বড়দিনের বড়বাজারে

নভেম্বর ২০১৮। অফিসের কাজে জার্মানির মিউনিখ শহর ছুঁয়ে যেতে হবে ব্রিটেনের ম্যানচেস্টারে। দু'জায়গাতেই এই সময় হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা, তাই ঠেসে গরম জামা ঢোকাতে হল ব্যাগে। ৩০ নভেম্বর শুক্রবার এমিরেটস এয়ারলাইনসের বোয়িং ৭৭৭ বিমানে কলকাতা ছাড়লাম রাত আটটা কুড়িতে। ডিনার দিল ওঠার এক ঘণ্টার মধ্যে, এমিরেটসের নন ভেজ হিন্দু মিল” - রীতিমত বাঙালি মেনু কড়াইশুঁটির পোলাও, চিকেন কারি, সিমুইয়ের পায়েস আর একটা পেল্লায় পান্তুয়া। খেয়েদেয়ে একটু রেড ওয়াইন সহযোগে এমিরেটস ইনফ্লাইট এন্টারটেনমেন্ট নিয়ে মজে থাকলাম। সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার ফ্লাইট, অনেকটা সময়। সেই ফাঁকে একটা হিন্দি আর একটা বাংলা ছবিও দেখে ফেললাম। 

 

 

দুবাইয়ে যখন নামলাম তখন ওখানকার স্থানীয় সময় রাত সওয়া বারোটা। দুবাই এয়ারপোর্টে দিন রাত বোঝা অসম্ভব। আলো, বৈভব আর ব্যস্ততার মেলবন্ধনে দুবাই চব্বিশ ঘণ্টাই মোহময়ী। তবে সেই রূপে মুগ্ধ হয়ে এদিক সেদিক দেখার সময় নেই তখন, ছুটতে হল রীতিমত। সওয়া এক ঘণ্টার মধ্যে মিউনিখের ফ্লাইটে উঠলাম হাঁচোড় পাঁচোড় করে। আমার এক সহকর্মী কলকাতা থেকেই সঙ্গী; কিন্তু ও আগে এয়ারপোর্টে পৌঁছে বোর্ডিং পাস করিয়ে নিয়েছিল বলে পাশাপাশি সিট হয়নি আমাদের। এবার আমার আইল সিট। এই ফ্লাইটটা একটু লম্বা। তাই একটু ঘুমানোর সুযোগ খুঁজছিলাম। মাঝের সিটে একজন শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোক, বেশ বয়স্ক, চশমাপরা। তার পাশে কানঢাকা হেডফোন আর মাথায় টুপিওলা এক কৃষ্ণাঙ্গ ছোকরা। সাধারণত ফ্লাইটে যাত্রীরা নিজেদের মধ্যে খুব একটা কুশলবিনিময় করে না। কিন্তু এক্ষেত্রে একটু অন্যরকম হল। বয়স্ক ভদ্রলোক নিজে যেচে প্রথমে আমার সঙ্গে, তারপর ঐ ছেলেটার সঙ্গে আলাপ করলেন। থাকেন ওয়েস্ট লন্ডনে, নাম ক্রিস পার্কার। লন্ডনের কিংস কলেজে মিডিঈভাল হিস্ট্রি পড়ান। সামনের বছর রিটায়ারমেণ্ট। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন মিউনিখে আর ম্যানচেস্টারে কী কাজে যাচ্ছি। বললাম। আমি একসময় বছরখানেক ইস্ট লন্ডনে ছিলাম। তাই আলাপটা দিব্বি জমে উঠল। আমি ওখানে গিয়ে প্রথম যেখানে উঠেছিলাম তার পাশেই একটা পার্ক ছিল। আলতাব আলি পার্ক। হঠাৎ কী মনে হল, ফস করে বলে বসলাম,

আচ্ছা পার্ক শব্দটা আর পার্কার সারনেমের…”

বিঙ্গো। তুমি ঠিক ধরেছ। মধ্যযুগে পার্ক দেখভাল করত আমার পূর্বপুরুষেরা। অবশ্য আমরা ঐ অর্থে মালী নই। আমরা ছিলাম মূলত গেমকিপার। বাই দ্য ওয়ে, পার্ক আর গার্ডেনের পার্থক্য বোঝো তো?”

