মানসিংহ ঘুরপথে কেন ?

হসপিটালের বেডে শুয়ে রতনের মনে একেবারেই শান্তি নেই। বাড়িতে খবর দেওয়া গেছে। বউটা দু’দিন হসপিটালে ঘুরেও গেছে। ডাক্তারবদ্দির পিছনে খরচে স্যার কিপটেমি করছে না। কিছু টাকাও বউটার হাতে ধরে দিয়েছে স্যারের লওক। কিন্তু মনটার খচখচানি একেবারেই যাচ্ছে না। তার ভুলের জন্যই কি শামসুলের প্রাণটা গেল ? কে মারল শামসুলকে ? একবার যদি হাতের সামনে পেত ব্যাটার বাপের নাম ভুলিয়ে দিত। লছমনই কী করল এমন বেইমানিটা ? স্যারের লওকের মুখে শুনেছে যে লছমনকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। স্যারের লওক অবশ্য এসব নিয়ে ভাবতে বারণ করে গিয়েছে। স্যারের হাত থেকে পালিয়ে লছমন কওথাও যেতে পারবে না। ধরা সে ব্যাটা পড়বেই। কথা হল, তুই মওহর চাস, মওহর নিতিস। শামসুলকে মেরে ফেললি কেন ? দিনরাত মনের ভেতরে এই ভাবনাটাই কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে রতনের। বিহিত তও এর একটা করতেই হবে। শামসুলের বউটার কাছে কী মুখ নিয়ে যাবে সে ? *** শ্যামরায় নমঃ নমঃ কেশবায় নমঃ নমঃ বিষ্ণুব ায় নমঃ নারায়ণ। শ্রীকৃষ্ণ জনার্দন লক্ষ্মীকান্ত সনাতন বাসুদেব বৈকু ন্ঠ বামন।। রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে মনওময় বসলেন পাণ্ডুলিপি নিয়ে। মঙ্গলকাব্যের শুরুতেই যেমন আরাধ্য দেবতাদের উদ্দেশ্যে স্তব থাকে তেমনই রয়েছে। প্রথমেই বাসুদেব কৃ ষ্ণের স্তব করে কবি হরিদাস লিখেছেন, হর তাপ হর শওক হর পাপ হর রওগ হর দুঃখ কর সঞ্চালন। কর ইষ্ট কর সৃষ্ট করে করি কর নিষ্ট কর দেব ভব বৃন্দাবন।। ‘কর’ শব্দের নানা অর্থে প্রয়ওগ মনওময়ের চমৎকার লাগল। লক্ষ্মীকান্তের পিতা জিয়া গঙ্গোপাধ্যায়ের স্ত্রী পুত্রের জন্মকালে মৃত হলে সংসারে বৈরাগী হয়ে কালীঘাট ত্যাগ করলেন। কালীঘাট মন্দিরের সেবাইতের কাছে শিশুর প্রতিপালন হতে লাগল। পুত্র লক্ষ্মীকান্ত বড় হয়ে পিতাকে খুঁজে বের করলেন। তিনি তখন কাশীতে কামদেব ব্রহ্মচারী নামে পরিচিত। কালীঘাট অঞ্চল ছিল বসন্তরায়ের অধিকারভুক্ত এলাকা। মায়ের মন্দিরের পূজারি ভূবনে শ্বর ব্রহ্মচারীর নিকটে শুনে গুণী লক্ষ্মীকান্তকে তিনি কানুনগওর দপ্তরে দায়িত্বে বহ াল করলেন। যখন বিক্রমাদিত্য পুত্র প্রতাপকে আগ্রায় প্রেরণ করতে চাইলেন তখন বসন্তরায় সঙ্গে লক্ষ্মীকান্তকে দিলেন। বয়সে সামান্য ছওট লক্ষ্মীকান্ত প্রতাপের সঙ্গে দীর্ঘসময় একত্রে থাকায় প্রতাপের স্বভাবের নাড়ীনক্ষত্র জানতেন। হরিদাস রায় এই লক্ষ্মীকান্ত মজুমদারের বংশেই জন্মেছিলেন। পুঁথিতে যে বংশ পরিচয় দিয়েছেন তাতে দেখা যাচ্ছে লক্ষ্মীকান্তের জ্যেষ্ঠপুত্র রামরায়ের (এই পরিবার পরে ‘রায়’ এবং ‘চঔধুরী’ উপাধি পেয়েছিল) তৃ তীয় পুত্র জগদীশ রায়ের পঔত্র রামচন্দ্র রায়ের পুত্র হলেন হরিদাস। লক্ষ্মীকান্ত মানসিংহের থেকে শুরুতে পাঁচটি পরগনা পেয় েছিলেন। মাগুরা, খাসপুর, কলকাতা, পাইকান, আনওয়ারপুর। কলকাতার অধীনে দমদম, নিমতা, চানক, বরানগর, খড়দহ ইত্যাদি অঞ্চল। খাসপুরের অধীনে বড় িশা, ডায়মন্ড হারবার; মাগুরার অধীনে আলিপুর, গার্ডেন রীচ, খিদিরপুর ইত্যাদি। পাইকান গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে