মনোজ মিত্রের প্রয়াণ, যথার্থ যেন; যাওয়া তো নয় যাওয়া। বুদ্ধিদীপ্ত বিনোদন, হৃদয় নিঙরনো অভিনয় আর অনবদ্য প্রতিবাদী সত্তা, যেখানে নেই প্রোপাডান্ডিজিম। রয়েছে প্রবল শিল্পমন্ডিত রসবোধ-
“জ্যোতিতে দারুণ একটা সিনেমা এসেছে।” এমন সিনেমা ছোটদেরও দেখানো যাবে। তাই ছোটো আমি মা বাবার সাথে দেখতে গেলাম – ‘বাঞ্ছারামের বাগান’। আরিব্বাস! কী দারুণ! খুব হাসি, আবার ভূতও আছে। লাঠির ওপর লাফিয়ে উঠে বুড়ো বাঞ্ছারাম যখন লেঠেলকে ফেলে দিল খুব মজা পেয়েছিলাম। এই আমার প্রথম দেখা তাঁকে। শ্রদ্ধেয় মনোজ মিত্র। নাম অবশ্য জেনেছিলাম বড়দের মুখে। আর জেনে অবাক হয়েছি ওঁর না কি বেশি বয়স নয়!
“কিন্তু অত বুড়ো সেজেছিল!!!”
তারপর তো বাবা আর মা’র আলোচনায় বেশ না জানা ক’টা শব্দ শুনলাম। সে সব বড় হয়ে বুঝতে পেরেছি। মোট কথা এটা মোটেও হাসির আর ছোটদের ছবি নয়। তারপর এক সময় মা, পিসিমণির গলা নামিয়ে আলোচনা একটি সিনেমা নিয়ে – ‘আদালত ও একটি মেয়ে’। যখন সে ছবি নিজে দেখলাম – একজন সৎ, কর্তব্যপরায়ণ, পুলিশ অফিসারকে পেলাম। অবাক লাগে, এরকম চরিত্রে অভিনয় শুরু করা এক অভিনেতাকে, বাংলা সিনেমা টিপিক্যাল ভিলেন আর হালকা কমেডিতে আটকে দিল! ভিলেনের চরিত্রে ওঁর অভিনয় দেখে দর্শকদের রাগ দেখেছি। এত না কি “খারাপ লোকটা”! বুঝেছি, অভিনয় কোন জায়গায় গেলে দর্শক চরিত্রটিকে সত্য (real) ভাবতে শুরু করে। ‘দামু’ র ভালোমানুষ দারোগা, ‘বৈদুর্য রহস্যে’র ডিটেকটিভ এজেন্সির বস, আমার খুব পছন্দের। টিভি সিরিয়াল ‘আদর্শ হিন্দু হোটেলে’র হাজারী ঠাকুরকে কার না ভালো লেগেছে! তপন সিংহ, সত্যজিৎ রায়, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তদের মতো পরিচালকদের ছবিতে, সব মাধ্যমে দাপটের সঙ্গে, এত বিশ্বাসযোগ্য চরিত্রায়ন, তবু হাতেগোনা কয়েকটি ছবি ছাড়া, বাংলা ছবি তাঁকে তেমনভাবে ব্যবহারই করল না। বাংলা মৌলিক নাটকের না কী অভাব! সে তো তিনি একাই পূরণ করে দিতে পারেন। গ্রুপ থিয়েটার থেকে পাড়ার ক্লাব, একাঙ্ক নাটক করা নাটকের দল, সবার পছন্দ “মনোজ মিত্রের নাটক”। অফিস ক্লাবের নাটক তো তাঁকে ছাড়া হবেই না। তাই তো তাঁর নাটকের দর্শক শুধু “থিয়েটারের দর্শক” নন। এই সর্বত্রগ্রাহ্যতা তাঁকে আলাদা করে, বিশিষ্ট করে।
নিজের দল ‘সুন্দরম’ ছাড়াও অন্যান্য থিয়েটার দলের কাছেও আদৃত তাঁর নাটক। এও এক বিরল দৃষ্টান্ত। “মহাবিদ্যা” যে কত শত শো হয়েছে, কত জানা অজানা দলের, থিয়েটারের মানুষ মাত্রই স্বীকার করবেন। “নরক গুলজার” তো ইতিহাস। “…ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন, গোলযোগ সইতে পারেন না” – এ গান তো নাটকের গণ্ডি ছাড়িয়ে বাংলা প্রবাদ হয়ে গেছে কবেই। বক্তব্যের ভারকে হাসির মোড়কে, কখনও চোখের জলে পরিবেশন করেছেন। তাঁর নাটকে বক্তব্য এত সহজে আসে, দর্শক কোনও চাপ অনুভব করেন না; অনায়াসে দর্শকের অন্তর ভেদ করে। অসামান্য কৌতুকময় সংলাপ, অভিনেতা, দর্শক দুজনকেই মাত করে দেয়।
‘সাজানো বাগানে’ বাঞ্ছাকে যখন জমিদার পিঠে বয়ে নিয়ে যায়, সেও তো প্রতিবাদ। বিদ্রোহে ফেটে পড়াও তো আছে – ‘চাক ভাঙ্গা মধু’। আবার “রাজদর্শনে” অভিরামের পিঠে চেপে লম্বোদর চলে রাজা হতে। কী সহজে, হাসতে হাসতে দর্শক বুঝে যান রূপকটুকু। “অলকানন্দার পুত্র কন্যা’’, ‘কিনু কাহারের থেটার’, ‘ছায়ার প্রাসাদ’, ‘গল্প হেকিমসাহেব’, ‘দেবী সর্পমস্তা’, ‘যা নেই ভারতে’, ‘আত্মগোপন’, ‘পরবাস’… কী অনবদ্য, মঞ্চ সফল নাটক! মঞ্চ নাটক ছাড়াও তাঁর নাটক বেতারে কিংবা শ্রুতিনাটক হিসেবেও দারুন সফল। ‘আমি মদন বলছি’, ‘টাপুর টুপুর’, ‘পাখি’, ‘আঁখি পল্লব’...একশো’র বেশি নাটক লিখেছেন। নানাভাবে সাধারণ মানুষের কথাই তো অবিরাম বলেছেন তাঁর নাটকে। লেখা, অভিনয়, নির্দেশনা, নাট্যদল পরিচালনা, অধ্যাপনা… জীবনভর শিল্পেই বসত করেছেন আদ্যন্ত থিয়েটারের মানুষটি।
