'ভবেশ কালী'র  বিশ্বজনীন 'বড়মা' হয়ে ওঠা

উৎসবের সর্বাঙ্গীনতা ভক্তির সংমিশ্রণে নৈহাটির বড়মা এখন বাংলার সামাজিক জীবনের অঙ্গ। মাকে অর্চনা করে গেলেন মায়েরই কন্যা, আমাদের অভিভাবিকা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-

 

 

আমাদের এই ব্যারাকপুর মহকুমার  একেকটি মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বহু কিংবদন্তী। বহু অজানা ইতিহাস। এই সব মন্দিরের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বাংলার কত বিখ্যাত নাম। রানী রাসমণি থেকে সাধক রামপ্রসাদ। এমনকি শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি, যে  এককালের বাংলার নবাব আলীবর্দী খান থেকে কাজি নজরুল ইসলামের মতো মুসলিমদের নামও আমাদের এই শিল্পাঞ্চলের নানা কালীক্ষেত্র'র সঙ্গে অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে।

 

এই অঞ্চলের বেশ কয়েকটি কালী মন্দিরের জন্য  'নিষ্কর' জমি দান করেছিলেন তৎকালীন নবাব আলীবর্দী। তার মধ্যে নৈহাটি শ্যামাসুন্দরী তলার মন্দিরটি অন্যতম। ৩০০ বছরেরও পুরোনো এই মন্দিরের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে বাংলার আরেক কিংবদন্তী কবির নাম। কথিত আছে, এই মন্দির চত্বরে বসেই গেয়ে চলতেন একের পর এক নিজের লেখা শ্যামাসঙ্গীত। একজন মুসলিম কবি, কালী মন্দিরের চাতালে বসে উদাত্ত কন্ঠে গাইছেন,  'কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন'! এই দৃশ্য আজকের এই সাম্প্রদায়িকতার অশান্তিতে দীর্ণ উপমহাদেশে কল্পনা করতে গেলেও ভ্রম লাগে।

 

 

যাই হোক, সেই কাহিনী অন্য কোনও দিন। এই ব্যারাকপুর মহকুমার কালী মন্দিরগুলি নিয়ে লিখতে গেলে একটা আস্ত আঞ্চলিক ইতিহাসের গ্রন্থ হয়ে যাবে। বরং আজ এই লেখা, 'ভবেশ কালী' থেকে 'বড়মা'য় রূপান্তরিত হওয়ার কিংবদন্তি নিয়ে। সম্প্রতি রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও এই বড়মার মন্দিরে পুজো দিতে এসেছিলেন। সংবাদপত্রে এবং টেলিভিশনের পর্দায় যে খবর দেখেছেন সকলেই। যার পর থেকে নৈহাটির এই বড়মায়ের মন্দির নিয়ে আগ্রহ আরও বেড়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। বড়মার মন্দিরের বাইরে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা মোতাবেক, প্রশাসনের পক্ষ থেকে, 'বড়মা আউটপোস্ট' বা পুলিশ ফাঁড়ি'র উদ্বোধন হয়েছে।  নৈহাটি ফেরিঘাটের নাম 'বড়মা'র নামে নামাঙ্কিত করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।

 

 

কিন্তু, কোনও অদৃশ্য এক শক্তিতে একশো বছর আগের ভবেশ কালী আজ পরিনত হলেন বড়মা'? যে মায়ের টানে ছুটে আসেন দেশ বিদেশ থেকে পুর্ন্যার্থীরা! আসেন নামীদামী চিত্র তারকা থেকে রাজনীতির নেতা-নেত্রীরা। আজকাল সামাজিক মাধ্যমে কিছু মানুষকে প্রায়ই দেখি লেখেন, "এই বড়মা আবার কবে উদয় হলো?” বা ''এই সব নতুন হচ্ছে! নতুন ব্যবসা...ইত্যাদি..ইত্যাদি। একটা কথা প্রথমেই স্পষ্ট করা প্রয়োজন, নৈহাটির বড়মা কিন্তু শিব্রাম চক্রবর্তীর লেখা বিখ্যাত সেই 'দেবতার জন্মে'র মতো দু'দিনে গজিয়ে ওঠা কোনও দেবী নন! বড়মা'র এই ইতিহাস জানতে হলে , একশো বছরেরও বেশী সময়ে পিছিয়ে যেতে হবে।

 

 

