ধ্যানমগ্ন কবির নিশ্চিত ঘেরাটোপে কখনও নিজেকে তিনি আবদ্ধ করেননি। কবিতার ধনুকে জ্যা রোপনে কখনও এটা তিনি ভাবেননি যে, তীর যদি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে যায়, জাগতিক লাভ-ক্ষতির হিসেব-নিকেশ পাল্টে যেতে পারে। 'হিসেব' থেকে দূরে থেকে জীবনকে হাত পেতে, চেটে পুটে যাপন করে গেলেন কবি অরুণ চক্রবর্তী--
'এই ধ্যান, এই নিমগ্ন প্রণাম তছনছ করে, কে কাঁদালো,
কে ডাকলো, ওরুণ, ও…রু…ণ
এমন কান্নার স্বরে কেন এই ডাক এলো…’
‘লাল পাহাড়ির দেশে যা’ -র স্রষ্টা অরুণকুমার চক্রবর্তী শাল, মহুয়া, পিয়াল, পলাশ, করমের পাতা পেরিয়ে চলে গেলেন। চলে কি গেলেন! মনে হয় ওই তো অরণ্যচারী বাউল ওরুণ সমতল ছেড়ে কদিনের জন্য পাহাড়ের দিকে চলে গেছেন; নির্জন লাবণ্যে স্নান করে আবার ধ্যানস্থ হবে নতুন সৃষ্টির জন্য, সুনদ্ধ সঙ্গীতের জন্য, কবিতার জন্য…
‘ওরুণ’ চক্রবর্তী মানেই সকালের কাছে ভীষণ পরিচিত লাল পাঞ্জাবী কাঁধে ঝোলা ব্যাগ মাথায় রঙিন রুমাল আর পকেট ভরতি চকোলেট। দেখা হলে সকলকেই দিতেন চকোলেট। মনে হত কলকাতার সান্তা ক্লজ হেঁটে যাচ্ছে ছোটোদের হাতে চকোলেট দিতে দিতে।
অরুণ চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ সেপ্টেম্বর কলকাতার বাগবাজারে। ১৯৭২ সালে শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন। ছোটোবেলা থেকেই কবিতা লেখার নেশা ছিল, ১৯৭০ সালে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘বাগানে কি ধরেছিলে হাত’ কবিতার চার লাইন অরুণ চক্রবর্তীকে ভাবিয়েছিল।
‘এবার হলো না তবু ছুটি
দুলে ওঠে মোরগের ঝুঁটি
বেলা গেলো– বুকে রক্তপাত
বাগানে কি ধরেছিলে হাত
বাগানে কি ধরেছিলে হাত?’
তিনি মনে করতেন ইঞ্জিনিয়ারিং যেমন বিজ্ঞান তেমনি কবিতাও বিজ্ঞান। কবিতার চার লাইন নিয়ে এক আড্ডায় বলেছিলেন, ‘বাগানে কি ধরেছিলে হাত?’ এই হাত শব্দটায় তিনটি ভাইব্রেশান আছে ‘হ’, ‘আ’, ‘ত’ যদি হ= v1ধরা হয়, আ=v2, এবং ত=v3 ধরা হয় তাহলে v1+v2+v3 এই তিনটি ভাইব্রেশান নিয়ে ‘হাত’ হচ্ছে।
১৯৬০-৬২ সাল নাগাদ চন্দননগর কানাইলাল দত্ত বিদ্যামন্দিরের মাষ্টারমশায় নন্দদুলাল চট্টোপাধ্যায়ের কাছেই প্রথম কবি জয়দেবের ‘গীত গোবিন্দম’-এর সম্পর্কে জানতে পারেন।
‘নিন্দসি যজ্ঞবিধেরহহ শ্রুতিজাতম |
সদয়হৃদয়-দর্শিত-পশুঘাতম্ ||
কেশব ধৃত-বুদ্ধশরীর জয় জগদীশ হরে ||৯||’
এই শ্লোক থেকেই প্রথম বাউলের প্রেমে পড়া। সুদীর্ঘ ষাট বছর প্রকৃত বাউল সন্ধানে ঘুরে বেরিয়েছেন। মাত্র তিনটি প্রকৃত বাউলের সন্ধান পেয়েছিলেন। বাউল সাধনা কঠিন সাধনা। শারীরিক নয় মানসিক রমণ, দেহ থেকে দেহাতীত হয়ে যাওয়া অপূর্ব আনন্দময়। সবাই পারে না। বাউল না হয়ে শুধু গায়ক হয়ে যায়। যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে জীবন জীবিকার তাগিদে নকল বাউলের ছড়াছড়ি, প্রকৃত বাউলের দেখা মেলা ভার।
‘বাইরের হাওয়া কি করে ভেতরে পৌঁছবে
