মাগরিবের ছায়া

নৈহাটি স্টেশনে বা দিয়ে নিজেকে বড় নিঃসঙ্গ লাগে তারামনের। একবার তার মনে হয়, কখনও কি এতটুকু সঙ্গ ছিল আমার? আবার সেই সঙ্গবিহীন, সঙ্গীবিহীন নিঃসঙ্গ দিন, প্রবলভাবে বেঁচে থাকবার চেষ্টা -এসব দিনগুলো মনের উপর থাবা বসায় তারামনের। ভাবে, বিয়ের পর যখন দু-চারদিন ভোলার সংসার করে তখন প্রথম অসুবিধা ছিল তার ভাষা। বাঙালি ঘরের মেয়ে তারা, হিন্দির '' জানে না। মোজফফরপুরের ইস্কান্দরের বিবি হওয়ার আগে সে দামাদের নাম শুনেছিল, ভোলা। কাউকে কিছু বলতে পারেনি তারামন। কিন্তু বুকের মধ্যে একটা ভয় তার ছিল। ভয় ছিল এটাই যে, তার আব্বু কি দেখে শুনে একটা হিন্দুর সঙ্গে তার নিকা পড়াচ্ছে শেষমেষ? তারা জানত তার হিন্দু বন্ধুদের দৌলতে, শিব ঠাকুরের আরেক নাম 'ভোলানাথ'। তাই তার মনে এই সংশয়। সংশয় থেকে আশঙ্কা। 'ভোলানাথ' ই সংক্ষেপে 'ভোলা'? মুসলমানের এমন হিন্দুয়ানী নাম তো তারা কখনো শোনেনি। তাদের ছেরামপুর গ্রামে দু-তিনঘর তাহলে হাদিস আছে। তাদের চাল চলনের সঙ্গে আর দশ ঘর মুসলমানের চালচলন এতটুকু মেলে না। কেমন যেন মাথা নেড়ে ওরা নামাজ আদায় করে। তারামন বেশ কয়েকবছর আগে হুগলিতে মহরমের সময় গিয়েছিল তার মায়ের খালার বাড়িতে। মায়ের খালার শাদি হয়েছিল বিহারীদের সঙ্গে। ওরা ছিল শিয়া। সেখানে  প্রথম মায়ের খালুজানকে দেখে একটু চমকে গিয়েছিল তারা। মায়ের খালুজানের গোঁফ নেই। অথচ দাড়ি আছে বেশ লম্বা। তারামনের পরিবার সুন্নি। মুসলিম তরকার নানা বেড়াদর দেখবার সুযোগ তখন আর কোথায় হয়েছে তারামনের। তাই শিয়াদের মহরম দেখতেই সেবার আম্মুর সঙ্গে তারার হুগলি যাওয়া। 

 

 

 

মহররমের মাতম যে এভাবে একটা আনন্দের হাটবাজার বসাতে পারে -এটা কল্পনাতেও ছিল না তারামনের। দাদিআম্মার কাছে কতদিন গভীর রাত পর্যন্ত কারবালার সেসব ঘটনার কিসসা শুনত তারামনেরা সব ভাইবোন একসঙ্গে জড়ো হয়ে। মা ফতেমার দুঃখে কত চোখের জলে ভেসেছে সে ওই ছোটকালে। বিবি হাজেরার কিসসা, হাতেম তার কিসসা -এসব শুনে শুনেই মুখস্ত হয়ে গেছিল তারার। পাড়ার মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে তারার আব্বার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল হামিদ মাষ্টারের। ওদের গ্রামে প্রাইমারি ইস্কুলে মাষ্টার হয়ে এসেছে হামিদ। বীরভূমের ছাওয়াল। নৈহাটির বঙ্কিম কলেজের মাষ্টার বসন্ত চক্রবর্তীর একরাতে চল্লিশ হাজার ছেলেকে চাকরি দেওয়ার দলের লোক সে নয়। সেই '৭৮ সালে নিজের যোগ্যতায় চাকরি পাওয়া ছেলে। কংগ্রেস সরকার চলে গেছে তখন। লালেদের সরকার। সেই সরকারের মাথায় জ্যোতি বসু থাকলেও সরকারের গোটা অঙ্গে যারা আছে, তাদের একটা বড়ো অংশ দুচক্ষে দেখতে পারে না মুসলমানদের। মুখে অনেক কথা বললেও কাজে কী করে ঢিট করতে হয় সে বিদ্যের মুন্সিয়ানায় তাদের এ বলে আমায় দেখ তো, ও বলে আমায় দেখ-

 

 