"সাজানো বাগান” যখন দেখলাম তখন তিনি পরিণত বয়সে। কিন্তু সেই ছোটবেলায় দেখা বাঞ্ছারামের সঙ্গে কোনও ফারাক করতে পারিনি। একজন অভিনেতার এই ধারাবাহিকতা বড় কম কথা নয়। ‘গল্প হেকিম সাহেবে’র ওয়ালী খাঁ, ‘দম্পতি’র কর্তা, ‘শোভাযাত্রা’র ধনগোপাল, ‘পরবাসে’র গজমাধব, ‘অলকানন্দার পুত্রকন্যা’র রজনীনাথ…আরও কত কত চরিত্র, নিপুণ অভিনয়-নির্দেশনা। এ সবই বাংলা থিয়েটার, থিয়েটারের দর্শক নিশ্চিত লালন করবেন স্মৃতিতে। মনোজ মিত্রের সঙ্গে আসল পরিচয় তো হল যখন থিয়েটারের সমুদ্রে পায়ের পাতাটুকু ভেজাতে পারলাম। (এর বেশি পেরেছি বলে ভাবতেও পারি না)। না, ব্যক্তিগত পরিচয়ের সৌভাগ্য হয়নি আমার। মঞ্চে, গ্রিনরুমে কাছ থেকে দেখেছি –এই পর্যন্ত। কিন্তু তাঁর লেখা, অভিনয়, সব মিলে তো খুব চেনাজানা হল। ‘কোথায় যাব’ নাটকে মন্দিরা করছি। গজমাধব চরিত্রে আমি তো তাঁকেই দেখতে পাচ্ছি। আমি তো তাঁর সাথেই অভিনয় করলাম।
“আমার জ্বলেনি আলো অন্ধকারে…” গাইছি আর যেন ওঁর এক্সপ্রেশন দেখতে পাচ্ছি… কী আশ্চর্য সম্পর্কের গল্প লিখেছেন! একাকীত্বের কথা, বার্ধক্যের অসহায়তা বারবার এসেছে তাঁর লেখায়। ‘কেনারাম বেচারাম’ ও হাসির আড়ালে সেই গল্পই বলে। “টাপুর টুপুর” এর মরালিও খুব প্রিয় আমার। সরলতা–দুর্বলতা নয়। এখানেও প্রতিবাদ, প্রতিরোধের কথা বললেন কী সহজ ভঙ্গিতে। ‘শোভাযাত্রা’য় যে ভাঙনের গল্প বলেছেন, সরসীর চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে কখন যে তা ভেতরে ধারণ করেছি…এমনই তাঁর লেখার ম্যাজিক! রাজদর্শন, পাখি… এমন আরও আছে সেই ছোট্ট তালিকায়। খুব প্রিয় চরিত্র সেসব। আলাদা আলাদা গল্প বলেছেন। বলেই গেছেন।
একসময় ভুল ধারণা ছিল, মনোজ মিত্রর নাটকে বয়স্ক পুরুষ চরিত্রই প্রাধান্য পায়, কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে ওঠে। কিন্তু সে ভুল ভাঙতে দেরি হয়নি। “চাক ভাঙ্গা মধু”, “দর্পনে শরৎশশী”, “নাকছাবিটা”, “মুন্নি ও সাত চৌকিদার” “অলকানন্দার পুত্র কন্যা’’ আরও আরও অনেক নাটকে নারী চরিত্ররা খুবই লোভনীয় যে কোনও অভিনেত্রীর কাছে। সিনেমায় ওঁর শেষ অভিনীত চরিত্র ‘ওঙ্কার’। বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটি। ক্যামেরা শুধু তাঁর মুখটুকুকে ধরছে। সেইটুকু স্পেসে মুখের অভিব্যক্তি, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, সংলাপ… কতখানি শক্তিশালী অভিনেতা আবার বুঝিয়ে দেন। ওঙ্কার যখন বলেন, “.... সবার উপর গল্প সত্য, তাহার উপর নাই। আমাদের কাজ সেই গল্পটা বলা। সিনেমায় না পারি, থিয়েটারে। থিয়েটারে না পারি, বই লিখে। গল্পটা আমাদের বলে যেতে হবে, সৎভাবে…একজন দর্শক থাকলে তার জন্যও বলে যেতে হবে, সমান নিষ্ঠায়। সমান শক্তিতে লিখে যেতে হবে, বলে যেতে হবে, ছবি করে যেতে হবে…”
যেভাবে বলেন, যে গভীর বিশ্বাস থেকে বলেন – শুধু আর সংলাপ থাকে না। হয়ে ওঠে তাঁর বলা কথা। আমরা ঋদ্ধ হতে থাকি। যেমন হয়েছি তাঁর কাজে এতকাল, হতে থাকব আগামীতেও।