“আজ আপনাদের একটা গল্প বলব।“ আমি বললাম।
“বলবেনই তো”, শ্রোতারা বললেন। “টিকিট কেটে কি আমরা আপনার মুখ দেখতে এসেছি?”
“আহা চটছেন কেন? আপনাদের দুঃখটা বুঝি। আমাদের ছেলেবেলায় গল্প শুনেছি ঠাকুমা দিদিমার কাছে। এখন তো সব বাবা-মা, এক সন্তানের পরিবার, গল্প বলবে কে? পাড়াভর্তি এখন বৃদ্ধাশ্রম, ছেলেমেয়ে সব বিদেশে থাকে। ওদেরও একই দশা হবে…”
“ওসব জ্ঞানের কথা শুনতে আসিনি মশাই”, শ্রোতারা অধৈর্য। “গল্প বলুন”।
“গল্পই তো বলছি, আমার আপনার গল্প।‘’
“এসব গল্প নাকি? সাসপেন্স কই?”
“আচ্ছা, শুনুন তবে”। এই বলে আমি অন্য একটা গল্প শুরু করি:
“একটা গরু গাছের নীচে ঘাস খাচ্ছিল। বেশ নরম কচি ঘাস, আরামে চোখ বন্ধ করে গরুটা ঘাস ছিঁড়ছে আর অল্প চিবিয়ে জমিয়ে রাখছে পেটের ভেতর। সন্ধ্যেবেলা জাবর কাটবে। এমন সময়ে বাঁদর এসে খবর দিল: পালাও, বাঘ আসছে।
সেই শুনে গরুটা তো বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে ল্যাজ তুলে কিছুটা গোবর ত্যাগ করে ফেলল। ‘কোন দিকে পালাই বলো তো’, জিজ্ঞেস করল বাঁদরকেই।
পালাতে পারবে না, সে খুব কাছেই এসে পড়েছে। যে-দিকেই যাও, তোমার ঘাড়ের উপর লাফিয়ে পড়তে বাঘবাহাদুরের বেগ পেতে হবে না খুব একটা। তুমি বরং এই গাছটাতেই উঠে পড়ো। বাঁদরের পরামর্শ।
এত কথা বলতে বলতে বাঘ তো আরও কাছে এসে পড়েছে। কী আর করা, গরুটা গাছেই উঠে পড়ল। তারপর এক্কেবারে মগডালে গুচ্ছগুচ্ছ পাতার আড়ালে চুপটি করে লুকিয়ে রইল। এদিকে বাঘ তো গরুর গন্ধ পেয়ে এদিকেই আসছিল, গাছে্র কাছে এসে দেখে সব ভোঁ ভাঁ। কেবল এক তাল গোবর পড়ে আছে। বাঁদরটা আশেপাশেই তিড়িং বিড়িং ক’রে লাফিয়ে বেড়াচ্ছিল। তাকে দেখতে পেয়ে বাঘ জিজ্ঞেস করল: এদিকে একটা গরুকে দেখেছ? বাঁদর বলল, না তো, আমি তো কোনও গরুকে দেখিনি, আর তাকে আপনার আসার খবরও দিইনি। আপনার একটা সাক্ষাৎকার নিতে পারি?
আজকে আমার মন ভালো নেই — এই বলে হতাশ বাঘ কিছুক্ষণ পায়চারি ক’রে গাছের নীচেই বসে পড়ল।
এদিকে দীর্ঘক্ষণ কিছু একটা ছিঁড়তে না পেরে গরুটা উসখুস শুরু করে দিল। তার উপর মুখের চারপাশে রাশি রাশি সবুজ পাতা। আর থাকতে না-পেরে কচাম্ ক’রে খানিক পাতা ছিঁড়ে মুখের ভেতর চালান ক’রে দিল। তার ফলে গাছের ডালপালাও দুলে উঠল হঠাৎ। আওয়াজ পেয়ে বাঘটা তো উপরে তাকিয়েই বুঝতে পেরে গেল শিকার লুকিয়ে আছে মগডালে। আনন্দে সে ডেকে উঠল —হালুম। তার মানে হচ্ছে, ওরে গরু, এবার তোকে পেলুম।
বাঘ তো গাছে উঠতে ওস্তাদ। প্রথমে লাফ দিয়ে একটা ডালে উঠে পড়তে চেষ্টা করল। এরকম কয়েকবার। না পেরে চারপায়ের থাবা দিয়ে জড়িয়ে ধরে গাছের মোটা কাণ্ডটা পেরিয়ে গেল। তারপর এই ডাল ওই ডাল করতে যেই না মগডালের কাছে পৌঁছেছে, অমনি…”
এতদূর বলে আমি একটু জল খাব বলে থামলুম। অধৈর্য হয়ে শ্রোতারা বললেন — “অমনি?”