ভেতর তখন ছুটছে আরও, আরও আরও
ভেতর ঘরে
ঘর পেরিয়ে, ঘর পেরিয়ে ঘর পেরিয়ে
শেষ ঘরটি
অনন্ত
সেখানে থাকেন মানের মানুষ
মন ফুটলেই বসন্ত’
‘ওরুণ’ আসলে ‘একটা মনের মতো ছাতা খুঁজছিল। এই দীর্ঘ পথ, ঠোক্কর খেতে খেতে সে জেনেছে ছাতা থাকলে বুকে বল বাড়ে, সাহস বাড়ে- প্রতিপত্তিও বাড়ে হয়তবা। অমুকের কাছে যা অন্যায়, তমুকের কাছে যা ন্যায় অথবা তমুকের কাছে যা অন্যায়, অমুকের কাছে যা ন্যায়- যা সে করে ফেলতেই পারে, রক্তমাংসের মানুষ তো, ছাতা তাকে বাঁচাবে।’ বাউলেই ঘর বাঁধলেন। মনের ঘর। মনের মতো ছাতা। ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলার মানুষের মনের ভেতর ঘর করে নিয়েছে ‘লালা পাহাড়ির দেশে যা’।
‘মৃত মুখে হাসে শেষ বেলাটির আলো
এবার আগুন তাকেই কামড়ে খাবে
অবয়ব যার হৃদয়ে অন্তরীন
স্মৃতি উড়ে এসে স্মৃতিকেই চমকালো…’
সম্ভাব্য বেদনার পাশে যে বাতাস নম্র চঞ্চলা, উড়ন্ত কথা-গান, বর্ণাঢ্য মেঘবালিকা-আলেয়াকুসুম কিভাবে আগলে নেবে অনন্তের মায়ারাজপথ? হৃদিপদ্মে পাথরবন্দী কথারা মৃত্যুর থেকে উঠে আসছে।
‘শূন্য-পূরণ শূন্য পুরণ
বিশ্বকালীন খেলা
কখন ফাগুন ক’জন আগুন
সৎগুণা আল্বেলা…’
তবে কি সময় হল, … তিয়াসার ধ্যান! ‘বড়ো নৈঃশব্দে বেড়ে ওঠা ধ্যান ও ধ্যানের উৎসব, আলো অন্ধকার, আমাদের জীবনযাপন ক্ষন যে রাঙালো, যারা জানে, তারা জানে; আর যারা জানলো না, জানতে পারলো না, তাঁদের জন্য কোনও অভিযোগ নেই, নেই কোনও ঘৃণা বা করুণা, তাঁদের জন্যে এক আকাশ ভালোবাসা রেখে যেতে চাই- ওগো মানুষ বাউল…’
অরুণ চক্রবর্তী ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসত। ট্রেকিং, ক্যাম্প, হিমালয়ের অপূর্ব নৈঃশব্দ তাঁর বড্ড প্রিয়। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়িয়েছে একা একা, কিসের টানে বারবার ছুটে যেতেন! অরণ্যবালিকার জন্য!
‘ওই যে পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে, তাই তো যাওয়া,
মেঘের দেশে ঝুপুরঝুপুর বরফগুঁড়ি মাখতে যাওয়া
কিংবা ধরো বুগিয়ালের সবুজ কাঁথায় আমরা দুজন,
আমরা দুজন গড়িয়ে যাচ্ছি, গড়িয়ে যাচ্ছি,
উদ্লা বুকে ছড়িয়ে দিচ্ছি জেন্সিয়ানা বুনো গোলাপ
বন্যখুশির খুশিয়ালে আমরা দুজন আমরা দুজন
বুগিয়ালের সবুজ কাঁথায় গড়িয়ে যাচ্ছি গড়িয়ে যাচ্ছি
চিরকালীন উপত্যকায় নীলকমলটি ফুটিয়ে দিচ্ছি
ফাটিয়ে বরফ জলের ঘোড়া টগ্বগিয়ে
দে-ছুট, দে ছুট্ সাগর যাবে
ব্রহ্মকমল তুলতে যাবো সঙ্গী হবে?’
ওই তো ওরুণ কেন্দুলি মেলায় … শান্ত সমাচ্ছন্ন নির্জন কবিতার বাগানে দাঁড়িয়ে বলছে
‘লালনে পালনে রাখিস লালনে
নইলে দেখবি জীবন কেমনে
নইলে চিনবি মানুষ কেমনে
লালনে পালনে রাখিস লালনে…’
অরুণ চক্রবর্তী অমর হয়ে থেকে যাবেন। কবিতার জন্য, গানের জন্য…
‘যত্ন করে বুকে রাখি এই গান, আমাদের
কোথায় নিয়ে যাবে ? জরুরী বাতাস হয়ে
রক্তের ভেতরে মিশে যাবে?
…………
অলক্ষ্যে এক বাউল দোতারা বাজায়…’