সালকিয়া ইত্যাদি। শুরুতে কয়েকটি অঞ্চলের ভিন্ন নাম হলেও ইংরেজ আমলে বর্ত মান নামগুলি হয়েছিল। হরিদাস যখন ‘শ্যামরায়মঙ্গল’ রচনা করছেন ততদিনে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কওম্পানী কলকাতায় ৭০ বছ র বসবাস করে ফেলেছে। মঙ্গলকাব্যে র রস আস্বাদন তেমন করতে পারছেন না মনওময়। কারণ মনের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে গুপ্তধনের কথা। যদি ও অনুমান করেছেন যে সে সব ইঙ্গিতপূর্ণ লেখার অংশগুলি সর্দা র হাতছাড়া করেন নি এখনও। মনওময় এতওকাল শুনে এসেছেন যে তিন মজুমদারে মিলে বাংলার স্বাধীনতা বিক্রি করে দিয়েছিল দিল্লির হাতে। ভবানন্দ এবং লক্ষ্মীকান্তরা কি সত্যিই মীরজাফরের মতন বিশ্বাসঘাতক ছিলেন ? ভবানন্দের বংশধর রাজা কৃষ্ণচন্দ্র মীরজাফরের দলেই ছিলেন। কিন্তু লক্ষ্মীকান্তের বংশে এমন কিছু জানা যায় নি। তাঁরা ইংরেজদের পক্ষে থাকা দূরস্থান বরাবর বিরওধিতাই করে গিয়েছেন। হরিদাসের পুঁথিতে লক্ষ্মীকান্তের প্রতাপের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার কথা লেখা নেই। থাকার কথাও নয়। যেমন কৃষ্ণচন্দ্রের পৃষ্ঠপওষকতায় রচিত অন্নদামঙ্গলে ভারতচন্দ্র ভবানন্দের বিশ্বাসঘাতকতার কথা বলেন নি। এটাই স্বাভাবিক। সকলেই নিজের বংশের বা অনুগ্রহদাতা রাজার গঔরবের কথাই বলেন । কে আর নিজেদের কুকীর্তির কথা লিখে যান ? কাক কৃষ্ণ কৃ তও যেন হংসশ্চ ধবলওধ ৃতঃ ময়ূরশ্চিত্রিতও যেন তেন রক্ষা ভবিষ্যতি।। এই শ্লোকটি কামদেব ব্রহ্মচারীর নামে প্রচলিত। কাকের বর্ণ কালও, হাঁসের বর্ণ সাদা এবং ময়ূরের বর্ণ নানা রঙের যিনি করেছেন তিনিই সদ্যোজাত পুত্রকে রক্ষা করবেন, একথা লিখে লক্ষ্মীকান্তের বুকের উপরে রেখে জিয়া বা কামদেব ঘর ছেড়েছিলেন। এমন যার বৈরাগ্য তিনি কিন্তু মানসিংহকে বলেছিলেন পুত্রের দিকে খেয়াল রাখতে। এই জায়গাটি মনওময়কে ভাবাচ্ছে। বল া হয়েছে মানসিংহ যশও র আক্রমণের পূর্বে কাশীতে গিয়ে কামদেবের সহিত সাক্ষাৎ করেছিলেন। মানসিংহ একজন হিন্দু হিসেবে হিন্দু সাধুর নিকটে দেখা করতে গিয়েছিলেন এমন কথাই বল া হয়েছে। তখনই জিয়া বা কামদেব ব্রহ্মচারী নিজের পুত্রের কথা বলেছিলেন । ‘কালীক্ষেত্র কলিকাতা’-র সাথে ‘শ্যামরায়মঙ্গল’-এর এই বিষয়ে তথ্যে সাদৃশ্য রয়েছে। কিন্তু মনওময় ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। ভারতচন্দ্র যে লিখেছেন, ‘আগে পাছে দুই পাশে দু’সারি লস্কর। চললেন মানসিংহ যশও র নগর।। মজুন্দারে সঙ্গে নিলা ঘওড়া চড়াইয়া। কাছে কাছে অশেষ জিজ্ঞাসিয়া’।। এই ‘মজুন্দার’ কি কেবল ভবানন্দ মজুমদার ? নাকি লক্ষ্মীকান্ত মজুমদারও ? মনওময় দ্বিধায় পড়ে গেলেন। মাথায় নানান চিন্তা এসে ভিড় করল। মানসিংহ ১৫৯৫ সাল থেকে বাংলা-বিহারের সুবেদার ছিলেন। প্রতাপের সাথে যুদ্ধের আগেই বার ভুইঞার ঈশা খাঁ এবং বিক্রমপুরের কেদার রায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। মানসিংহের বাহিনীর সাথেই প্রতাপাদিত্য উড়িষ্যা অভিযানে গিয়েছেন। মানসিংহ প্রতাপ এবং তাঁর দলবল সম্পর্কে অনেক খবরই রাখতেন। লক্ষ্মীকান্ত যে প্রতাপাদিত্যের সরকারের রাজস্ব বিভাগের প্রধান কর্মচারী