চলতে চলতে ভিয়েতনাম গেরিলা যুদ্ধের চু চি টানেল

'তোমার নাম আমার নাম, ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম' - এই শ্লোগানে একদিন মুখরিত হয়েছিল কলকাতার রাজপথ। কেমন আছে সেই ভিয়েতনাম এখন? তারই সুলুক সন্ধান-

 

 

এই জঙ্গলের নীচে  সুড়ঙ্গের নেটওয়ার্ক আছে।” 

ট্যুর গাইড সনের কথায় ভাল করে দেখছিলাম। গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে, মাটির নীচে কোথায় যে কীভাবে ভিয়েত কং যোদ্ধারা ক্যামোফ্লেজ করার অভিনব সব ব্যবস্থা করেছিল, বুঝিয়ে না দিলে খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

হো চি মিন সিটি থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টা লাগে চু চি টানেল যেতে। কম্বোডিয়ার খুব কাছে এই চু চি টানেল প্রায় ২৫০ বর্গ কিলোমটার এলাকা নিয়ে বানিয়েছিল ভিয়েতনামের যোদ্ধারা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে  জাপান হেরে যাওয়ার পর, ফরাসিরা ভিয়েতনামের ফের দখল নেয়। ইন্দো চায়না যুদ্ধের সময় থেকেই এই সুড়ঙ্গগুলো তৈরি করা শুরু হয়। পরে আমেরিকান সেনাদের নাস্তানাবুদ করার জন্য ভিয়েত কং যোদ্ধারা এই সুড়ঙ্গে অবিশ্বাস্য কিছু যুদ্ধ কৌশল দেখিয়েছিল।

 

 

মাটির নীচে তিনটে স্তরে এই সুড়ঙ্গগুলো তৈরি হয়েছিল। মাকড়সার জালের মত একটার সঙ্গে আর একটা যুক্ত। কিছু কিছু জায়গা অনেক গভীর, সাইগন নদীর জলস্তরেরও নীচে।

বল কী! জল ঢুকত না ভেতরে?” 

একদমই না। বরং জল বেরিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। ভেতরে থাকা, খাওয়া, বিশ্রাম নেওয়ার সব ব্যবস্থা ছিল। এই দেখ, এই যে একটা গর্ত, এটা একটা সুড়ঙ্গের মুখ।” 

ছোট গর্তটা গাছের গোড়ার পাশে এমনভাবে রয়েছে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।” 

এইটুকু গর্ত দিয়ে কী করে মানুষ ঢুকতে পারে!

আমার কথায় সন হাসল। ভিয়েতনামের মানুষের চেহারা দেখেছ? সবাই রোগা আর নমনীয়। খুব লম্বা চওড়া তো কেউ নই।” 

পুরো চু চি টানেলের ম্যাপ আঁকা রয়েছে এক জায়গায়। খুঁটিয়ে দেখে বোঝা গেল, দীর্ঘদেহী পশ্চিমী সেনাদের বোকা বানানোর জন্য এইরকম সুড়ঙ্গ না বানিয়ে উপায় ছিল না। অবিশ্বাস্য দক্ষতায় সুড়ঙ্গগুলো বানানো। মাটির উপর থেকে নীচে এত রকমের স্তর, পালিয়ে যাওয়ার জন্য, ধোঁকা দেওয়ার জন্য অভিনব সব ব্যবস্থা বানিয়েছিল যোদ্ধারা। কোথাও সোজা চলে গেছে আমেরিকান সেনাদের ক্যাম্প অবধি, কোনও সুড়ঙ্গ গোলক ধাঁধা বানিয়ে পাক খাইয়ে আবার এনে ফেলছে একই জায়গায়। সাইগন নদী দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার এসকেপ রুটও ছিল একাধিক। এই পুরো জঙ্গলটা এখন সংরক্ষণ করে ট্যুরিস্টদের দেখার ব্যবস্থা করে দিয়েছে ভিয়েতনাম সরকার। একে কী বলা যায়? মিউজিয়াম না জঙ্গল ওয়াক! 

