বন্ধনহীন গ্রন্থিতে বাঁধা পথ ধরে এগিয়ে চলতে চলতে মনের গহীনে ভাসে 'সপ্তপদী' তে উত্তম-সুচিত্রার লিপে, হেমন্ত-সন্ধ্যার গাওয়া; এই পথ যদি না শেষ হয়' -পথ আমরা শেষ করতে কেউই চাই না। চরৈবতিই হল জীবনের ধর্ম-
আসন্ন শীতের শীতল হাওয়া আমায় প্রতিমুহূর্তে সচেতন করে দেয় ঋতু পরিবর্তনের সম্পর্কে। রাতের গভীর অন্ধকারে সুপ্তির তৃপ্তি নেমে আসার আগে আমি ফিরে যাই সুদূর অতীতে। মন্ট্রিয়ালের ইটঁকাঠের জঙ্গল, রাতের নিওন আলোর ঝলকানির মধ্যেও কেমন যেন মনে পরে যায় শান্তিনিকেতনের শীতের মিঠে কড়া রোদ্দুর। সকালে আম্রকুঞ্জে হালকা কুয়াশার চাদর ভেদ করে সুমনাদির ইংরেজি শ্রেণী পাঠে আরাম করে রোদে পিঠ দিয়ে বসা। বা পরে গৌরীদির শ্রেণীপাঠে ইংরেজির ব্যাকরণের জটিল ধাঁধা উপেক্ষা করে চলে যেত মন সত্যি কোনও গোয়েন্দা কাহিনীর রহস্য উদ্ঘাটনে। ছোটবেলা থেকে মি: ব্লেক, হুঁকাকাশি, ব্যোমকেশ বক্সী, কিরীটি রায় মায় মাসুদ রানা পর্যন্ত পড়তে পড়তে চলে যেতাম। বিকাশদা আমাদের প্রথম শার্লক হোল্মস এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেলেন।
তবে বিকাশদা আমাদের রোমান্টিক কবিতা পড়িয়েছিলেন। অসাধারণ প্রাঞ্জলতা এবং গভীরতার সঙ্গে ব্যাখ্যা করে দিয়েছিলেন রোমান্টিকতা কী? অষ্টাদশ শতাব্দীতে কেন রোমান্টিকতার বিকাশ ঘটেছিল। শিখিয়েছিলেন কবিতা কী করে পড়তে হয়? শুধু কবিতা পড়ার আনন্দে কবিতা পড়া নয় কবিতার ছন্দ, বাক্যবিন্যাসের বন্ধনী আর সেই সঙ্গে কবিতার চিত্রকল্পকে মনের রসে রাঙিয়ে উপলদ্ধি করা। সুপ্রিয়দা, জুলিয়াস সিজার পড়িয়েছিলেন। আমার বন্ধুরা, আশীষ বুখী (মুখোপাধ্যায়), সুপ্রিয় পাল, সুব্রত রায়, সুরঞ্জন ভঞ্জ, ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য্য, নীলাঞ্জন সুর এবং রথীন সাহা সবাই সেই নাটকে অভিনয় করেছিল। মৌসুমী হয়েছিল পোর্শিয়া, ব্রুটাসের স্ত্রী।
জীবনের পথে সেই সঞ্চয় আবার নতুন করে মনে এলো যখন আমি লন্ডনে থাকতাম বেকার স্ট্রিটে আমাদের জীবনের যুগলবন্দি পর্বে। ২২১ বি বেকার স্ট্রিট আমাদের তিনতলার খুপরি থেকে ছিল ২০০ গজ দূরে। আমি প্রায় লন্ডনে থাকালীন ভিক্টোরিয়ার যুগের লন্ডনের সন্ধানে বের হয়ে পড়তাম। খুঁজে বের করতাম সেই সমস্ত পুব যেখানে চার্লস ডিকেন্স মদিরা পান করতেন যদিও ডিকেন্স ভারতের ১৮৫৭ র মহাবিদ্রোহের পরে Angela Burdett-Coutts কে ৪ অক্টোবর লিখেছিলেন 'I wish I were the Commander in Chief in India. The first thing I would do to strike that Oriental race with amazement . . . " কিন্তু সে যুগের সেটাই ছিল দস্তুর। কালা আদমির সাহস কি শ্বেতাঙ্গ ইংরেজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। তাই রাসেল এর দ্রোহের দিনলিপি থেকে ইংরেজ সেনাপতিদের চিঠিপত্র বিনিময় সবই ছিল তথাকথিত 'এশিয়াটিক বারবারিসম' এর উপর কষাঘাত আর মুসলমানরা যে ধর্মান্ধ তা ইংরেজদের লেখায় প্রস্ফুট ছিল। কিন্তু ভারতীয়রা যে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে বিদ্রোহ করেছিলেন তা তাঁদের দৃষ্টিতে ছিল না আর তাঁদের বর্বরতা সব কিছ চাপিয়ে গিয়েছিল তাও তাদের অজানা ছিল না। সেই সময় ভারতে Mutiny ট্যুর সংগঠিত হত ব্রিটিশ পর্য্যটকদের জন্যে। আমার সহকর্মী সন্ধীপ বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমি একটি প্রবন্ধ রচনা করেছিলাম দিল্লির ঊনবিংশ শতাব্দীর ইতিহাস নিয়ে। জাপানের একটি মহাসম্মলনে পাঠের