গ্রামীণ ভারত আজও আমাদের কাছে অনেকটাই অজানা। তাই বিস্ময়, আগ্রহ আর কৌতুহলের শেষ সেই সেই বৈচিত্রের গহীন সন্ধানে। দুঃখ-দারিদ্র -এসবের মধ্যেও রেশ রেখে যায় ভালবাসার, সে রেশ আমার দশের পরশ-
- রাম রাম ডক্টর সাব।
- রাম রাম চাচা।
- অউর ক্যায়া হাল হ্যায়?
হালের কথা কী বলি। নিজের ভাষা থেকে ছিন্ন হয়ে, নিজের স্বাচ্ছন্দ্য থেকে সরে এসে পেটের তাড়নায় এই 'রাম রাজত্বে' আসা। মুচকি হেসে বলি -সব ঠিক হ্যায় গুরুজি। আপকা শুনাইয়ে। ঘর মালিকের সঙ্গে এই সৌজন্যতা দিয়ে শুরু হয় সকাল।
গ্রামের নাম পুরা গম্ভীর শাহ। লোকমুখে গামেরিয়া। জৌনপুর জেলার বাদলাপুর শহর থেকে বাইকে মিনিট দশেকের পথ। পথের দু’পাশে বিস্তীর্ণ ঘাসজমি কাশফুলে সাদা হয়ে আছে। শরৎ-এর আকাশ যেন নেমে এসেছে এই দেবভূমে। কাচ্চা বাচ্চা সমেত একদল নীল গাই চড়ে বেরাচ্ছে আপন খেয়ালে। দেবীর আগমনের সুর বেজে উঠছে এসময় পশ্চিমবঙ্গে। কী এক ব্যথায় বুক ভারী হয়ে এলো। মেইন রাস্তার পাশে দশ বারোটা দোকান নিয়ে গড়ে উঠেছে গ্রামীণ বাজার। এই বাজারের ওপর দশ ফিট বাই পনেরো ফিটের ঘর আমার। একটু ভয়ে ভয়ে থাকি রাতের বেলায়। গ্রাম এখান থেকে বেশ খানিকটা দূরে। বাজার সংলগ্ন দু-একটা ঘর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে না থাকার মতোই। এছাড়া রয়েছে সাপ, নীলগাই, কাঁকড়াবিছের উৎপাত। জঙ্গল কেটে এই বাজার গড়ে উঠেছিল। ফলে গৃহহারাদের আনাগোনা খুব স্বাভাবিক।
কর্মসূত্রে এখানে এসে সর্বপ্রথমেই যে সমস্যার সম্মুখীন হতে হলো - তা ভাষা। তবে হিন্দি ভাষা আয়ত্তে থাকার ফলে এই সমস্যা কিছুটা লাঘব হলেও, গ্রামের প্রবীণ মানুষদের সঙ্গে কথোপকথনের সমস্যা থেকেই গেল। তারা হিন্দী বুঝলেও বলতে পারে না। তাদের ভাষা অবধী। উত্তরপ্রদেশের উনিশটি জেলায় এই ভাষার ব্যবহার রয়েছে। এছাড়াও আরও সাতটি জেলা -জৌনপুর, মির্জাপুর, কানপুর, শাহাজাঁহাপুর, আজমগড়, সিদ্ধার্থনগর, বস্তী ও বান্দাতেও এই অবধী ভাষাতেই কথা বলা হয়। ফলে ভাষার প্রতিবন্ধকতার দরুন ইশারা দিয়েই প্রথম কাজ চালাতে হতো। ইশারা এমন এক শব্দহীন ভাষা -যা দেশ কাল সময়ের ঊর্ধ্বে মানুষকে বেঁধে রেখেছে। খিদের ভাষাও বুঝি তাই।
ঘরের পিছনেই ইঁটভাটা। ইঁটভাটার সমস্ত শ্রমিক বিহার, ঝাড়খন্ডের। খুব অল্প মজুরির বিনিময়ে এরা দিনভর কাজ করে জল, কাদা, আগুনের ভেতর। তিনবছরের একটা বাচ্চাছেলে কাদা মাটির ভেতর বসে কাঁদছে কখন থেকে। ভ্রুক্ষেপহীন বাবা ,মা ইঁট বানাচ্ছে পাশে। সন্ধ্যায় হিসেব হবে। যত ইঁট তত বেশি টাকা। ক্ষিদে এমনই প্রতারক, মাতৃস্নেহ, পিতৃস্নেহ মুছে ফেলে। এভাবেই উপেক্ষার ভেতর, ধুলোবালির ভেতর গড়াতে গড়াতে একদিন ঐ শিশুটিও বড়ো হয়ে যাবে। দৈনিক দুশো-তিনশোর বিনিময়ে ঠিকাদার কিনে নেবে ওদের জীবন। এখানকার অধিকাংশ সাধারণ মানুষ কৃষি ও পশুপালনের ওপর নির্ভরশীল। খুব সকালে উঠে গরু মোষের দুধ সংগ্রহ করে তারা চলে যায় ডেয়ারিতে। এখানে প্রায় প্রত্যেকটা গ্রামেই ডেয়ারির