নৈহাটি অরবিন্দ রোডেরই বাসিন্দা  স্বর্গীয় ভবেশ চক্রবর্তীর বাড়িতে আগে থেকেই মা কালীর পুজো হতো। কোনও একবছর ভবেশ চক্রবর্তী নবদ্বীপের রাসে বিরাট বড় বড় প্রতিমা দেখে মনে সাধ হয়, তিনিও এমন বিশালাকার মাতৃপ্রতিমা গড়ে কালী পুজো করবেন। কিছুদিন বাদে তিনি স্বপ্ন পান যে মা, সেইভাবেই তাঁর কাছ থেকে পুজো চাইছেন। মায়ের উচ্চতা হবে বাইশ ফুট বা ১৪ হাত। এরপরের বছর কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন থেকে মায়ের কাঠামোপুজো করে,মাতৃমূর্তি নির্মাণ শুরু হয়। এবং কালীপুজোর দিন সুবিশাল প্রতিমা গড়ে মায়ের পুজো শুরু হয়। ভবেশ চক্রবর্তীর হাতে শুরু হওয়ায় এই কালীর নাম লোকমুখে 'ভবেশ কালী' নামে প্রচারিত হতে শুরু করে। 

 

 

অনেকেরই ধারণা, স্রেফ সোশ্যাল মিডিয়ায় 'মার্কেটিং স্ট্রাটেজি' এবং প্রমোশনের জন্যই আজ বড়মায়ের মন্দিরের এত রমরমা। এ প্রসঙ্গে কিছু কথা বলা জরুরি, 'ভবেশ কালী' হিসেবে যখন নৈহাটি অরবিন্দ রোডে এই মায়ের পুজো শুরু হয় তখন থেকেই এই মায়ের নানা অলৌকিক শক্তির উদাহরণ পেতে শুরু করেন এলাকার সাধারণ মানুষ। লোকমুখে প্রচারিত হয়, মায়ের কাছে দন্ডী কেটে মানত করলে মা তাদের ফেরান না। স্থানীয়দের মুখে মুখেই মায়ের মাহাত্ম্য ছড়াতে থাকে। আমরা যে সময়ের কথা বলছি, তখনও সোশ্যাল মিডিয়া জিনিসটা কী, মানুষ জানেই না। স্বাভাবিকভাবেই, মায়ের এই মহিমার কথা কেবল নৈহাটি এবং আশেপাশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

 

 

তবুও আমাদের ছোট বেলায় অর্থাৎ ঐ ২০০৩-০৪ সালেও দেখেছি বহু মানুষ দন্ডী কাটছেন। মায়ের কাছে মানসিক পূর্ণ হলে, মাকে সোনা উপহার দিচ্ছেন। এই যে, মাতৃপ্রতিমা সোনা-রুপোয় মোড়ানো, এর কোনওটাই কিন্তু  হালফিলের না! কার্ত্তিক অমাবস্যায় মাটির তৈরি যে মূর্তিতে প্রতি বছর মায়ের পুজো হয়, সেই মূর্তির এইসব অলঙ্কার দেখে আসছি জ্ঞান হওয়া ইস্তকই। আর এই সব গয়নার কোনওটাই কেনা নয়, সবটাই মায়ের ভক্তদের দান।

কিন্তু,২০১৩-১৪ থেকে যখন থেকে স্মার্টফোনের রমরমা বাড়ল। মোবাইল ইন্টারনেট সহজলভ্য হয়ে গেল, অমনি ঝড়ের বেগে এই মায়ের মহিমাও ছড়িয়ে পড়ল গোটা রাজ্য জুড়ে। ক্রমে রাজ্যের সীমানা পেরিয়ে দেশ তথা বিশ্বজুড়ে। বিশ্বায়নের এও এক আশ্চর্য দিক। এই ভাবেই নৈহাটির বড়মা হয়ে ওঠেন জগতের বড়মা। যার মূল মন্ত্র হয়ে ওঠে, " ধর্ম হোক যার যার, বড়মা সবার"! সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য উদাহরণ। বড় মায়ের বর্তমান মন্দিরের গায়ে খোদিত এই লেখা দেখে, কিছু কট্টরবাদী অবশ্য সোশ্যাল মিডিয়াতেই 'খাপ' বসিয়েছে!  তাতে বড়মা'র কোটি কোটি ভক্তদের কিছু যায় আসে না। কারণ, যতই কট্টরপন্থীরা মাথাচাড়া দিক। এই উপমহাদেশের কোটি কোটি মানুষ আসলে আজও বহুত্ববাদেই বিশ্বাস রাখেন। বড়মা'ও বোধহয় তাই'ই চান। কারণ, মা তো তাঁর সন্তানদের মধ্যে বিভেদ চায় না, তাই না?