জন্যে। প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে গেছে এবং আমাদের কপালে প্রশংসা আর নিন্দে দুই জুটেছে। যায় হোক গল্পের গরু গাছে চড়লে হবে না। এস্টেলা আর পাইপার অসম প্রেম আমার কৈশোরের সম্পদ। বিরাট প্রত্যাশার লেখক চার্লস ডিকেন্সের পাবের সন্ধানে বের হতাম প্রায়। লন্ডনের কুয়াশাছন্ন ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে কভেন্ট গার্ডেনে পাবে গিয়ে একটু দামি স্কচ খেয়ে পুরোনো লন্ডনের ছমছমে রাস্তার বিশেষত জ্যাক দ্য রিপার এর সেই ভয়াবহ মহিলা যৌনকর্মীদের উপরে আক্রমণ আমি মানসিক চক্ষে অবলোকন করতাম। বোধহয় একটু sadomaschist প্রবণতা ছিল আমার কে জানে। কিন্তু তার আগে ইংল্যান্ডের পৌঁছানের পরে আমাদের আমন্ত্রনে সাংবাদিক এন রাম এসেছিলেন ডারউইন কলেজ কেমব্রিজ এ। অনিত ভট্টাচার্য্য ছিলেন স্থানীয় খ্যাতনামা ডাক্তার এবং তাঁর স্ত্রীও ছিলেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। তাঁদের বাড়ি ছিল লিন্টন গ্রামে কেমব্রিজএর পাশে। আমরা রাত্রে সে বাড়িতে গেলাম। এন রাম সেখানে থেকে চলে যাবেন নরউইচ তাঁর শ্বশুরকূলের বাড়িতে। এন রামের স্ত্রী ইংরেজ। পরদিন সকালে অনিতদা আমাদের নিয়ে গেলেন কনস্টেবল কান্ট্রি। সেই suffolk এর অঞ্চলে সত্যি সময় যেন থেমে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইংরেজ চিত্রকর কনস্টবল এর যুগে। জন কনস্টবল জন্মেছিলেন ১৭৭৬ সালে East Bergholt, বলে stour নদীর তীরে Suffolk এ. তিনি তাঁর ছবিতে suffolk এর গ্রামের চিত্র অমর করে তুলেছিলেন। বিশেষত তাঁর Hay Wain ছবিটিতে একটি ঘোড়ার গাড়ি নদী পার হচ্ছে ওপারে একটি সাদা কটেজ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। আমার সেই উদ্ভিন্ন শরতের কালে গিয়ে মনে পরে গেল সুপ্রিয়দের আবৃত্তি করা কবিতা কিট্স্ এর To Autumn
Who hath not seen thee oft amid thy store?
Sometimes whoever seeks abroad may find
Thee sitting careless on a granary floor,
Thy hair soft-lifted by the winnowing wind;
Or on a half-reap'd furrow sound asleep,
Drows'd with the fume of poppies, while thy hook
সুধীন দত্ত র একটি কবিতার সঙ্গে আমি এর মিল পাই।
সেদিনও এমনি ফসল বিলাসী হাওয়া
মেতেছিল তার চিকুরের পাকা ধানে
অনাদি কালের যত চাওয়া যত পাওয়া
খুঁজেছিল তার অনন্ত দিঠির মানে
একটি কথার দ্বিধা থরো থরো চূড়ে
ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী
একটি নিমেষ দাঁড়ালো সরনী জুড়ে
থামিল কালের চির চঞ্চল গতি
আমার কনস্টবল countryside এ গিয়ে মনে হয়েছিল কালের গতি স্তব্ধ হয়ে গেছে। সেরমই হেমন্তের একটি দিনে কেমব্রিজ এ বন্ধুবর সুগতর আহ্বানে গিয়ে দেখি সুকুমারীদি। সুকুমারীদি সংস্কৃত সাহিত্যের উপরে প্রাজ্ঞ লেখিকা এবং প্রাচীন ভারতের নারী সমাজ নিয়ে তাঁর গভীর চিন্তা তাঁর লেখায় স্বাক্ষর রেখেছে। সুকুমারীদির সঙ্গে আমার অসম বয়সী বন্ধুত্ব বেশ জমে উঠছিল। সুকুমারীদি আমার কিটস এর কবিতার সংশোধন করে কালিদাসের বর্ষা ঋতুর উপরে কবিতা থেকে আবৃত্তি করে শোনালেন। তার আমি ইংরেজি তরজমা পেশ করছি
Pitiless heat from heaven pours
By day, but nights are cool;
Continual bathing gently lowers
The water in the pool;
The evening brings a charming peace:
For summer-time is here
When love that never knows surcease,
Is less imperious, dear.