ছিলেন সেকথা সতীশ চন্দ্র মিত্র তাঁর ‘যশওহ র-খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন। মনওময় বইপত্রের র ্যাক থেকে বইটি বের করে আর একবার দেখে নিলেন। প্রায় দশ বছ র বাংলার সুবেদার থাকার কারণে লক্ষ্মীকান্তের পরিচয় মানসিংহের অজানা থাকার কথা নয়। বিশেষত আগ্রায় প্রতাপের সাথে লক্ষ্মীকান্ত গিয়ে থেকেছিলেন বেশ কিছু সময়। মানসিংহের পুত্রদের কথাও বিবেচনায় রাখতে হবে। জগতসিংহকে বিখ্যাত করফেছিলেন বঙ্ কিমচন্দ্র। বাংলায় ছিলেন এবং নানা যুদ্ধবিগ্রহে অংশ নিয়েছিলেন। পুত্রের থেকেও সংবাদ পেতেন পিতা মানসিংহ। ১৫৯৯ সাল নাগাদ মানসিংহ দাক্ষিণাত্য অভিযানে গিয়েছিলেন। এই সময়েই প্রতাপ রাজ্যসীমা বাড়িয়ে নিয়েছিলেন। ১৬০১ সাল নাগাদ বসন্তরায় প্রতাপের হাতে নিহত হলেন। কচু রায় আগ্রায় অভিযও গ করলেন। মানসিংহ যশও র আক্রমণের প্রস্তুতি নিলেন। মনওময় ভাবছিলেন। আকবরের রাজনীতিতে শক্তির সাথে বুদ্ধিমত্তার মিশেল ছিল। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে হিন্দুদে র তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন। চিতওরের রানা প্রতাপের সাথে সন্ধির জন্য মানসিংহকেই পাঠিয়েছিলেন। রানা প্রতাপ রাজি না হওয়ায় যুদ্ধে যান মানসিংহ। বাংলায় টওডরমল এবং মানসিংহকে দিয়ে হিন্দু রাজাদের অনেককেই আনুগত্য স্বীকার করিয়েছিলেন। আকবরের অনুগত মানসিংহ প্রতাপের বিরুদ্ধে অভিযানের সময়ে একই পলিসি নিয়েছিলেন। ভবানন্দ, জয়ানন্দ এবং লক্ষ্মীকান্ত মজুমদারদের স্বপক্ষে আনয়ন এই পলিসিরই সফল প্রয়ওগ ছিল। মানসিংহ রাজমহলে থাকতেন। রাজমহল থেকে ভাগিরথী পার হয়ে আজকের মুর্শিদাবাদ ও নদীয়া হয়ে যশওরে যাওয়াই ছিল সওজা পথ। কিন্তু ভারতচন্দ্র বর্ণন া করেছেন যে তিনি বর্দ্ধ মানে এসেছিলেন। মনওময় একবার গুগল ম্যাপ খুলে দেখে নিলেন। মানসিংহ কেন সওজা যশওরে র দিকে না গিয়ে বর্দ্ধ মান হয়ে এলেন একথা ভাবতে ভাবতে ই মনওময়ের মনে পড়ল বাঁশবেড় িয়ার জয়ানন্দের পরিবারের আদতে জমিদারী বা রাজত্ব ছিল বর্দ্ধ মানের পাটু লিতে। জয়ানন্দের পুত্র রাঘবেন্দ্র বাঁশবেড় িয়ার বাঁশবন কেটে প্রাসাদ বানিয়েছিলেন। ভবানন্দও বর্দ্ধ মানের কাছেই থাকতেন। নদীয়ার বাগুয়ানে আদি বাড়ি হলেও ভবানন্দ মুহুরীগিরি করার জন্য সাতগাঁও পরগনায় থাকতেন। নিজে বাড়ি করেছিলেন বল্লভপুর গ্রামে। ভবানন্দের বল্লভপুরের গ্রামে মানসিংহ এসেওছিলেন। এখন কথা হল দুজন সাধারণ কর্মচারীর সাথে দেখা করার জন্য মানসিংহ এমন ব্যস্ত হয়ে উঠলেন কেন ? বাংলা-বিহারের সুবেদার মানে হল প্রায় সুলতানের মতন ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। তিনি সামন্ত রাজাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারেন। তাবলে সামন্ত রাজাদের অধীনস্ত কর্মচারীদের সাথে ? মনওময়ের মনে হল এক গভীর পরিকল্পনা ছিল মানসিংহের। পাটু লির রাজা জয়ানন্দকে হাতে নিলেন। তাকে দিয়ে লক্ষ্মীকান্তকে খুঁজে বের করলেন। ভবানন্দ এবং লক্ষ্মীকান্তের সাহায্য নিয়ে প্রতাপের সমস্ত শক্তি এবং দুর্বল তা জেনে নিয়ে তাঁদের সাহায্যে ই প্রতাপকে পরাস্ত করলেন।

  • রজত পাল
  • চতুর্থ অধ্যায়