আলোর শহরের অন্ধকার রূপকথা

'যে আঁধার আলোর অধিক' কবির এই ভাবনা আজও আমাদের চেতনার বিন্দুগুলোকে ছুঁয়ে যায়। মনকে ভরে দেয় এক অনির্বচনীয় আনন্দে। আনন্দের স্রোতে ভাসাই তো জীবন। সেই জীবনের অন্বেষণই তো বেঁচে থাকা -

 

 

একটা ছোট্ট মিষ্টি শহরের গায়ে কয়েকদিনের যুদ্ধকালীন কর্মব্যস্ততায় আলোর পলেস্তারা পড়ে। আলোকসজ্জার জন্যই তার নাম দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশে। একটুখানি পথ, অনেকখানি আলো। চোখে মন্ত্রমুগ্ধ চমক নিয়ে এগোতে থাকে মানুষের ভিড়, পায়ে পায়ে ককিয়ে ওঠে নরম বুকের রাস্তা। তবে সে বিরক্ত হয় না এতটুকুও। কয়েকদিনের আলোর কিতাব থেকেই সে খুচরো আনন্দ কুড়িয়ে নেয়, সঞ্চয় করে রাখে অগ্রিম, শীতের হিমেল নিস্তব্ধতার মরসুমে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করবে বলে। আলোর কারিগরেরা এখন একটু ঝিমিয়ে নেয়, আবার তাঁদের প্রস্তুত হতে হবে নিজেদের সৃষ্টিকে একটু করে নষ্ট করে ফেলার জন্য। প্রশস্ত হাওয়া-বাতাসকে কয়েকদিন ঢেকে রাখার যে নাগরিক তৎপরতা, তাকেই মোকাবিলা করতে হবে কর্মমুখর দিনের সহস্র অভিঘাতে।

 

 

ছটফটে কয়েকটা পা এলোমেলো ঘুরে বেড়ায় রাজপথে। নিজস্ব পরিকল্পনা নেই, বরং ভিড়ে মিশে যেতেই তাদের উৎসাহ বেশি। কালেক্টিভ আনকনশাস। রংবেরং-এর পোশাক, রকমারি গড়ন হল্লা করে চলে। ফাস্টফুডের দোকানে ঘোরাফেরা করে পকেটের জোর। তারপর একটা পকোড়া, বড়জোর একটা আইসক্রিম। গল্প-আড্ডা-বকবকের রকমফের। রাতের শেষে হয়ত তিনটে ঠাকুরের কাছের শেষ অবধি পৌঁছেছে তাদের অভ্যেসের দৌড়, তবু, স্মৃতির অভ্যন্তরে লেখা থাকে বন্ধুত্বের অস্তরাগ।

 

 

কতরকমের ভিড় জমে। কেউ প্রতিমার মুখশ্রী-দর্শনে ব্যস্ত, কেউ বা প্যান্ডেলের কাঠামোয়। কেউ বা আবার ভুলচুক খুঁজে নেয় স্বভাবোচিত গাম্ভীর্যে। কেউ আবার শুধু দেখে চলে মানুষে মানুষে ঠাসবুনোট নগরীর কোলাহল, কেউ নিরালায় খুঁজে নেয় প্রিয়জনের নৈকট্য। একটা হাত আরেকটা হাতকে ধরে রাখে অস্থির আন্তরিকতায়, যাতে সরলরেখাতেও না কোনও বহিরাগত বিন্দু এসে সমান্তরতার শান্তিকে বিঘ্নিত করে।

 

 

দিনগুলো কেটে যায় ক্ষণিকেই। পুজোও একদিন শেষ হয় নিয়ম মেনে। ধোঁয়ার হলকায় ঢেকে যায় শ্রান্তির গভীরতম চোখ। যারা দেখতে পেল না এবারের আড়ম্বর, তাদের কাছে বিষাদ খুব বিস্বাদ ঠেকে না হয়ত। কিন্তু যারা পালা করে রাত জেগেছিল পায়ের ক্ষমতা মেপে নেবে বলে, তাদের গালগুলো খামোখাই নোনা হয়ে যায়। চোখের কোণে ঝুলে থাকে দোটানা, আগামীবারের স্বপ্ন। এও দুঃখের, যে পরম মমতায় শহরটা একদিন তৈরি হচ্ছিল দেবীকে ঘরে আনবে বলে, আজ তাঁকেই বিদায় জানাতে আরও বেশি করে তৈরি হচ্ছে। শুরুর দিন থেকেই বিদায়ের প্রস্তুতিতে এই শহরই কি প্রথম? কে জানে!

