কবিতাগুচ্ছ

সায়ন্তনী ভট্টাচার্যের পাঁচটি কবিতা
 
 
অগোছালো পাড়ার ভাড়াটে
সায়ন্তনী ভট্টাচার্য 
 
যে লন্ঠনে আলো নেই, সে লন্ঠন খেয়েছে আমাকে
 
বহুদূর যেতে হবে, মানে নেই কোনো
 
বজ্রবিদ্যুতে দেখা গেল পথ, তারপর বাতাস যেমন 
 
হুহু করে। অগোছালো পাড়া এর নাম। এখানেই দোকান দিয়েছে
 
বৃষ্টি পড়ছে, জমে যাচ্ছে জল, বুকের ঢেউ-এর কাছে
 
আধভাঙা দুঃখ সম্বল। আর সেই রেশন দোকানে
 
চাল নেবে বলে লাইনে দাঁড়িয়েছে সে। না মেটা খিদের পাশে
 
বাড়ি, বাজারের ব্যাগে ফের ভরে আনছে লন্ঠনের তেল
 
দুঃখ-টুঃখ কিছু না তেমন, অন্ধকারে চোখেও পড়ে না     
 
   --------
 
 
সাইকেল সওয়ারি
সায়ন্তনী ভট্টাচার্য 
 
 
তিন গুন পেয়েছি দুঃখ, দু গুন রেখেছি আমি দেরাজে তাহার
 
তারপর ঘন মেঘ হল। সমুদ্রে নেমে এলো সে
 
উজান বাড়ালো। তারপর ভোর ভোর খুব কাঁদাকাটা
 
দুপুরেও ফের, এতসব অশ্রুপাত দেখে টুক করে
 
সাইকেলে চেপে সোজাসুজি পৌঁছে গেল কে জানে কোথায়
 
কে জানে কোথায় তাই সেই থেকে বুকে চেপে আছে
 
নদীর প্রাণের মতো প্রাণে, আমাদের কঠিন দালানে
 
থাকে খায়, ফিরি করে নীলাভ লজেন্স, জীবনের ব্যথা তুলে নেয়
 
   ----------                 
 
সমস্ত অগাস্ট জুড়ে বৃষ্টি পড়ছে
সায়ন্তনী ভট্টাচার্য 
 
কলেজস্ট্রিট থেকে শ্যামবাজার হেঁটে গেলে যে ছায়া পড়ে
 
তা আমার নয়। আমি তখন কোথায়, ছায়া গাড়ি বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে  
 
আমি অসুখে ঢুকে পড়েছি, তুমুল বৃষ্টি, জল জমছে
 
প্রচুর ভিজেছি আমি, কোথায় মাথা মুছব, কোথায় পা ধোব
 
সোনার জঙ্গল পার করে তোমার কাছে যেতে হবে
 
অনেক বিকেলবেলা অন্ধকার করে তুমি জোনাক জ্বেলেছ
 
অনেক বিকেলবেলা আমারও দেরাজ ভর্তি ঢেউ
 
মাঝেমধ্যে তাদের আমি সোজাসুজি দেখি, চুমু খাই
 
 ----------
 
 
 
শেষ বৃষ্টির কবিতারা 
সায়ন্তনী ভট্টাচার্য 
 
 
আমি জানি মরে যাওয়া আকাশে মেশানো ঢেউয়ের নাম
 
তুমি মরে যাওয়ার পাশে বসলে, মানুষ মরে যাচ্ছে, শুধু শুধু মরে যাচ্ছে
 
মিছিমিছি মরে যাচ্ছে। মস্ত বড় শহরে ছোট্ট ছোট্ট মানুষের ম্যাজিক
 
তারপর কতশত ফুল, জাদুঘর, সোনালি সুতোর কাজ
 
আমাদের ঘুমের ঘোরে চাঁদের আলো, নাওয়া নেই, খাওয়া নেই
 
ছটফট করতে করতে একফালি চেয়ে থাকা, চন্দনের গন্ধ আসছে
 
হাতে হাত রাখলে দুঃখ ভুলে যাওয়া যাবে ভেবে মানুষ
 
খুব ভালোবাসতে চাইছে। পৃথিবীর নীলের মতো ফকফকে একখানা ভালোবাসা                                  
 
 
----------
 
হেমন্ত-জোছনার আলো 
সায়ন্তনী ভট্টাচার্য 
 
 
উন্মাদের মতো কবিতা লিখছি। কবিতায় আমার শাড়ি ভরে যাচ্ছে, ওড়না ভরে যাচ্ছে
 
তারপর দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে, দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে, দিন বোবা হয়ে যাচ্ছে
 