সুকুমারীদির সঙ্গে আড্ডা দিতে আমার আর সুগতর দারুন লাগতো। উনি ওনার ইংরেজ বন্ধুদের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আমি তখন পিটার বার্ক এর কেমব্রিজ ইম্মানুয়েল কলেজ এ আদি আধুনিক যুগের উপর শ্রেণীপাঠ করে সুমকুমারীদির কাছে ভারতের আদি যুগের কথা শুনতাম। আর ফিরে পেতাম শান্তিনিকেতনের শিক্ষা। তবে সুকুমারীদির কাছে একটি কথা রাখতে পারিনি দেশে ফেরত যেতে পারিনি। সুকুমারীদির কাছে অঙ্গীকার করেছিলাম হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে লড়ব, সে অঙ্গীকার খানিকটা কি ফিকে হয়ে গেছে? তাই রাতের সেই স্মৃতির চর্চায় ওনার কথা বলতে গিয়ে কি রকম যেন রণে ভঙ্গ দেবার স্মৃতি আসে মনে।
রোমান্টিক কবিতার মধ্যে আমার প্রিয় কবি ছিলেন বায়রন এবং ওয়ার্ডসওয়ার্থ। বিবাহের পরে আমরা দুজনে লেক ডিস্ট্রিক্ট গিয়েছি দাম্পত্য জীবনের বিলীয়মান প্রেম নতুন করে ঝালাতে। তখন আমাদের দুজনেরই বয়স অল্প। সেই সময় উইন্ডেরমেয়ারে খোলামাঠের উপরে শরতের হালকা বৃষ্টিস্নাত ভিজে নীল আকাশ দেখে দূরে জল আর ওয়ার্ডসওয়ার্থের বাড়ি দেখে কেমন যেন সেই কৈশোরে বিকাশদার পড়ানোর কথা মনে পড়ল
Ethereal minstrel! pilgrim of the sky!
Dost thou despise the earth where cares abound?
Or, while the wings aspire, are heart and eye
Both with thy nest upon the dewy ground?
Thy nest which thou canst drop into at will,
Those quivering wings composed, that music still!
সত্যি জীবনের বিভিন্ন পর্বে ঘুরতে গিয়ে সেই শৈশবের কথা মনে পরে গেছে। রোমান ফোরামে জুলিয়াস সিজারকে যেখানে দাহ করে হয়েছিলো বা যে বাড়িতে হত্যা করা হয়েছিল সেই বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে আমার পাঠভবনের জুলিয়াস সিজারের অভিনয়ের কথা মনে পরে গেল। জীবনের পথে সেই শৈশব, কৈশোর আর যৌবনে ইউরোপের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শনে অতীতের স্মৃতি বর্তমানে মিশে যায়। ইউরোপে আমি যতবার ভেনিস গেছি ততবার বিকাশদার বায়রনের জীবনী পড়ানো মনে পরে গেছে। বাইরনের ভেনিসের রঙিন উচ্ছৃঙ্খল জীবন তাঁর একের পর এক প্রেম সবই মনে পরে গেছে আর সেই সঙ্গে তার অমর সৃষ্টি
Oh Venice! Venice! when thy marble walls
Are level with the waters, there shall be
A cry of nations o'er thy sunken halls,
A loud lament along the sweeping sea!
If I, a northern wanderer, weep for thee,
What should thy sons do?--anything but weep
And yet they only murmur in their sleep.
আগের বার আমার ভেনিস গিয়ে মনে হয়েছিল আমি কেন বায়রন হলাম না। আমার জীবনের প্রেমের অভাব নেই কিন্তু অভিশাপও রয়েছে। তাই বায়রন আমার প্রিয় কবি। তবুও রাতের গভীরে পৃথিবীর পথে নানা জায়গা ঘুরতে ঘুরতে মনে পরে যায় আমার আর সুব্রতর হেঁটে হাঁসুলী বাক যাবার প্রয়াস। হেমন্তর সকালে নীল আকাশের নিচে রেল লাইন ধরে হেটে চলে গেছি কোপাই স্টেশনে। চারিদিকের ধানের ক্ষেতের সবুজের সংলাপ দিক্চক্রবাল ছুঁয়ে চলে গেছে। আমরা দুই কিশোর শুধু জীবনের প্রিয় উপন্যাসের জন্মভূমির সন্ধানে হেঁটে চলেছি চারিদিকের সৌন্দর্য্য পান করতে। তাই এই ষাট বৎসর বয়সে মন্ট্রিয়ালে হেমন্তের শীতার্ত রাতে সুপ্তির কোলে ঢলে পড়ার আগে মনে পরে যায় হেমন্ত কুমারের সেই গান। কোনও বান্ধবীকে নিয়ে সেই পথ চলা-