সন বলল, “ এটা ভিয়েতনামের ইতিহাস। যতটা পারা যায় একইরকমভাবে রেখে দেওয়া হয়েছে।” 

চু চি টানেলের ঢোকার আগে একটা প্রদর্শনীর মতন আছে। সেখানে খালি সার দিয়ে সাজানো আমেরিকানদের থেকে হাতিয়ে নেওয়া অস্ত্রশস্ত্র। এর সঙ্গে বোমাগুলোও সাজিয়ে রাখা। কার্পেট বোম্বিং করে বহুবার চেষ্টা হয়েছিল, ইঁদুরের মত মেরে ফেলা গেরিলা যোদ্ধাদের। কিন্তু এই অসম যুদ্ধ এমনই কৌশলে লড়া হয়েছিল, একসময় আমেরিকান সেনারা বুঝতে পারে, ভিয়েত কং যোদ্ধারা ওদের বোকা বানাচ্ছে, ছুটিয়ে মারছে, ক্লান্ত করে দিচ্ছে। যুদ্ধ কিন্তু যুগে যুগে প্রমাণ করেছে, শুধু অস্ত্র আর শক্তি দিয়েই জেতা যায় না। অসম যুদ্ধে মানসিক শক্তি, কৌশলআর অসীম সাহস সবকিছুই কাজে দেয়। সাধারণ মানুষ কেন একযোগে একটা শক্তিশালী রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে লড়াই করে? গেরিলা যুদ্ধের অতর্কিত আক্রমণ আর মাটির নীচে পালিয়ে গিয়ে একেবারে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, এই যুদ্ধ কৌশল নাস্তানাবুদ করেছিল আমেরিকান যোদ্ধাদের। 

 

 

গাছের পাশে একটা উই ঢিপি। আসলে ওটা হাওয়া চলাচলের জন্য তৈরি। পুরোনো টায়ার কেটে অদ্ভুত আকারের জুতো বানিয়ে নিত যোদ্ধারা, পিছন দিকে মুখ জুতোর। সোজা হেঁটে গেলে জুতোর ছাপ বলবে উল্টো দিকে চলে গেছে কেউ। এমন জুতোর ছাপ দেখিয়ে বোকা বানিয়ে ফাঁদে ফেলার অভিনব ট্র্যাপ জঙ্গল জুড়ে। পা আটকে যাবে, বুকে এসে আঘাত লাগবে, ক্যামোফ্লেজ করা গ্রাম্য কুটির, দরজা খুললে সোজা আঘাত লাগবে.. সামান্য সব উপকরণ দিয়ে এমন সব ট্র্যাপ তৈরি, ভয়ে চিরুনি তল্লাশি করতে পারত না আমেরিকানরা। স্নিফার ডগদের বোকা বানানোর জন্য মৃত আমেরিকান সেনার পোশাক এমনভাবে ছড়িয়ে রাখত গেরিলারা, মাটির নীচে কোথায় কে লুকিয়ে আছে খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। 

 

 

এমন ক্যামোফ্লেজ করা কিছু গর্তে ট্যুরিস্টদের এখন ঢুকতে দেওয়া হয়। তবে সরু কোমর আর একটু নমনীয় শরীর না হলে সমস্যা হবে। ক্লস্টোফোবিয়া থাকলে তো একদমই ঢোকা উচিৎ নয়। এমনই এক গর্তে কপাল ঠুকে নেমে পড়লাম। শুকনো ছড়ানো পাতার মধ্যে লুকোনো গর্ত। ঠিক একজন মানুষই ঢুকতে পারবে। এমন মাপে বানানো নীচে শুধু উবু হয়ে বসে একটা ছোট ফুটো দিয়ে নজর রাখা যাবে চারিদিকে। দুমিনিট বসে থাকতেই ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। হাতে চাপ দিয়ে এক ঝটকায় উঠে পড়তে গেলেও প্রচুর এনার্জি লাগে। কোনওরকমে উঠে পোশাকের ধুলো ঝাড়ছি, সন হাসতে হাসতে বলল, “আসল চ্যালেঞ্জ তো টানেলের ভিতর। বুকে হেঁটে যাবে নাকি?” 

সঙ্গী দুই অল্প বয়সী ছেলে মেয়ে লাফিয়ে উঠল, “যাব যাব।

এই গ্রামের কিছু এক্সপার্ট আছে, নিয়ে যাবে চল। অনেকরকম চ্যালেঞ্জ হয়, তিনশো মিটার যদি একটানা ক্রল করতে পার, তাহলে বুঝব তোমাদের হিম্মত আছে!” 

বলে কী! দম বন্ধ হওয়ার ভয়ে বললাম, “ আমার শরীর অত ফিট নয়।” 

নো প্রবলেম, তুমি আমার সঙ্গে উপর থেকে ওদের  সিগন্যাল দেবে!” 

