯১৩  সালে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ করেন সুনীতিকুমার। প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন এম এ পরীক্ষাতেও। সেই বছরেই তিনি বিদ্যাসাগর কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। সেখানে তাঁর সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলেন শিশিরকুমার ভাদুড়ীকে।

               

 

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিশেবে সুনীতিবাবু যোগ দিয়েছিলেন ১৯১৪ সালে। ১৯১৯ পর্যন্ত সে সময়ে তিনি সেই পদে ছিলেন। এরপর তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করতে যান। ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষাতত্ত্ব, প্রাকৃত, পার্শিয়ান প্রাচীন আইরিশ সহ বিশ্বের প্রচলিত, অপ্রচলিত প্রায় সব ভাষা নিয়েই সেখানে তিনি গবেষণা করেন। এরপর যান আরও বিস্তারিত গবেষণার জন্যে প্যারিসে। ১৯২২ সালে দেশে ফিরে এসে আবার যোগ দেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভারতীয় ভাষার খয়রা অধ্যাপক হিসেবে এক স্বর্ণযুগ রচনা করেন এই সময়ে।

             

 

রবীন্দ্রনাথের বালি, সুমাত্র, জাভা দ্বীপের যাত্রা সঙ্গী ছিলেন সুনীতিকুমার। এই সফর নিয়ে লেখেন, "রবীন্দ্রসঙ্গমে দ্বীপময় ভারত ও শ্যামদেশ"। দ্বীপময় ভারতকে চেনার একটি আকর গ্রন্থ হিসেবে এই বইটিকে উল্লেখ করলে মনে হয় না ভুল হবে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর "শেষের কবিতা" -এর মুখ্য চরিত্র অমিত রায়ের চর্চাতে সুনীতিবাবুর ব্যাকরণের উল্লেখ আছে। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি বিধান পরিষদের সভাপতি ছিলেন। অরিজিন অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট অফ বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ(ও ডি বি এল) তাঁর অমর সৃষ্টি। তাছাড়াও "বেঙ্গলী ফোনেটিক রিডার", " ইন্দো এরিয়ান অ্যান্ড হিন্দি", " ভারত সংস্কৃতি", " সংস্কৃতি শিল্প ইতিহাস", " রামায়ণ: ইটস ক্যারেকটর, জেনেসিস, হিস্ট্রি অ্যান্ড এক্সোডাস: এ রিসিউম", " ওয়ার্লন্ড লিটারেচর অ্যান্ড টেগোর" তাঁর ঐতিহাসিক কীর্তি। আত্মবিস্মৃত বাঙালি হিন্দুস্থান পার্কে সুনীতিকুমারের বাসগৃহ" সুধর্মা" র জাতীয় সংরক্ষণ করতে পারেনি। সেই ঐতিহাসিক বাড়িটি এখন ফ্যাবিন্ডিয়া পোষাক বিপণী।

  • কুহু বাগচি
img
আগের পাতা
কবিতাগুচ্ছ