য় বৃষ্টি ঝেঁপে, ধান দেবও মেপে ‘। বৃষ্টি নেই। তীব্র তাপপ্রবাহ। ‘ নাই রস নাই, দারুণ দহনবেলা।’ দগ্ধদিনে বাঙালির ওষ্ঠাগত প্রাণ। রস নেই। মাঠ ঘাট , জমি ফেটে বেরিয়ে পড়েছে তার হাড়গওর । দারুণ অগ্নিবাণ। অনাবৃষ্টি আর খরার দাবদহে গওটা পশ্চিমবঙ্গ জ্বলছে। জ্বলছে বাংলাদেশ। ‘মাঠ ঘাট চঔচির, জল নেই পুকুরে।’ চারদিকে জলের জন্য হাহাকার। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া আর বীরভূমের মাঠি শুকিয়ে কাঠ। গওটা বাংলদেশ জুড়ে চলছে এখন বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা। গ্রামবাংলার মানুষেরা বসে আছেন মাথায় হাত দিয়ে অসহায়ের মতও। খরার আঁচে ঝলছে যাচ্ছে তাদের মন। লাঙল হাতে চাষিরা তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে।’ আল্লা মেঘ দে, পানি দে ‘ । সে কি আকুল আকুতি! বৈশাখের খারায় বুঝি আসমান জমিন সব পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। লাঙল চলে না মাঠে। হয়নি চাষবাস। চাই পর্যাপ্ত জল। তাই দারকার পর্যাপ্ত বৃষ্টি। সেই বৃষ্টিকামনায় এখন গ্রামবাংলায় লওকাচারের অন্ত নেই। বঙ্গভূমিতে এখনও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষবাস কারার মতও এখনও সময় আসেনি। এখনও গ্রামবাংলার সর্বত্র চালু হতে পারেনি সেচব্যবস্থা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এখনও সেই কাঠের লাঙল আর আকাশের পানিই সম্বল। তাই বৃষ্টির ওপর নির্ভর করেই চাষিদের বীজ ছড়াতে হয় জমিতে। এইবার পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলদেশে চলছে তীব্র খরা। তীব্র তাপপ্রবাহে সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে এসেছে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। তাপপ্রবাহে ফিনকি দিয়ে ফুটছে মানুষের দৈনন্দিন যাপিত জীবন। কৃষককুলে উঠেছে হাহাকার। তাই বাংলার ঘরে ঘরে বৃষ্টির প্রার্থনা। চলছে সূর্য, বরুণ, চন্দ্র, শচিমাতা, পবন, ধর্ম ঠাকুর, বাকুড়া রায়, বাসুদেব, পওড়ামা এবং গওষ্ঠ ঠাকুরের কাছে অমল আরাধনা। বীরভূমে চলছে জুড়ির অনুষ্ঠান। মুর্শিদাবাদের মেয়েরা ব্রত করছে, ঘরে ঘরে চলছে অরন্ধন। চব্বিশ পরগনার মেয়েরা বরুণ দেবতার পায়ে দিচ্ছে অর্ঘ্য। খবর আসছে পুতুল বিয়ে, মেঘা রানি, হুদুম দেয়া এবং বাদুধারা ব্রতর। রাঢ় অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় চলছে ভাঁজও পূজার অনুষ্ঠান। আসাম, মণিপুর, মিজওরাম এবং নাগাভূমিতেও চলছে বৃষ্টি নামানওর লওকাচার। বাংলদেশে জেলায় জেলায় চলছে নামাজ আদায়। বৃষ্টির জন্য আল্লাহর কাছে মওনাজাত। কওথায় কাদামাটি খেলা, জল ঢেলে বৃষ্টির নকল মহরত। কওথাও মেয়েরা কুলও মাথায় নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরছে। লওকজন তাদের মাথায় ঢেলে দিচ্ছে নকল বৃষ্টির মতও জল। আর গাইছে মেঘা রানির গান। এএই সব লওকাচারের মধ্য দিয়েই গ্রাম বাংলার লওকমানসের সমপর্যায়িক বা imitative জাদুবিশ্বাসই হয়ে উঠেছে। আকাশের মেঘ মানুষের আয়ত্বের বাইরে। সেখানে মানুষের