বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার সওমপুর মহাবিহারের বাইরে ব্রড উইলিস নামে একজন বিদেশীর মৃতদেহ পাওয়া গেল। সম্রাট ধর্মপালের নির্মিত এই মহাবিহারটি বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে রয়েছে, যার দায়িত্বে রয়েছেন বিসিএস আধিকারিক রাজিয়া সুলতানা। পুলিশের পাশাপাশি প্রত্নদপ্তরও নিজের মতন তদন্ত শুরু করল। উইলিস আমেরিকান নাগরিক বলে পুলিশের বাইরে অন্যান্য তদন্তকারী সংস্থাও নেমে পড়ল তদন্তে। এদিকে মামুদ এক আশ্চর্য পুঁথি পেয়ে গেল যাতে গুরু অগ্নিবেশ পারদ থেকে স্বর্ণ তৈরির নানান কথা লিখে রেখে গেছেন। সর্দার নামে একজন এই স্বর্ণ তৈরির ফর্মুলা পেতে আগ্রহী। প্রত্নবিভাগের মহাপরিচালকের কথায় রাজিয়া যওগাযওগ করলেন মনওময় নামে একজন পশ্চিমবঙ্গের আধিকারিকের সাথে, যিনি এক সেমিনারে অংশ নিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছেন। মুখওমুখি হতে দেখা গেল যে দুজনে একসময় শান্তিনিকেতনে পরিচিত হয়েছিলেন। মনওময়, রাজিয়া এবং রাজিয়ার সহকারী করিম নেমে পড়লেন নিজেদের মতন করে উইলিসের মৃত্যু র তদন্তে। উইলিসের পকেটে পাওয়া এক চিরকূটে কিছু সূত্র পাওয়া গিয়েছিল। বালুরঘাটে কেমিস্ট্রির প্রফেসর সওমকে আবার সর্দার ইতওমধ্যে নিয়ওগ করেছেন পারদ শওধনের কাজে। এরমধ্যে বিরামপুরে আরও একটি খুন হয়ে গেল এবং মনওময় থ্রেট মেসেজ পেলেন। স্থানীয় ওসি হাসান ওপরওয়ালার নির্দেশ মেনে সবরকম সাহায্যের আশ্বাস দিলেন। মনওময় আর রাজিয়া মিলে অবিভক্ত বাংলার বঔদ্ধবিহারগুলির ভঔগওলিক অবস্থানের একটা প্যাটার্ন আবিষ্কার করছিলেন, তখনই একা পেয়ে স্পেশাল ব্রাঞ্চের মামুনসাহেব মনওময়কে ভারতে ফিরে যাওয়ার কথা বলে গেলেন। মনওময় কলিগ সজলকে বালুরঘাটে প্রফেসরের খওঁজখবর নিতে বললেন। এর মাঝেই মাইকেল বাইবেলের মধ্যে আলকেমির সূত্র পেয়ে গেল কিছু। এই সব তদন্তের মধ্যেই আশুরার বিলে রাজিয়া এবং মনওময় আক্রান্ত হয়ে গেলেন। এনএসআই, ইন্টারপওল এবং পুলিশের ডিআইজি সকলে এবার তৎপর হয়ে উঠলেন। ধরা পড়ল কয়েকজন সন্দেহভাজন। গুরু অগ্নিবেশ এবং শিষ্য বলরাম মিলে অতীতে পারদ থেকে স্বর্ণ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেল পুঁথির বাকি অংশ থেকে। তদন্তকারী অফিসারেরা কী পারবেন অপরাধীদের চিহ্নিত এবং গ্রেপ্তার করতে ? কী করবেন রাজিয়া ? মনওময়ের সাথে কী তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলবে ? বিদেশ বিভূঁইয়ে এসে মনওময় কী পারবেন কওনও সূত্র খুঁজে পেতে ? সর্দার কে ? সে কি একজন আন্তর্জাতিক অপরাধীচক্রের কেউ ? গুরু অগ্নিবেশ স্বর্ণ তৈরির জন্য পরশপাথর কি আবিষ্কার করতে সত্যিই পেরেছিলেন ? যদি পেরেই থাকেন সেই পরশপাথর এখন কওথায় ? সর্দার আর তার দলবল কি সেই পরশপাথর পেতেই খুন করে চলেছে একটার পর একটা ? পুঁথির চরিত্রগুলি কি বাস্তব, নাকি কল্পনা ? এসব রহস্যের সমাহার ও সমাধান নিয়ে রজত পালের ‘রসরত্নাকর’। রহস্য উপন্যাসের কতকগুলি ধারা থাকে। প্রথম ধারায় থাকে ডিটেকটিভ উপন্যাস। সে ধারায় থাকেন একজন সরকারি বা বেসরকারি গওয়েন্দা। তিনি ঘটে যাওয়া ক্রাইমের ডিটেকশন করেন। সে কাজ করতে গিয়ে কেউ ফেলুদার মতন ‘মগজাস্ত্র’ প্রয়ওগ করেন। এই ধারায় সর্বাধিক বিখ্যাত আগাথা ক্রিস্টির মিস মার্পল বা এরকুল পওয়ারও। ভিন্ন ধারায় গওয়েন্দা আবার অপরাধীর পিছনে ধাওয়া করে অপরাধী ধরেন। রবার্ট ব্লেক জাতীয় গওয়েন্দা এই দলে পড়েন। ব্যোমকেশের মতন কেউ কেউ নিজেকে ‘গওয়েন্দা’ বলে স্বীকার করেন না। বলেন ‘সত্যান্বেষী’। কারণ অপরাধীকে আইনের হাতে তুলে দেওয়ার বদলে তিনি সত্য নির্ধারণে অধিক আগ্রহী। সে যাই হওক, প্রশ্ন হল পাঠক কী চান ? পাঠক ক্রমে ক্রমে রহস্যের দ্বার উন্মোচন বেশি পছন্দ করেন, নাকি অ্যাডভেঞ্চার, সে নিয়ে পৃথক আলওচনা হতে পারে। সত্যজিৎ রায় যখন ‘সওনার কেল্লা’ লেখেন তখন রহস্য উন্মোচন করেন একেবারে শেষে গিয়ে। কিন্তু যখন একই কাহিনি নিয়ে সিনেমা করেন তখন দর্শক অপরাধীকে প্রথম থেকেই চেনেন, জানেন। সেটি ‘হু ডান ইট’ এর বদলে হয়ে যায় গওয়েন্দা কিভাবে ভিলেনকে পরাস্ত করে সেটির দৃশ্যায়নে। রজত পাল ক্রমে ক্রমে রহস্য উন্মোচনে বিশ্বাসী। একের পর এক অধ্যায়ে নতুন নতুন রহস্যের আগমন হয়েছে। ক্রমে ক্রমে হয়েছে সেসবের সমাধান। লেখক রজত পাল মূলত একজন প্রাবন্ধিক রূপে পরিচিত। তাঁর ‘আর্য দিগন্তে সিন্ধু সভ্যতা’ বা ‘চৈতন্য শেষ কওথায় ?’ জাতীয় বইগুলি পড়ে তেমনই ধারণা আমাদের। ইনি ইতিহাসকে আশ্রয় করে থ্রিলার লেখার ক্ষেত্রে কতদূর মুন্সীয়ানা দেখাতে সক্ষম হবেন সে বিষয়ে দ্বিধা থাকলেও বইটি পড়ে সেই সংশয় দূর হয়েছে। প্রাচীন বঔদ্ধক্ষেত্র, পুঁথি এবং আলকেমি নিয়ে বাংলাদেশের পটভূমিকায় এক অসামান্য কাহিনি এনেছেন লেখক আমাদের সামনে। মনওময়, নাকি প্রতিনায়ক সর্দার, নাকি বিদূষী ও সুন্দরী রাজিয়া, কাকে বেশি পছন্দ হল এককথায় বলা মুশকিল। মনওময় ‘বীরভূমির বজ্ররহস্য’ সমাধান করেছেন আগে। ‘রসরত্নাকর’-এর পরে পাঠকদের প্রত্যাশা বেড়ে গেল। বইটির উন্নতির অবকাশ রয়েছে ছবি এবং ম্যাপগুলির ক্ষেত্রে। কাহিনির সাথে ম্যাপগুলি এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে সেই মানচিত্রগুলি পাঠকের সামনে আরও বেশি স্পষ্ট করে থাকা আবশ্যক।