সে এক ভয়ঙ্কর কঠিন চ্যালেঞ্জ। অনেক দীর্ঘদেহী সাহেব দেখলাম গর্তের মাপ দেখে পিছিয়ে আসছে। আমাদের দুটি অবিশ্যি মোবাইলের টর্চ জ্বেলে নেমে পড়েছে। সামনে একজন স্থানীয় এক্সপার্ট পথ দেখানোর জন্য। দুজনে একটু পরেই মাটির নীচে অদৃশ্য হয়ে গেল। 

সন বলল, “ চল আমরা জঙ্গলে ওদের ফলো করি।” 

গাছের ফাঁক ফোকর দিয়ে  এঁকে বেঁকে আমারও ছুট লাগালাম। সন মাঝে মাঝে গাছের ফাঁকে কোনও প্রায় অদৃশ্য গর্তে গিয়ে শিস দিয়ে কী সব বলছে। নীচ থেকেও ক্ষীণ শব্দ উঠে আসছে, সহজে শুনতে পাওয়া যাবে না খুব এক্সপার্ট কান না হলে। প্রথম একটা গর্তে কান পেতে শুনে সন বলল, “ আরে ওরা তো বেশ সাহসী! সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। ওই দিকে চল যাই।” 

বেশ কিছু দূরে একটা অপেক্ষাকৃত বড় গর্ত দিয়ে ওরা বেরিয়ে এল অবশেষে হাসি মুখে। ঘামে জবজব করছে শরীর কিন্তু দুজনেরই মুখে যুদ্ধ জয়ের হাসি। 

মনে হচ্ছিল পাতালে ঢুকছি, মজা লাগছিল।হাসতে হাসতে বলল একজন।

গ্রেট জব! তোমরা সত্যি বেশ ফিট আর সাহসী, এতটা সবাই ক্রল করতে পারেনা, আমি অন্তত অনেকদিন দেখিনি।সন হাত মিলিয়ে বলল।( ক্রমশঃ) 

 

 

 

( দ্বিতীয় পর্ব) 

যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। এইসব সুড়ঙ্গ এখন ট্যুরিস্টদের রোমাঞ্চ বাড়ানোর জন্য রাখা রয়েছে। এখানকার মাটির শক্ত আর আঠালো চরিত্রের জন্য হয়ত এমন নিপুণ সব সুড়ঙ্গ মানুষ বানাতে পেরেছিল। সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক ভিয়েতনাম থেকে কম্বোডিয়া অবধি চলে গেছিল। কোথাও  শস্য গোলায় গিয়ে একটা মুখ খুলেছে, কোনও এক গ্রামবাসীর রান্নাঘরে, শুয়োরের খোঁয়াড়, বাগানের পাশে, নদীর ধারে.. কোথায় না কোথায় সুড়ঙ্গ এসে মিলেছে! এইভাবেই যোগাযোগ ছিল যোদ্ধাদের সাধারণ মানুষের সঙ্গে রসদ পাওয়ার জন্য। মাটির নীচের জীবন মোটেই স্বাভাবিক নয়। সাপ, ইঁদুর, কাঁকড়া বিছে, পিঁপড়ে, মাইটস আর বিভিন্ন ছত্রাকের বাসস্থান। মানুষের স্বাভাবিক চলাচল আর বাসস্থানের বাইরে এই প্রায় না-মানুষের জীবন কাটানো যোদ্ধারা কীভাবে দিনের পর দিন লড়ে গিয়েছিল ভাবতে অবিশ্বাস্য লাগে! 

 

 

তিন স্তরে বিভিন্ন সুবিধা বানিয়েছিল ভিয়েত কং যোদ্ধারা। মাটির নীচে হ্যামক টাঙিয়ে শুয়ে পড়ার ব্যবস্থা ছিল। ছোটখাটো মেডিকেল ইমার্জেন্সী সামলে দেওয়ার পরিকাঠামো ছিল। অস্ত্র ভান্ডার, বিভিন্ন বিচিত্র ট্র্যাপ বানানোর কারখানা, বাইসাইকেল জেনারেটর চালিয়ে অল্প ওয়াটের আলো জ্বালানো - কী না ছিল! রান্না করা হত গোপন কুঠুরিতে। তেমন একটা ঘর দেখলাম। ধোঁয়া বেরোনোর অনেকগুলো সরু সরু পাইপ, বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ভোরের দিকে রান্না করা হত বেশি, জঙ্গলের স্বাভাবিক কুয়াশার সঙ্গে রান্নার ধোঁয়া মিশে যেত। যোদ্ধারা ওই সময় একটু সিগারও টেনে নিত। মাটির নীচে নাকি প্রেম, ভালবাসাও ছিল, এমনকি একটু বড় প্রকোষ্ঠে বিয়ের অনুষ্ঠানও হয়েছিল কিছু! 