 

 

শোভাযাত্রা না শোকযাত্রা? নাকি, ঐতিহ্যের পরম্পরায় খানিক শ্লেষ ছড়িয়ে যায়? আলোতে আলোতে ঠোকাঠুকি, ঐতিহাসিক প্রতিযোগিতা সবই কেমন পানসে হয়ে যেতে শুরু করে। রাস্তার দুপাশে নৈর্ব্যক্তিক গার্ড অফ অনারে মুচকি হেসে ফেলেন দেবীও, হয়ত তাঁর চোখের লবণাক্ত ঘাম লুকিয়ে ফেলতেই। তিনিও তো ছিলেন এঁদেরই, আজ চলে যাবার পালা এঁদের ফেলেই। তবে, এত উল্লাসের কারণ হয়ত বুঝতে পারেন না তিনিও। অন্যদের কি এই ব্যাপারে খানিক হিংসাও করেন? জানা নেই!

 

 

সারা রাতব্যাপী মানুষের ঢল। যুগান্তরের চিৎকার। আলোর খেলা, মায়ার লুকোচুরি। প্রতিমার ম্লানমূর্তি এই রাতে ব্রাত্য, বরং, চরাচরের অন্ধকারকে প্রকট করতে থাকে তীব্র চিৎকারে। ছিটকে ছিটকে ওঠে ধুলোর অঞ্চল, প্রতিধ্বনি জানান দেয় জোছনার ফ্যাকাসে চিঠির। দোকানদারেরা ঝাঁপ বন্ধ করেছেন বহুক্ষণ, পুলিশও রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে বহু আগেই। তবু যেন শহরের বাতাস একটা নিজস্ব বৃত্তে রচিত হয়ে বইতে শুরু করে, ভারী হয়ে ওঠে আধ্যাত্মিক পরিবেশ। দেবীও হয়ত লুকিয়ে পড়তে চান এই নগ্ন উৎসবের বিদায়বেলায়। জনতার দরবারে আসলে তিনিও কেবল ব্যবসায়িক প্রতিস্থান মাত্র!

 

 

দশমীর রাতও শেষ হয় একসময়। প্রভাতী সূর্যের মায়াময় আলোয় ম্লান চোখে চেয়ে থাকে শূন্য দালান। তার প্রতিমা তাকে ছেড়ে চলে গেছে বহুক্ষণ। বিষণ্ণ প্রেমিকের পকেটের মতো শীর্ণ শরীরে লেগে থাকে গভীর হাহাকার। চাতালে পড়ে থাকে এতদিনের সয়ে যাওয়া ক্লান্তি, পরিশ্রম আর একমুঠো ধুলো। একটা থামের আড়াল থেকে উঁকি দেয় ফুরিয়ে যাওয়া ধূপের প্যাকেট, অথবা মোমবাতির বাতিল মোড়ক। আলোক-শোভায় ব্যপ্ত চরাচরের আকাশে চিৎকার জড়ো হয়, একলা দালান অন্ধকারে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকে পোষা কুকুরের মতো। তখনও তার মনে আশা, ছেড়ে যাওয়া বান্ধবীমৃন্ময়ী তো ফিরে আসবেই আবার! মাঝে শুধু একটি বছরের অপেক্ষামাত্র।

 

 

দিন এগোয়, ব্যস্ত হয়ে যায় শহরের রাস্তা। রোজকার মতোই বাজারের ব্যাগ হাতে এগিয়ে যান দুলালকাকা, মালতীমাসি, সন্ধ্যাকাকিমার দল। উল্টোদিকের মুদিখানার দোকানে জমে তর্ক, চায়ের দোকানে রাজনীতি। বোকা দালান এটুকুও অন্তত বোঝে না, যে তার আর এই গ্রহে এই মুহূর্তে কোনও মূল্য নেই। সে ভাবে, এই তো সন্ধ্যা হলেই তারা আবার উঠে আসবে দালানে, সাজিয়ে নেবে নিত্যপূজার সামগ্রিক পরিকল্পনা। এক বছর মানে যে শুধুই তিনশো পঁয়ষট্টিটা দিনের গণনা হয়, পুজোর দালানই তা কেবল জানে।