 

 

অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে, ভবেশ চক্রবর্তী'র হাতে প্রতিষ্ঠিত যে পুজো ছিল একদিনের। (কেবল, কালীপুজোর রাতেই পুজো হত। পরেরদিন ভোরেই বিসর্জন হত।)  সেই পুজো কীভাবে  সারাবছরের কংক্রিটের মন্দিরে পরিণত হল? এর পিছনে রয়েছে বহুমানুষের অপরিসীম পরিশ্রম এবং সর্বোপরি মায়ের ভক্তদের দান। নৈহাটি অরবিন্দ রোডে যে স্থানে বড়মা'র মাটির মূর্তি গড়ে পুজো হয়, তার অনতিদূরেই ছিল একটি 'ধর্মশালা'। সেই  পরিত্যক্ত ধর্মশালায় বহুদিন ধরেই নানা অসামাজিক কার্যক্রলাপ চলত। প্রাথমিকভাবে, স্থানীয় কিছু ব্যক্তি এবং নৈহাটি পৌরপ্রশাসন এবং স্থানীয় তৎকালীন বিধায়ক বর্তমানে ব্যারাকপুরের সাংসদ পার্থ ভৌমিকের চেষ্টায় ওই ধর্মশালায়  অসামাজিক কর্মকান্ড বন্ধ করে, সামান্য খানিকটা সংস্কার করে বড়মায়ের ছবি রেখে মায়ের নিত্যপুজো শুরু হয়। কারণ, বহু বছর ধরেই মায়ের ভক্তদের ইচ্ছা ছিল, যদি মায়ের একটি সারা বছরের মন্দির করা যায়। সেই ইচ্ছাকে মান্যতা দিয়েই ওই ছবিতে পুজোর মধ্যে দিয়েই শুরু হয় মায়ের সারা বছরের নিত্যপুজো।

 

 

এসবই আজ থেকে প্রায় এক দশক আগের ঘটনা। এরপরের দশ বছরে মায়ের মাহাত্ম্য ছড়াতে থাকে ঝড়ের গতিবেগে! সেই পরিত্যক্ত ধর্মশালার মালিকদের সাথে দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার পরে অবশেষে ওই জমি হাতে পায় 'নৈহাটি বড়মা ট্রাস্টি'। ধর্মশালার জমি হাতে আসার পরে, সেই জমিতেই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে মন্দির। ভিড় বাড়তে থাকে ভক্তদের। অবশেষে গত বছর প্রতিষ্ঠিত হয়, বড়মায়ের কোষ্ঠীপাথরের মূর্তি। এই বিরাট কর্মযজ্ঞের বিপুল অর্থের  পুরোটাই কিন্তু এসেছে ভক্তদের দানের থেকেই। আর এই সমস্ত কিছুর মধ্যে, যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হল স্থানীয় অর্থনীতি। নৈহাটি অরবিন্দ রোডের যেসব শাড়ি, জামা, প্যান্টের দোকান ছিল, সেগুলো রাতারাতি বদলে হয়েছে ডালার দোকান। সর্বনিম্ন ডালার দাম ১০০ টাকা। সবচেয়ে বেশি ২০০০ টাকারও আছে! কেউ দোকানের সামনে জুতো জমা রেখে আয় করছে। কেউ বাড়ির সামনে পার্কিং হিসেবে ব্যবহার করে টাকা নিচ্ছে। নিরামিষ কচুরি, নিরামিষ থালির দোকানগুলোতে ভিড় উপচে পরছে! সবার মুখেই হাসি।

 

 

নৈহাটির পার্শ্ববর্তী এলাকা হাজিনগরের ছেলে জাহিদ-সাব্বির'রা টোটো চালায় নৈহাটি স্টেশন রোডে। জাহিদের সাথে কথা হচ্ছিল, বলছিল "শনি, মঙ্গলবার আর এই শীতের সময়ে তো প্রায় রোজই প্রচুর টিপ্ মারি। দূর দূর থেকে লোকে আসে! স্টেশন থেকে বড়মার মন্দির একদম কাছেই, তাও লোকে টোটোতে ওঠে। আমরাও ভাড়া মারি। খারাপ ইনকাম হয় না, ছেলেটাকে এবার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করিয়েছি!

 

 

শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল 'ধর্ম হোক যার যার, বড়মা সবার' কথাটার সার্থকতা তো এখানেই! যেখানে মায়ের কৃপায় হাসি ফোটে জাহিদ সাব্বিরদের পরিবারেও।  এই অস্থির সময়ে, এই কট্টরপন্থীদের আগ্রাসনের সময়ে আরও বেশি করে যেন, এমন বাক্যের অনুরণন হয়।

  • শমিত ঘোষ