ব্যবস্থা রয়েছে। অপারেশন ফ্লাডের পর তাদের আর দুধ বিক্রির জন্য চিন্তা করতে হয় না। কখনও কখনও গ্রাম থেকে ফোন আসে - ডক্টর সাব গাঁওমে আইয়ে, তবিয়ৎ বহুত খারাব হ্যায়। যেহেতু গ্রামগুলি দূরে দূরে ফলে বয়স্ক মানুষদের যাতায়াতের একটু সমস্যা হয়। আমাকেই পৌঁছাতে হয় তখন তাদের কাছে। ডাক্তারি ব্যাগটা কাঁধে তুলে বেরিয়ে পড়ি বাইক নিয়ে। ঠাকুর পন্ডিতদের বসতি পেরিয়ে বাইক ছুটে চলে। পাশীদের গ্রামে যাবো। এখানে কেবলমাত্র পাশী সম্প্রদায়ের বাস। নীচু জাত। জাতপাতের বিভেদ এখানেও বসবাসের ওপরেও প্রভাব ফেলেছে। ভিন্ন ভিন্নজাত সম্প্রদায়ের ওপর ভিত্তি করে বিচ্ছিন্ন ভাবে গড়ে উঠেছে তাদের বসবাসের ভূমিও। মূলত ঠাকুর, পন্ডিত, পাশী, কেওট, চামার, ধোবী, কাহার, কোহার এই সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস আমার চারপাশে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একে অপরের ঘরে এদের আনাগোণা ইদানীং শুরু হলেও উঁচু জাতের মানুষেরা আজও নীচু জাতের ঘরের অন্ন স্পর্শ করে না। ডাক্তারির সুবাদে আমাকে সবার ঘরেই যেতে হয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডাক পেলে যেতে হয়। একবার এমনই এক অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় ঘর মালিক ডেকে বললেন -ডক্টর সাব পাশীয়ানেমে নেওতা হ্যায় যাইয়ে লেকিন খানা নেহি কুছ। ও লোগ ছোটা জাত কা হ্যায়। ভাগ্যিস এরা আমার জাত জিজ্ঞেস করেনি। নচেৎ এই তপশিলীকে পন্ডিতের ঘর ভাড়া দিত কিনা সন্দেহ হয়। ভাবি জিজ্ঞেস করি - ছোটা জাত ক্যায়া হোতা হ্যায় পন্ডিতজি? উধার খানেকে বাদ হামার খুন কালা পড় যায়েগা ক্যায়া?
সেদিন আমি খেয়েছিলাম সেই বাড়িতে। ঝাল ঝাল পাঁঠার মাংস আর রুটি। তৃপ্তি হয়েছিল। ওদের মাঝখানে বসে হাসিঠাট্টার মধ্যে কখন যেন ওদেরই একজন হয়ে গেছি আমিও। ফেরার সময় আমার মেয়ে আর বউয়ের জন্যও খাবার প্যাকেট করে সঙ্গে দিয়ে দিল ওরা। ঘর মালিকের কানে কোনওভাবে পৌছে গিয়েছিল এই খবরটা। বেশ কয়েকদিন আমার সঙ্গে কথা বলেননি ভদ্রলোক।
এই গ্রামের মাঝখানেই রয়েছে একটা ছোট্টো জলাভূমি। এখানকার মানুষেরা পাখি শিকার করে না। তাই শীতের শুরুতে ও বর্ষায় অনেক রকম পাখি এসে ভিড় করে। শামুকখোলা, বালি হাঁস, সারস, ডাহুক, বকের দেখা পাওয়া যায় তখন এই জলাভূমিতে। গ্রীষ্মকালে জল কমে এলে পাশীদের পুরো গ্রাম এসে ভিড় করে এখানে। জল সেচে মাছ ধরার এক উৎসব শুরু হয়ে যায় তখন। পাশীদের পুরো গ্রাম পায় সেই মাছের ভাগ। আমার ঘরেও আসে ভালোবাসার একব্যাগ উপহার। শীত আসার আগেই শুরু হয়ে গেছে ধান কাটা। এরপর আলুর বীজ লাগানোর কাজ শুরু হবে। ঘরের বউ ছেলে মেয়ে সবাই এসেছে মাঠে। ধান কাটার আনন্দে বুঁদ হয়ে আছে গোটা গ্রাম। এখানে ধান গম লাগানোর সময় এবং কাটাইয়ের সময় গ্রামের মহিলারা একত্রিত হয়ে মাঠে আসে। গান শুরু হয়। ফসল বোনার গান - কোহারাউয়া। ঈশ্বরের কাছে তারা প্রার্থনা করে ভালো ফসলের। গানের তালে তালে চলে বীজ বপণের কাজ। এক নৈসর্গিক আবহ ছড়িয়ে পড়ে মাঠ ও মানুষের সম্পর্কের ভেতরে। উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন পুরাতন ঐতিহ্যগুলির মধ্যে এখানকার লোকগীতি একটা বিশাল জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে সামাজিক স্তরে। সামাজিক ও ধর্মীয় কথা ও কাহিনির ওপর নির্মিত হয়েছে এই সমস্ত লোকগীতি। রসিয়া, সোহর, কাজরী, কাহারবা, ভজন, চৈতি বা চৈতা -এই সমস্ত লোকগীতিগুলো ছড়িয়ে রয়েছে উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন প্রান্তে। সোহর মূলত প্রসবকালীন সংগীত। নতুন প্রানের আগমনে জীবনকে শুভেচ্ছা জানানোর উদ্দেশ্যে গ্রামের মহিলারা একত্রিত হয়ে এই গান গেয়ে থাকেন। গ্রামাঞ্চলেই এই প্রাচীন ঐতিহ্যের চর্চা বেশি দেখা যায়। লোকনৃত্যের গানের মধ্যে রয়েছে চনয়নী। বিভিন্ন সামাজিক ও শুভ কাজে এই নাচ ও গানের পরিবেশন করা হয়ে থাকে। জনপ্রিয় তাল কাহারবার উৎপত্তিস্হলও এই প্রদেশ। কাওয়ালি ও ধূমালি গানে এই তালের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। চৈতি বা চৈতা একটি সেমি ক্ল্যাসিকাল গান। যা মূলত মার্চ এপ্রিল মাসে রাম নবমীর পূণ্য তিথিতে গাওয়া হয়ে থাকে। এছাড়াও ঋতুভিত্তিক গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাজরী, হোরী,শাওনী।
আজ থেকে দশ-বারো বছর আগে এই গ্রামগুলোর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার যে দৈন্য দশা ছিল -আজ তার অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে ছেলেমেয়েদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত যদিও বিভিন্ন সামাজিক দিক থেকে মেয়েরা আজও অনেক বাধা নিষেধের আড়ালে। শহরের দিকে মেয়েদের ঘোরাফেরার স্বাচ্ছন্দ্য থাকলেও, গ্রামের দিকে আজও অন্ধকার আচ্ছন্ন হয়ে আছে। হিন্দি সিনেমার সৌজন্যে আমরা উত্তরপ্রদেশের যে চিত্র দেখি - তা অনেকাংশেই মনোরঞ্জনের খাতিরে বানানো। সিনেমায় যে হিংসা যে অস্থির সামাজিক চিত্র দেখে অভ্যস্ত আমরা উত্তরপ্রদেশের -এই চিত্র কোনও বিশেষ রাজ্য দিয়ে আটকে রাখা যায় না। প্রতিটি রাজ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এই রক্তবীজ। তবে কোথাও কোথাও তা একটু প্রকট। প্রথম শীতের হাওয়া দিচ্ছে। শেষ বিকেলের আলোয় মাঠ থেকে ঘরে ফিরছে মানুষ। একপাল ভেড়া ও ছাগল নিয়ে হেঁটে চলেছে এক বৃদ্ধ। কাঁধে লম্বা লাঠি। ঘরে ফেরা পাখিদের কলকাকলিতে সেজে উঠেছে পশ্চিমের আকাশ। মন কি সামান্য বিচলিত হল? ঘর শব্দের সঙ্গে মানুষের, প্রাণীর সকল সত্ত্বা জুড়ে আছে যেন। প্রতিদিন এত এত ফেরার দিকে তাকিয়ে থাকি। একঘেয়ে লাগে। যেন কেবলমাত্র লক্ষ্য করা ছাড়া এই শরীরের আর কোনও ক্রিয়া নেই। ট্যাংরাকলোনির ঘর, বাবা-মা, বন্ধু-বান্ধব, কবিতা, লিটল ম্যাগাজিন - কবে ফিরতে পারব এদের কাছে আমার সর্বস্ব নিয়ে। শূন্যের দিকে তাকিয়ে থাকি কেবল। ফেরা আর হয় না এই খিদে ও তার সংস্থান ছেড়ে।