 

 

শুকিয়ে কাদা হয়ে যাওয়া চাপ-চাপ বলির রক্তে উষ্ণতার ওম পাওয়া চাতাল এখন নিরুপায়, নিস্তরঙ্গ। আর তার বুকে ভর দিয়ে মানুষের ভিড় এগিয়ে যায় না সামনের দিকে। ভারী ভারী ঠেকে না চটি-জুতোর স্তূপ। পথের ভিক্ষুকদের কদিনের নিশ্চিন্ত আশ্রয় এখন কেমন ম্রিয়মাণ, জৌলুসহীন। চাঁদার বিলের পাতাগুলো হালকা হয়ে আসে, চেয়ারগুলো চলে যায় যে-যার ক্লাবের ঘরে। চাতালের তো আর গ্রিলে চিবুক ঠেকিয়ে কাঁদার মতো বিলাসিতা নেই!

 

 

রাস্তার আলোগোলা বাতাস ক্রমশ ফিকে হয়ে আসে। মেলার মাঠ থেকে উবে যায় বুড়ির চুল, উড়ে যায় গ্যাসবেলুনের সারি। নিভৃত পরবাসে যাপনসঙ্গী হয় সস্তার ফাস্টফুড সেন্টার, আর চা-ওয়ালার দল। ছোট কাপ, পাঁচ টাকা। বড় কাপ, দশ টাকা। চোখে ক্ষীণ আশা নিয়ে ভিড় করেছিল তারা, হয়ত বা দিনান্তে জুটে যাবে দলা-সেদ্ধভাত, সঙ্গে ডালের জল। নেশাগ্রস্ত ডুবুরির মতো তারা খুঁজে চলে উজ্জ্বলতার অনুপাত, গলার শিরে ফুটে ওঠে আন্দোলন, পায়ে-পায়ে আলোগ্রস্ত শ্যামাপোকার মতো এগিয়ে চলে লরির পেছন-পেছন।

 

 

যে দালানে হয়ত বা প্রতিমার মুচকি হাসির আড়ালে কারোর ঠোঁট ছুঁয়ে গিয়েছিল কোনও এক অনামী নায়িকার গাল, হয়ত হাতে হাত বা মাথায় নমস্কার ঠেকানোর উপদ্রব বাঁচিয়ে নিভে গিয়েছিল আশা-নিরাশার দোলাচল, সেখানেই আজ শূন্যতা ভর করে আসে। পাঁজরফোঁড়া শীতের মতো কনকনে দেওয়ালে ফুটে ওঠে কান্নার স্তর, দিন গোনে জরুরি এক বছর। মহাকাব্যিক পীঠস্থান গড়ে তোলে যে স্বপ্নতীর্থ এটুকু অপেক্ষা তার প্রাপ্যই বটে!

 

 

অবশেষে, ঘোরের মধ্যে থেকে জেগে ওঠে কোনও এক সময়ের প্রেত। কানে কানে ফিসফিস করে যায়, প্রস্তুতির নতুন রেশ। অতীত আর বর্তমানের মাঝে ঝুলে থাকা সাঁকোর মতো দোটানার অস্তাচলে ঝিম মেরে শুয়ে থাকে বারোয়ারি পুজোর দালান, যার শিকড়ের সুপ্রাচীন ইতিহাসে জন্মদাগের ক্ষত লেগে আছে চিরকাল।

 

 

আধশোয়া ঘুম ঠেলে এইভাবে পড়ে থাকে সে, আর ভাবে, পুজো না এলেই বোধ হয় ভালো হতো। প্রেয়সী চলে গেলেই, সে যে ছিল- এইটা বড় বেশি করে মনে পড়ে যে!

  • রক্তিম ভট্টাচার্য