বোবা দিনের বন্ধুরা আমরা আড্ডা মারব বলে ঘর খুঁজছি
 
ঘর আঁকছি পেনসিলে। বোবা মানুষেরা পৃথিবীতে ঘর আঁকছি
 
যে জমিতে আমাদের কান্না পড়ে, সে জমি আমাদের বলতেই
 
আকাশ থেকে কতশত জোনাক নেমে এলো
 
শেষ বৃষ্টিতে ভিজছি সবাই। শেষ বৃষ্টির খুব আনন্দ থাকে, আলো থাকে
 
 -----------------
 
ফারহানা সুলতানার তিনটি কবিতা
 
 
 
অবয়ব
ফারহানা সুলতানা
 
 
শুকনো পাতার সর ঠেলে
পথ চলে গেছে-
জঙ্গলের তলপেটে 
অদৃশ্য হাওয়ায় 
সাদা টুপি 
নীল পোশাকের অবয়ব। 
 
নির্জন দুপুরে  
একা ফিরে গেছে হাওয়া 
রক্তিম প্রান্তর পেরিয়ে। 
 
জলভরা মাঠে নেমে আসে অন্ধকার অবেলা।
   
দেয়ালে ঝোলে মলিন টুপি আর পোশাক
 
দেখা হয় এক মানুষের সঙ্গে আর-এক অন্য মানুষের।
 
------------------------
 
আচ্ছন্ন সময়
ফারহানা সুলতানা
 
 
ঘুম আসে না
অন্ধকারের কিছু উজ্জ্বল আলোর দানা
কুড়িয়ে কুড়িয়ে খাই। 
 
জেগে থেকে
কেবলই হেঁটে বেড়ায় দু-চোখ
ঘুমিয়ে পড়া শহরের গাঢ় অলিগলি ধরে।
ভেঙে পড়া চালের টালি
গুছিয়ে নিতে নিতে 
ল্যাম্পপোস্টের নীচে ঝাঁক ঝাঁক ঘুম জড়ো হয়
গাছের পাতায় উঠে আসে আচ্ছন্ন সময়।
 
-----------------------------
 
 
কাকের কলরব শুনে
ফারহানা সুলতানা
 
 
স্নিগ্ধ, রঙিন প্রজাপতি
জলে, জংলি লতাপাতা ঘিরে
 
পুকুরপাড়  
বাঁশবন  
ধানজমি 
আরও কিছুটা গেলে 
স্তব্ধ চারকোনা অন্ধকার পড়ে আছে, এখানে
ঘরে ফেরা কাকের কলরব শুনে 
মাথা নুয়ে পড়ে দানবের।
-----------------------------
 
আলী আফজাল খানের তিনটি কবিতা
 

ঘুমপাড়ানি...
‌আলী আফজাল খান

জিভ ন্যুব্জ হল একবার, বাতাস আলটাকরায় টুসকি মেরে বেরিয়ে গেল হাঁ–দিক...‌
জিভ বসেছে বেদম।
বাঁশির গাছে সশব্দে গুটিয়ে এল অন্যবার, বাতাস পাড়াবেড়ানি ফসকে গেল দুপাশ দিয়ে,
আওয়াজ বের হল না এতটুকুও,
গলার বাক্সে বর্ষা বৃষ্টি নামল ওদিকে,
নকশা ভারী করতে করতে টিয়াটুম উলবুলোন দেয় হাতের রুমালে,
সুঁড়িপথের মত নকশা, জড়িয়ে যায় জড়িয়েই যায় খালি ভেতরে একখানি যন্তরমন্তর
রেখে, যার মধ্যে লোহার বল গলালেই একপাশ থেকে গড়িয়ে নকশা মেখে বেরিয়ে যাবে
অন্যপাশ, নো হাঁসফাঁস.‌..
শালগাছেরা মাথা হেলিয়ে হেলিয়ে তুমুল পড়োশি করছে একে অপরের সাথে, কতখানি
বৃষ্টি জমল এবার তার খতিয়ান, সবে তো ভাদ্দরমাস...
আর গ্রামখানি চিরে সাপের জিভের মতো দুফালি বেঁকে যায় একখানি রাস্তা...
বারবার বারবার...
চুম্বকের ওপর ভাপের রাস্তা,
ভাপের ওপর পৃথিবীর,
তার ওপর কাঁকরের,
তার ওপর ধুলোর,
তার ওপর হাওয়া
আর এতোলবেতোল তাতে Z এঁকে বয়ে যায় অজস্র স্নায়ুর খাম..