গার্ডেনে খালি গাছেরই দেখভাল করা হয়। কিন্তু পার্কে অন্য পশুপাখিরাও থাকে।

বাঃ, ভাল বলেছ। আসলে মধ্যযুগে সব রাজা রাজড়ারা শিকার করতে ভালবাসত। সেটা কিছুটা ফ‍্যাশনও ছিল সেই সময়ে। জঙ্গলে হিংস্র পশুদের ভয়, তার ওপর নিজের রাজধানী ছেড়ে থাকাটা রিস্কি। তাই বাড়ির কাছাকাছি তৈরি হত এইসব পার্ক। সেখানে খরগোশ, হরিণ জাতীয় নিরীহ প্রাণীদের ছেড়ে রাখা হত, বংশবৃদ্ধি করানো হত। রাজা রানিরা সময় সময়ে পিকনিক করতে এসে এদের শিকার করত।

 

 

উনিও দেখলাম আমার মতন রেড ওয়াইন নিলেন।

বাই দ্য ওয়ে, তুমি কি ঘুমোতে চাইছিলে? বকবক করে তোমাকে জাগিয়ে রেখেছি!

বাই দ্য ওয়েশব্দবন্ধটা দেখলাম ওঁর মুদ্রাদোষ।

না না, বেশ লাগছে আপনার কথা শুনতে। স্কুলে পড়ার সময় আমার খালি দুটো সাবজেক্টই ভাল লাগত, যদিও টেক্সটবুকগুলো নয় একটা কেমিস্ট্রি, অন্যটা হিস্ট্রি…”

তার মানে বোঝাই যাচ্ছে যে, মিস্টিরিয়াস ব্যাপার স্যাপারে ইন্টারেস্ট আছে!একটু জোরেই হেসে উঠলেন। পরক্ষণেই চারদিকের অন্ধকার আর নিস্তব্ধতার সাথে আপোস করে গলা নামিয়ে বললেন,

মিউনিখ আর ম্যানচেস্টার দু'জায়গাতেই এখন ক্রিসমাস মার্কেট চলছে। সময় করে দেখে নিও।

অবশ্যই দেখব। তা আপনি মিউনিখে কী জন্যে যাচ্ছেন?”

একটা বিষয় নিয়ে রিসার্চ করছি। কী নিয়ে, ইউ টেক আ গেস…”

ইজ্ ইট ক্রিসমাস মার্কেট?”

রাইট এগেইন।

মিউনিখের ক্রিসমাস মার্কেট কি কিছু স্পেশাল?”

প্রত্যেকটা শহরেরই ক্রিসমাস মার্কেট ইউনিক, মাই ফ্রেন্ড। তাদের স্ট্রাকচারটা মোটামুটি একরকম কিন্তু বৈচিত্র্যে ভরা। আমি মিউনিখের পর ভিয়েনা যাব। ওখানেই বেশি সময় থাকব। ফেরার সময় নুরেমবার্গ ঘুরে ফেরার ইচ্ছে আছে। বাই দ্য ওয়ে, কাল রবিবার বিকেলে তোমার এনি এনগেজমেন্ট?”

আমি একটু ভাবলাম। আজ বিকেলে কিছু প্রোগ্রাম করেছি এখানকার এক কলিগের সাথে। ফিরতে রাত হবে। রবিবার তাহলে একটু বেশিক্ষণ ঘুমিয়ে ব্রাঞ্চ সেরে মিউনিখের রাজপ্রাসাদ রেসিডেঞ্জঘুরে বিকেলটা স্পেয়ার করতেই পারি। 

না, সেরকম কিছু নেই। আপনার সাথে জুড়ে যেতে পারি।

গ্রেট। তুমি তো আগে মিউনিখে এসেছ। মারিয়ানপ্লাৎস চেন তো?”

আমার হোটেল থেকে ট্রেনে মিনিট দশেক। তাছাড়া আমি কাছেই রেসিডেঞ্জে হয়ত থাকব তখন…”

ওখানে তাহলে বিকেল চারটে?”  

ডান। আমি চলে আসব নিউ টাউন হল ক্লক টাওয়ারের সামনে।

চোখ বন্ধ করে ভাবলাম ভদ্রলোক এতটা ঘুরে লন্ডন থেকে দুবাই হয়ে কেন মিউনিখে যাচ্ছেন! কিন্তু বোজা চোখ দুটো আর খুলতে ইচ্ছে করল না।

 

  • প্রান্তিক বিশ্বাস
  • প্রথম