কোনওমতে গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে আবার বলতে শুরু করলুম:
“অমনি ভয়ের চোটে গরুটা গাছের মগডাল থেকে মাটিতে পড়ে গেল। বাঘটা লাফ দিয়ে গাছ থেকে গরুটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। অত উঁচু থেকে পড়ে গিয়ে আধমরা তো হয়েই ছিল, ঘাড় মটকে গরুটার ভবলীলা সাঙ্গ করে দিতে বাঘের আর বেশি কষ্ট করতে হল না। বাঘটা গরুটাকে খেয়ে ফেলল।”
এতক্ষণ সবাই বেশ চুপ করেই শুনছিলেন। গল্পটা শেষ হতেই একজন বিরক্তির সুরে বলেন, “ধুর মশাই, বাজে গল্প একটা”।
আমি বললুম, “কেন, কেন শুনি?”
“গরু কি গাছে উঠতে পারে?”
“গল্পের গরু পারে”, আমার জবাব। “তাছাড়া গাছে না-উঠলে তো আগেই বাঘটা গরুটাকে খেয়ে ফেলত। তার চেয়ে এটাই ভালো হল না কি, কিছু সময় বেশি বাঁচল গরুটা।”
“না না, তা ব’লে পয়সা নিয়ে এইসব গাঁজাখুরি গল্প শোনাবেন আমাদের? ইয়ার্কি পেয়েছেন?”
“আরে মশাই গল্প মানেই তো গাঁজাখুরি। তাছাড়া আমি তো সত্যি গল্প বলছিলুম প্রথমে, আপনারাই শুনতে চাইলেন না। তাছাড়া গরুর গাছে ওঠাতে আপত্তি থাকলে প্রথমেই বললেন না কেন?”
“তখন মশাই খেয়াল ছিল না। তাছাড়া শেষটায় কী হয় দেখাই যাক — এইসব ভাবলাম আমরা। যাই হোক, এর চেয়ে ওই গল্পটা ভালো।”
“কোন গল্পটা বলুন তো?”— আমি জানতে চাইলুম।
“ওই যে, রাখাল আর গরুর পালের গল্পটা। রাখালটা রোজ মিথ্যে ক’রে পালে বাঘ পড়েছে বলে চেঁচাত। সবাই এসে দেখত— কিচ্ছু না। তারপর একদিন পালে সত্যিই বাঘ পড়ল। কিন্তু এবার আর রাখালের চিৎকারে কেউ এল না। তখন বাঘ রাখালের ঘাড় মটকে খেয়ে ফেলল।”
“ওহ, আপনারা ওই গল্পটা জানেন দেখছি। যাই হোক, গল্পটা পুরো সত্যি নয়। রাখাল সেদিন মরেনি। বাঘটা একটা গরুকেই ঘাড় মটকে টানতে টানতে বনের মধ্যে নিয়ে গেছিল, সেখানে তার গিন্নি অপেক্ষায় করছিল। কিন্তু রাখাল সেই বিপজ্জনক কাজটা এখন ছেড়ে দিয়েছে।”
“তাহলে গরুদের এখন দেখাশোনা করে কে?”
“কেউ না। ওরা আপন মনে মাঠে মাঠে চরে বেড়ায়, ঘাস খায়। আর এক একদিন এক একজন বাঘের পেটে যায়।”
“আর রাখাল কী করে এখন?” শ্রোতাদের কৌতুহল মেটে না।
“সে এখন গল্প বলে”।