এমন এক হেমন্তকাল শীতবোধ বাড়িয়ে দেয়

হেমন্তে উমার বিদায়। বড় বেদনার মতো কাটে দিন। সেই কেটে যাওয়া দিনের মধ্যেই জেগে ওঠে আগত দিনের প্রত্যাশা। আমরা বেঁচে থাকি প্রত্যাশাকেই অবলম্বন করে-

 

 

শীত শুরুর হেমন্তকাল। ঋতু পরিবর্তনের সময় কাছে এলেই গড়পড়তা বাঙালির মুখে দুখানি বিশেষ মন্তব্য শোনা যায়। উফফ, দিন দিন কলকাতায় গরম বাড়ছে। এ শহরের আর কোনও ভবিষ্যৎ নেই।অথবা, “কলকাতায় আর শীত পড়ে কোথায়? পড়ত সে এককালে। আমাদের ছোটবেলায়।আসলে কথকেরা ভুলে যান, প্রজন্মের পরে প্রজন্ম পেরিয়েও অতীতের মুখে এমনই শুনে এসেছে ভবিষ্যৎ। অস্তিত্ব হিসেবে বাঙালির বিশেষত্বই হল নীরব অভিযোজন। বছরের পর বছর পেরিয়ে যায়। বাঙালি ঠিকই তার নস্টালজিয়ার উপাদান সংগ্রহ করে নিতে থাকে। নুড়ি থেকে নুড়িতে চলন তার।

 

 

 

মোবাইলে মারুবেহাগের সুর। দিন শেষে বাড়ি ফিরে চলভাষ খুলে বসা। সকলের সে ফুরসৎ মেলে না। কেবল অন্ধকার গলিতে তারা দেখতে পায় ফটফটে শুকনো এ্যাসফাল্ট চলে গিয়েছে। অনন্ত এক শুষ্কতা। লোকজনের ভিড় কমে আসে। ফাঁকা হয়ে পড়ে বাজার-হাট। শীত নামছে। হ্যালোজেন আলোগুলো টিমটিম করে। বোধ করি তাদেরও কেমন জানি দম আটকে যায়। ধোঁয়াটে আবছায়া জমে উপরটায়। এই সময়ে জ্বরভাব আসে। ভোরবেলাকার জমে থাকা জলের উপর ঠাণ্ডা সর পড়ে। হাতের কাছে গরম গলাবন্ধের কোনও ব্যবস্থা রাখা উচিত, নাকি নয় এমন সব ভাবতে ভাবতেই অফিসের দেরি হয়ে যায়। সবজিতে কদর বাড়ে ফুলকপির।

 

 

শীত পড়লেই সবচেয়ে বেশি করে বদল চোখে পড়ে আনাজ-বাজারের ব্যঞ্জনায়। যদিও আজকাল প্রযুক্তি ও পরিকাঠামোর কল্যাণে মরসুমি সবজি বলতে আর প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই। বারোমাসই সমস্ত রকমের সবজি মিলছে পুঁজি ও বিজ্ঞানের বদান্যতায়। তবু অর্থনৈতিক কিছু বৈশিষ্ট্য থেকেই যায়। বাড়ি অথবা মেসের তরকারিতে এই শীতকালেই ফুলকপির লক্ষ্যণীয় অস্তিত্ব দেখা যায়। শাক ওঠে নানারকম। বড়দিন-মুখো বাঙালির সাহেবিহেঁশেলে ধনেপাতা-কারিপাতাকে ছাপিয়েও ঢুকতে শুরু করে পার্সলে, লেটুস, বেবিকর্ন। তবুও এ আভিজাত্য বোধহয় আদতে দক্ষিণ কলকাতারই অনেকটাই। নাকি তেমন সাহেবিয়ানারও গণ্ডি ভেঙেছে অনেকদিন?