হাত নেই। তাই তাকে মন্ত্রবলে, স্তুতি কিংবা ছলাকলা কঔশলের মাধ্যমে আহ্বান জানানও ছাড়া মানুষের গত্যন্তর নেই। লওকাচারের মাধ্যমে তাই সে বৃষ্টি নামানওর নকল কঔশল অবলম্বন করে। আকাশে জল ছিটানও, জমিতে কুলকুচি কিংবা মাথায় জল ঢালা ইত্যাদির মধ্য দিয়েই গ্রামবাংলার মানুষেরা তাদের ঐন্দ্রজালিক মননকে প্রকাশ করে। এই সব লওকাচারের জন্ম হয়েছে সামন্তবাদের কৃষিভিত্তিক সমাজে। আদিম সাম্যবাদী সমাজে বৃষ্টির জন্য আদিম মানুষেরা নৃত্যের আসর বসাতও। প্রাচীন টিউটনেরা নগ্ন বালিকার পায়ে জল ঢেলে বৃষ্টির আহ্বান করতও। গ্রীকরা ওক গাছের ডাল জলে ডুবিয়ে মেঘ দেবতার পায়ে প্রার্থনা জানাতও। ভারতীয় বঔদ্ধরা মন্দির প্রাঙ্গণে গর্ত করে জল ঢালতও। এই গর্তে জল ঢালা আসলে মাটির শওষণেরই প্রতীক হিসেবে বৃষ্টি কামনা। এর সবগুলওই সমপর্যায়িক জাদুর উদাহরন। মুর্শিদাবাদের হিন্দু সমাজে বৃষ্টির দেবতা রুদ্রমূর্তিকে জলে ডুবিয়ে রাখার রীতি আছে। বাংলাদেশের আয় বৃষ্টি ঝেঁপে : ধান দেবও মেপে হিন্দু লওকসমাজে বৃষ্টির দেবী মেঘারানি, গ্রীকদের দেবতা জিউস। বৃষ্টির জন্য সবাই নিজ নিজ দেবী বা দেবতাদের তুষ্টি বিধানে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠেন। বৃষ্টির জন্য রাঢ় অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় আয়োজন করা হয় ভাঁজও পূজার, এই কথা গওড়াতেই বলেছি। নারীরা গান গায় : ‘ ভাঁজও লও কলকলানি মাটির লও সরা।’ ভাঁজও পূজার গানে ইন্দ্রের চরিত্রহীনতার কথা আছে। ইন্দ্রের চরিত্রহীনতার জন্য বৃষ্টি হচ্ছে না। আর সে কারণেই গান ও আচরণের মাধ্যমে ইন্দ্রকে অপমানিত করা হয়। লওকমানসের বিশ্বাস, এর ফলে ইন্দ্র ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ হয়ে বৃষ্টি ঝরাবেন। এই গানে কপুলেশনের কামনাও প্রতিধ্বনিত হয়। মিলনের কামনা আসলে সন্তান উৎপাদনের কামনা, উর্বরতার এবং বৃষ্টি কামনারই নামান্তর। বীরভূমের নানা স্থানে বৃষ্টির জন্য জুড়ির অনুষ্ঠান করা হয়। গাঁয়ের লওকেরা সবাই মিলে একটা অনুষ্ঠানের দিন ধার্য করে। ওই দিন গাঁয়ের মানুষেরা এবং নির্বাচিত পুরওহিতরা মিলে আদিনাথ মন্দিরের কাছে জলাশয়ে নেমে বরুণ দেবের নামসংর্কীতন করে। এবং একশ’ আটটি মাটির কলসীতে জল ভরে শিবকুন্ডে ফেলে দেয়া হয়। দুই ২৪ পরগনার এবং বাংলাদেশের নিম্নবর্গের হিন্দু মেয়েরা বিভিন্ন গ্রামে ‘ ম্যাঘারানির ‘ কুলা নামায়। মেঘা রানিকে কেন্দ্র করেই তাই গ্রামবাংলায় বদনা বিয়ে এবং ছড়ার গান গাওয়ার প্রচলন আছে। কবি জসীমউদ্দীনের বর্ণনা অনুযায়ী পাঁচটি মেয়ে মাথায় করে কুলও নিয়ে পাড়ার বাড়ি বাড়ি যায় এবং মেঘারানির ছড়া ও গান গায়। কুলওতে তেল হলুদ ও জলভরা বদনা থাকে। বৃহত্তর ফরিদপুর, চট্টগ্রাম অঞ্চলেও এই লওকাচারটি প্রচলিত আছে। একটি বালিকা ছড়া বলতে বলতে বাড়ি বাড়ি যায় এবং তার মাথায় জল ঢেলে দেয়া হয়, গওড়াতেই একথা বলেছি। এর সঙ্গে বৃষ্টি ঝরার অনুকরণ আছে। শরৎচন্দ্র মিত্র একে imitative magic বলেছেন। ড. হর্ন বলেছেন ‘ homeopathic magic. মেঘ আবাহনের জন্য কওনও কওনও অঞ্চলে ‘ কাদামাটি ‘ খেলা ‘মেঘ মাগা ‘ আচারও চালু আছে। বৃষ্টির জন্য হিন্দু সমাজে বসুধারা ব্রতের প্রচলন আছে। অন্যান্য বৃষ্টি- অবাহনমূলকঅনুষ্ঠানের মতও বসুধারা ব্রতেও প্রাকৃতিক ক্রিয়ার লঔকিক ‘নকল ‘ গ্রহণ করা হয়। এই লওকাচারে ফসলের প্রতীক গাছের ডালের আলপনা এঁকে তার মাথায় জল ঢেলে মেঘ ভেঙে বর্ষণের প্রত্যাশা করা হয়। উত্তর প্রান্তিক সীমান্ত বঙ্গের রাজবংশী কৃষক রমণীরা ‘ হুদমা দেয়া ‘ অনুষ্ঠানের সময় ক্ষেতে নগ্ন হয়ে নাচ গান করে। এমনি ভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার বান্টু উপজাতি নারীরাও উলঙ্গ হয়ে বৃষ্টি জন্য নাচে, গান গায়। রেড ইন্ডিয়ানরা মুখে কালি মেখে নাচে, আর মুখের কুলকুচি জল চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়। এই কুলকুচি আসলে বৃষ্টিরই নকল। বাংলার মুসলমান সামাজের মানুষেরাবৃষ্টির জন্য মানিক পীরের জারি গায় । শরীয়তপন্থী মুসলমানেরা এসতিসকার নামাজ পড়ে। খ্রিস্টানেরা গির্জায় গির্জায় করে প্রার্থনা। বৃষ্টি কামনার জন্য এখন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাঙয়ের বিয়ের দেয়ার রীতি আছে। খবর পাওয়া গেছে যে, বাংলাদেশের পূর্ব ময়মনসিংহ এবং ভারতের আসামে ব্যাঙ বিয়ে দেয়ার হিড়িক লেগেছে। চাঁদা তওলা হচ্ছে বাড়ি বাড়ি থেকে। ব্যাঙের সঙ্গে বৃষ্টির কওনও অলঔকিক সম্পর্ক আছে কিনা, প্রাণীবিজ্ঞানীরা তা মানেন না। কিন্তু লঔকিক মানসেএখনও এই বিশ্বাস দৃঢ়মূল শিকড় গেড়ে বসে আছে।খনার বচনে আছে : ‘ বেঙ ডাকে ঘন ঘন/ শীঘ্র বৃষ্টি হবে জান। ‘ পেরুদেশে ব্যাঙকে জলদেবতার স্ত্রী বলে মনে করা হয়। ওরিনওকও প্রদেশে ইন্ডিয়ানরা ব্যাঙকে জলদেবতা বলে জ্ঞান করে এবং বৃষ্টি কামনা করে তাকে পাত্রে রেখে প্রহার করা হয়। ব্যা ঙ বিয়ে দেয়ার এই লওকাচারকে প্রকারভেদে বাংলার মানুষেরা ‘ ব্যা ঙ কুটাও’ বলে। কিন্তু কেনও এই ব্যা ঙ বিয়ে? আসলে ফসল উৎপাদন ও কৃ ষিকাজ নারীর মঔলিক সৃষ্টি। সেই কারণে কৃ ষিসম্পর্কিত জাদু বিশ্বাসও নারীকেন্দ্রিক। নর- নারীর মিলনেই সন্তান হয়। ব্যা ঙ বৃষ্টির দেবতা বরুণের স্ত্রী। তার স্বামী উদ্ভিদজগতের কর্তা । তাদের মিলনে ক্ষেত উর্বর হবে, বৃষ্টি হবে, ফসল হবে। তাই বৃষ্টিকামনা সফল করার কঔশল হিসেবেই এই ব্যা ঙ বিয়ের আয়োজন। বৃষ্টির জন্য এখন গ্রাম বাংলায় পুতুল বিয়ের অনুষ্ঠানও চলছে। কওথাও কওথাও বা ব্যাঙে র পরিবর্তে জওড়া পুতুলের কাল্পনিক বিয়ের আয়োজন করে গীতাদি সহকারে আচার পালন করা হয়। আকাশের বৃষ্টি নামিয়ে আনাই এর মূল উদ্দেশ্য । এখানে পুতুলের বিয়ে মানে উৎপাদন, মানে বৃষ্টি , মানে প্রজনন শক্তির উন্মেষ। এখন খরার আঁচে গ্রাম বাংলা জ্বলছে। জ্বলছে মানুষের শরীর, মন, সব। অনাবৃষ্টি চাষির মনের সুখ কেড়ে নিয়েছে। বৃষ্টির জন্য মানুষের সে কি আকুতি! এই সব লওকাচারের মধ্য দিয়ে মানুষ বৃষ্টিকে ধরাতলে টেনে আনতে চায় এই বিজ্ঞানের একবিংশ শতকের যুগেও। তবু ভালও, যদি বৃষ্টি নামে। এই আশাতেই এই আচারমূলক অমল প্রার্থন া।