যুদ্ধ একটা অসুস্থ, অসহ্য সময়, কিন্তু তাই বলে মানুষ প্রেম করবে না! এখানে মাটির নীচে যোদ্ধারা মানুষই তো ছিল।সনের কথা শুনতে শুনতে এগিয়ে চলেছি। হঠাৎ দুম দাম শব্দ শুনে চমকে উঠলাম। 

ওটা শুটিং এর শব্দ। ভয় নেই। তুমি বন্দুক চালাবে?” 

এগিয়ে গিয়ে দেখা গেল, একটা প্রকান্ড মাঠের পাশে ক্যাফে খোলা হয়েছে, সেখানে কিছু এক্সপার্ট  স্টেনগান, রাইফেল চালানো শেখাচ্ছে, অবশ্যই টাকার বিনিময়ে। 

মেলার মাঠে বেলুন ফাটানোর মত আয়োজন, তবে কানে তালা ধরে যাবে শব্দে। ভিড় করে অনেকে লাইন লাগিয়েছে। 

নাহ্ সন। গুলি বন্দুক আর ভাল লাগছে না।” 

সন হাসল, “ জানি। তুমি গান্ধীর দেশের মানুষ। তবে এই গুলি আর বোমার শব্দ ভিয়েতনামের মানুষের জীবনের অংশ ছিল, বাবার কাছে শুনেছি।” 

নাহ্ শুধু গান্ধী কেন, আমাদের দেশে সশস্ত্র সংগ্রামের নেতাও ছিলেন। আর তোমাদের দেশেও তিনি এসেছেন যুদ্ধের মাঝে।” 

কার কথা বলছ?”

সুভাষ চন্দ্র বোস.. নেতাজি বলি আমরা। নাম শুনেছ?”

বোস! নামটা খালি শোনা। খুব একটা কিছু জানি না।” 

দীর্ঘশ্বাস ফেলে পকেট থেকে একটা ঠিকানা বার করলাম, “এই বাড়িটা কোথায় বলতে পারবে?” 

হাই বা থ্রং রোডএটা তো সাইগনে। তোমার হোটেল থেকে দূরে নয়। কিন্তু এটা তো কোনও ট্যুরিস্ট প্লেস নয়।” 

হ্যাঁ। এই বাড়িতে উনি ছিলেন। সম্ভবত ওই বাড়িতে রাত্রিবাস করার পর সাইগন থেকে প্লেনে চেপে চলে যান।” 

আচ্ছা তাই! কোথায় চলে যান?” 

জানি না। কেউ বলে প্লেন ক্র্যাশ করে মারা গেছেন, কেউ বলে উনি আত্নগোপন করেছিলেন... এটা একটা আন সলভড মিস্ট্রি।

ওহ। কিন্তু উনি তো তোমাদের নেতা, তোমরা খোঁজ পাওনি?” 

নাহ্ সন। আমাদের সরকার জানে না, নেতারা জানে না, কেউ আজ অবধি পরিষ্কার করে কিছু বলেনি তবে উনি আমার মত লক্ষ লক্ষ ভারতবাসীর বুকের মধ্যে বেঁচে আছেন। ওই বাড়িটা একবার দেখতে যাব তাই।

চু চি টানেলের জঙ্গলে দাঁড়িয়ে মনে হল যুদ্ধ তো এইসব দেশ অনেক দেখেছে। আমরা বরং ঘরে বসে গল্প গাথা শুনেছি। অথচ সাবেক মালয়, বার্মা, সিয়াম, ইন্দো চায়নার বিস্তীর্ণ অংশে এক বাঙালির অকুতোভয় কর্মকান্ড, এক চরম শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ এখন যেন এক বিস্মৃত রূপকথা হয়ে গেছে। আমরা যেন প্রায় তাঁকে ভুলতেই বসেছি। 

চু চি টানেলের গেরিলা যোদ্ধাদের কর্মকান্ড দেখে চললাম সাইগন। নেতাজির বাড়িটা আজ খুঁজে বার করতেই হবে। 

  • অয়ন ভট্টাচার্য