 

 

সামাজিক মাধ্যমে আসন্ন পিকনিকের বিষয়ে আলোচনা জমে ওঠে। লালমাটির পথ এখন যদিও বা কংক্রিটের। তবুও কোনও নদীর ধার। শীত আরেকটু জমলে না হয় দল বেঁধে বেরিয়ে পড়া যাবে। শুরু হয় সেই সব পরিকল্পনাই। অবধারিতভাবে সেই আলোচনায় উঠে আসে সকালের ব্রেকফাস্ট, লুচি-তরকারি আর শুকনো বোঁদের গতানুগতিক প্রস্তাব উত্থাপন। অথবা তার চেয়েও সরেস কারোর স্পনসরশিপের কল্যাণে বড় বড় দরবেশ-সন্দেশের লোভনীয় প্রগলভতা। দুপুরের মেনুতে তাহলে কষিয়ে মটন হোক। বিকেলে চায়ের সঙ্গে ফুলকপির পুনরাগমন। পকোড়ার মুচমুচে ভাব। শীত পড়লে এমন সব ভাবনারাই মন উদাস করে তোলে।

 

 

আর তখনই গান ভেসে আসে। ১৯ নভেম্বর।

সুরসম্রাট সলিল চৌধুরীর জন্মদিন।

 

 

এত সুর আর এত গান বাঙালী উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জন করে এসেছে, হেমন্তের নির্জন অরণ্য-কাল তার সেই ফল্গুধারা-সম উত্তরাধিকারে এতটুকুও শুষ্কতার প্রলেপ ফেলতে পারেনি। ঠিকানা ব্যতিরেকেও সেই পোস্টম্যানের কাছে তাই, ঠিকই তার প্রস্তাবের জবাব পৌঁছিয়ে যায়। গোড়া কাটা শস্য-শূন্য মাঠ এক সিপিয়ার বাস্তবতা লেখে। আদতে এই আসন্ন শূন্যতার পূর্বাভাস যে দীর্ঘমেয়াদে গর্ভে জমিয়ে রাখছে ভাবি বসন্তের রক্তিমতর উচ্ছাস-বাণীর নিশ্চিত উদযাপন, বাঙালির তা বুঝতে ভুল হয় না। তাই আশ্বিনের উৎসব পেরিয়ে হেমন্তের রিক্তভাব তাকে বিচলিত করে না। বরং অনাগত অথচ আবেগদীপ্ত এক উজ্জ্বলতর ভবিষ্যৎ সময়েরই কুশল সম্ভাবনায় প্রত্যাশী হয়ে উঠে প্রকৃতিরও যেন গর্ভসঞ্চার হয় তখন।

 

 

আমরা হাঁটছি। মাথার উপরে ছাউনি হয়ে থাকা বিরাট গাছের ডাল। ঘন পাতার সুনিশ্চিত আড়াল এখানে। শীত বলতেই ঘামের উপদ্রব থেকে মুক্তি। আর বেরিয়ে পড়া কলকাতা শহর। সাদার্ন এ্যাভেনিউয়ে দুপুরের নিস্তব্ধতা। কোথায় যেন পড়েছিলাম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলকাতাকে সবধরণের বিপদ থেকে রক্ষা করতে, এই সাদার্ন এ্যাভেনিউয়েরই চওড়া ব্যুলেভার্ড যেখানে এখন সেই সারি বরাবর লম্বা, গভীর ট্রেঞ্চ খুঁড়ে ফেলা হয়েছিল। যাতে সম্ভাব্য বিমান হামলার সময় শহরের অভিজাত, বরিষ্ঠ মানুষ যাঁরা আছেন তাঁরা সেই ট্রেঞ্চে গিয়ে আশ্রয় নিতে পারেন। যুদ্ধ কেটেছিল ঘটনাবিহীন। কলকাতায় খান দুই-তিনের বেশি বোমা ফাটেনি। তাকে বিমানহামলার মুখেও পড়তে হয়নি। তাই সেই ব্যুলেভার্ডের জায়গাতে খুঁড়ে ফেলা ট্রেঞ্চ যথা সময়ে মাটি দিয়ে সম্পূর্ণ বুজিয়ে দেওয়া হয়, এবং তারপর তার উপরে ছড়িয়ে দেওয়া হয় বিবিধ গাছের বীজ। বিরাটকায়, পত্রবতী সেই সব মহীরুহেরাই সাদার্ন এ্যাভেনিউয়ের মাথার উপরে আজ ঘন শ্যামল এক প্রাকৃতিক চাঁদোয়ার অবাক সমতুল হয়ে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। এখনও গোলপার্ক পেরিয়ে সন্ধ্যের সময়, ডানদিকে ঘুরে গেলেই তাপমানের তফাত বোঝা যায়।