-------------------------

 

একলব্যের মহাকাব্য
‌আলী আফজাল খান

পুষ্কন্নির কাদা বাগে আনতে গিয়ে ভাবুদিদার তোমার আঙুল আঁকশির ঢঙ নিয়েছে,
বুড়োন্তিকালে এসে।
হাঁটু ফোঁপরা হয়ে গিয়ে এখন বাঘিনীর নখর শক্ত ডাঙায় আছড়ায়, অট্টহাস্যের মতো।
বাকি জীবন বে–কাদার, বেকায়দার।
কলঙ্গায় রাখা দশক দশকের অচল পয়সা, জীবনভরের ভুলভাল খুচরো।
শিকারের গল্পে হাঁপটান লাগে।
সাদা কাগজের আতঙ্কী গুটিয়ে আসে একলব্যের শিহরে,
স্বাক্ষরহীন মহাকাব্য।
কাঁড়বাঁশের গন্ধে বিভোর বনজ অর্জুনেরা ছিলাটান উপড়ায় হঁড়দেশীয় ধর্মক্ষেত্র।
মাঝে পিলচু হাড়াম বাধ্যত দ্রোণ কেউ, মানবমাংসের বিকল্প রাখেনি এযাবৎ কোনও বিবর্তন।
উত্তরাধিকার হায়েনার ধর্ম খুঁজে নেয়।
এঁটেল মাটি স্বভাবে কিছু গান্ধারী জাতীয় বাপ।
সন্ততিপ্রতিম গল্পে শ্যেন হানতে নিদাঘ পর্যাপ্ত একটিই বাঁশফুল,
বারো বছরের পার।
অদূরে ছাগল চরায় ভাপন্ত মাসজমিন নিগূঢ় উদ্যত ক্যানাইন,
জিভক্ষেত্রে কুলকুলি রেখে গালবাদ্যে ধেয়ে আসে আসন্ন হুলপরব।

--------------------------

হে ব্রহ্মাণ্ড
‌আলী আফজাল খান

না হে, কোন চালচিত্র নাই সে আলোর লিঙ্গ নাই যোনি নাই...
পট নাই অতীত
বলার নাই নস্টালজিয়া
এই আজ হইতে, খরচ করিবার প্রতুল শব্দও...
প্রত্যেক শব্দের নাকি সিংহাসন থাকে, মাথার তাজ,
তাকে যত্রতত্র বসিয়ে অঙ্গছেড় আজ হইতে ব্রাত্য...
অমল আলোর সংসারে আলোর ছাতিমবীথি,
হে ব্রহ্মাণ্ড, নাভিতে ঘুমাইলাম, সময়ে আলোড়ন দিও, সময়ে জাগরণ।

-----------------------------

 গৌরী সেনগুপ্তের কবিতা

শাবক

গৌরী সেনগুপ্ত

 

প্রতিশ্রুতি শুনি আর অর্ধাশনে খাই
উৎসব প্রাঙ্গণে বসে আকাশকে দেখি
স্রোত ঠেলে ঠেলে রোজ বয়স বাড়াই
জটিল অঙ্কের ফল সিঁড়ি ভেঙে লিখি।
আর্তনাদ শুনি তবু ঘটনা বানাই
প্রতিদিনের সন্ত্রাস যা চোখ বুজে দেখি
কেবল ভরসা পেয়ে ট্রাজেডি নামাই
করজোড়ে তাই বলি আমি সহযোগি।
ভর্ৎসনা শুনে শুনে সফল মানুষ
দুবেলা অন্ন তুলি অন্নপূর্ণা জ্ঞানে
চাপান উতোর করে অমিত পুরুষ
ধনে ধনে ধনঞ্জয় দীক্ষা নিই কানে।
স্বাগত হে রাজপথ তোমাকেই বলি
নিজেকে নৈবেদ্য করে দিয়েছি অঞ্জলি।

  • সায়ন্তনী ভট্টাচার্য, ফারহানা সুলতানা, আলী আফজাল খান, গৌরী সেনগুপ্ত