 

 

 

সেই হেমন্তেই উমার বিদায়। সামাজিক মাধ্যমে ভেসে আসা কোনও এক ডিজিটাল চিরকুট। অজান্তেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে হঠাৎ। আদতে তিনি যে নিজের অস্তিত্বকে ছাপিয়েও বিরাটতর এক অস্তিত্বের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছিলেন। উমা দাশগুপ্তের চেয়েও তিনি বাঙালীর দুর্গা, তার আপন দুর্গাঅপু ওরফে অপূর্ব কুমার রায়ের চিরতরে হারিয়ে যাওয়া, চিরপরিচিত এক অগ্রজের নাম। সমান্তরাল পৃথিবীতে কোথাও, কোনওভাবে আবার সম্পূর্ণ সেরে উঠলেও, কাশফুল ভরা মাঠে আর রেলগাড়ি দেখা হবে না তাঁর। শরতের কাশফুল আর একরাশ খুশি বুকে নিয়ে যে নিশ্চিন্দিপুরে ফিরেছিল হরিহর, আজ সময়ের বহমানতায় সেলুলয়েডের ফ্রেমটুকু ভিন্ন আর কোথায় অস্তিত্ব রইল তার? সে গ্রামের আরও একটি পাকাপোক্ত ঘর যেন বা ধ্বসে-ভেঙে, অপার নিস্তব্ধতায় কালগর্ভে মিশল আজ। পথের পাঁচালীনামে ঘটে যাওয়া সেই চিরায়ত, বৈপ্লবিক ঘটনার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত খুব অল্পজনই বোধহয় এখনও থেকে গেলেন। এমন এক হেমন্তকাল শীতবোধ বাড়িয়ে দেয়।

 

 

এই নভেম্বরেই অপুগিয়েছিলেন। ১৫ নভেম্বর। ২০২০ সাল। আজও মনে আছে দ্বীপান্বিতা অমাবস্যার লগ্ন ছিল সেদিন। রবীন্দ্র সদন থেকে কেওড়াতলা শ্মশান অভিমুখে শকট এগিয়ে যায়। একেকটি করে মণ্ডপে শ্যামাসঙ্গীতের রেকর্ডকে ছাপিয়েও উদাত্ত স্বরে সেদিন বাজিয়ে দেওয়া হয় অপুর যন্ত্রস্থ কণ্ঠস্বর। হেমন্তের নয়নাভিরাম সেই বিকেলের রঙ। বাঙালির হাত থেকে এই হেমন্তকাল সৌমিত্র তো নয়, নস্টালজিয়ার চিরকালীন সংসার থেকে রক্ত-মাংস-অস্থির উপস্থিতি-সম্পন্ন ঘোর-বাস্তবের অপু ওরফে অপূর্বকেই যেন বা ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সেদিন। দুর্গাকেও সেই একই সময়ে যেতে হল! একইভাবে শীত আগমনের হেমন্তকাল। অনেক সকালে গরম চাদরের আড়াল। ইদানিং যাকে সরিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠতেও ভয়ানক আলিস্যি বোধ হয়।

 

 

আদতে আমাদের ছোটবেলাটা হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ এর পরবর্তীতেও আরও কোনও প্রজন্ম আসবে ঠিক। আর তারাও লিখবে তাদের মতো করে নতুন কোনও স্মৃতিমেদুরতার ইতিহাস। হলুদবরণ অতীতের প্রতিনিধি হিসেবে তাতে হয়তো আমাদেরও কোনও অস্তিত্ব থাকবে। অথবা এতটুকুও থাকবে না বোধহয়। পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন -  মূর্খ বালক পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে, ঠ্যাঙাড়ে বীরু রায়ের বটতলায় কি ধলচিতের খেয়াঘাটের সীমানায়? তোমাদের সোনাডাঙা মাঠ ছাড়িয়ে, ইছামতী পার হয়ে, পদ্মফুলে ভরা মধুখালি বিলের পাশ কাটিয়ে বেত্রবতীর খেয়ায় পাড়ি দিয়ে, পথ আমার চলে গেল সামনে, সামনে, শুধুই সামনে …”

 

 

চল এগিয়ে যাই!

  • অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়