হামিদ মাষ্টারের বৌ একদিন বেড়াতে এল তারামনদের বাড়ি। ততদিনে তারার আব্বার সঙ্গে মসজিদে নামাজ আদায়ের সূত্র ধরে বেশ ভালো আলাপ হয়েছে। হামিদ এ কালে ইস্কুল-কলেজে পড়া ছেলে। আধুনিক ধ্যানধারণা আছে। কিন্তু নামাজ, রোজাতেও যথেষ্ট আস্থা আছে। গ্রামের দুচার ঘর হিন্দু পরিবারের সঙ্গেও হামিদের অল্প কয়েকটা দিনের ভিতরেই একটা বন্ধুত্ত্ব তৈরি হয়েছে। নিজের ইস্কুলের ছেলেমেয়েদের ইস্কুল শেষে সন্ধ্যের দিকে প্রাইভেট পড়ায় হামিদ। পড়ানোর জন্যে কারও কাছ থেকে একটা পয়সা নেয় না। নিতাই বসাক এই গাঁয়ের সিপিএম নেতা। এককালে রাজনীতি করবার জন্যে অনেক খেদমত গুনতে হয়েছে নিতাইকে। দল ক্ষমতায় এসেছে বলে নিতাই সাপের পাঁচ পা দেখেনি। হামিদ যখন এই ছেরামপুর গাঁয়ে মাষ্টারি করতে আসে, গাঁয়ে তখন ইলেকট্রিক ছিল দু-চার ঘরে। নিতাইয়ের বাপ হরিপদ মাষ্টার ছিল মাদরালের একটা ইস্কুলের মাষ্টার। কোনওমতে ধার দেনা করে একটা বড় ঘর তুলেছিল হরিপদ। ঘরের গাঁথনি ইঁটের হলেও মেঝে ছিল মাটির। ছাদ ছিল টিনের। কিন্তু ছেলে মেয়েদের পড়াশুনোটা যাতে একটু হয় তাই ইলেকট্রিক আলো আনবার তাগিদ সে মালুম করেছিল তখনই। কিন্তু একটা ঘরে ইলেকট্রিক আনতে গেলে ইলেকট্রিকের পোল বসাতে শুরু খরচ থাকেই দিতে হবে। ইলেকট্রিক অফিসের লোকেরা হরিপদকে পরামর্শ দিয়েছিল, কয়েকঘর মিলে আলো আনুন। তাহলে পোল বসানোর খরচটা সকলের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে। একজনের আর বেশি পড়বে না। হরিপদ মাষ্টার একদিন কথাটা পাড়ল সন্ধ্যে বেলার মজলিসে। আড্ডা দিতে বসলে গ্রামে গঞ্জে চায়ের চল তখনও বড় একটা হয়নি। কিছু গেরস্তের ঘরে চায়ের রেওয়াজ হলেও গাঁয়ে তখন বেশিরভাগ মানুষই গায়ে গতরে খাটে। কেউ বা মাঠের কাজে। কেউ বা দু-তিন কাঁদি ডাব পেড়ে সাইকেলের হাতলে ঝুলিয়ে চলে যায় কাঁকিনাড়া, ভাটপাড়া, নৈহাটি। আরো কিছুটা এগিয়ে গৌরীপুর পেরিয়ে হালিসহরের দিকেও কেউ কেউ যায়।

           

 

তবে হালিসহর পর্যন্ত গিয়ে বেচাকেনার তেমন একটা সুবিধা হয় না। বর্তির বিলের আশেপাশের মানুষজনেরা বিলের মাছ থেকে শুরু করে ডাবের কাঁদি সবই আনে এখানে অনেককাল আগে থেকেই। সেসব লোকজনদের নিজের খদ্দেরপাতিও অনেককাল ধরেই ধরা আছে। সন্দেরেরাও চেনা ব্যাপারির বাইরে খুব একটা যায় না। আসলে যেতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে না। তাদের হয়ত বা ধারণা হয়, অচেনা ব্যাপারী শেষমেষ একেবারেই ঠকিয়ে দেবে। গলাকাটা দাম নেবে। খারাপ জিনিস দেবে। ওজনের ব্যাপার স্যাপার থাকলে তো কথাই নেই। অচেনা ব্যাপারী মানেই ঠকাবে দাঁড়ি পাল্লায় -এসব ধারণায় নতুন জায়গায় জিনিস বেচতে যাওয়ার মধ্যে গাঁয়ের ব্যাপারীদের বেশ একটা কিন্তু আছে। ছেরামপুরের কিছু কিছু লোক অবশ্য কাঁকিনাড়া, ভাটপাড়া, জগদ্দল, নৈহাটিতে চটকলে যায় কাজের ধান্দায়। এইসব লোকেদের মধ্যে ইকবাল, তুষার, তহমিজের মতো হাতে গোটা এক আধজন মিলের 'পার্মিট' লেবার, মানে পার্মানেন্ট লেবার। স্থায়ী কর্মী হিসেবে এদের মিলে পিএফ আছে। তখনও চটকল থেকে রিটায়ার্ড করা লেবার জমা টাকা পাবে না -এমন 'সুদিন'  আসেনি। ইউনিয়ন থেকে বাবুদের দু-চার টাকা প্রণামী দিয়ে লেবাররা চাকরী শেষে, দু-চার মাস ঘোরাঘুরি করে হকের টাকাটা তখনও ঘরে আনতে পারত। সন্ধ্যেবেলায় ছেরামপুর গাঁয়ে যে মজলিস বসে সেখানে হরিপদমাষ্টার থেকে, খোকা- যার পেশা নারকোল গাছ ঝোরা, ডাব পাড়া- তখন তো আজকের মত ফ্ল্যাট বাড়িতে ছেয়ে যায়নি সদর লাগোয়া মফসসলগুলো। বাড়িঘর ছিল অনেকটা জায়গা জুড়ে। আর একটু জায়গা থাকলেই গেরস্তের অভ্যেস ছিল নারকোল গাছ, সুপুরি গাছ লাগানো। ভাটপাড়ার বামুনদের ঘরে তখন এই নারকোল গাছ ঝোরার খাতিরেই খোকার বেশ খাতির। সেই সঙ্গে মরা গাছ জিইয়ে তুলতেও খোকার খ্যাতি তখন এ তল্লাটে বেশ ভালোরকমই হয়েছে। তারামনের দামাদের ঘরের পাশে বাগচিদের বাড়িতে নারকোল গাছ ঝোরার দৌলতে যবে থেকে খোকার যাতায়াত, তখন তারামনের বিয়ে তো দূরের কথা, মেয়েটা তখন তার বাপের বাড়ির ছোট দহলিজে হামা দিয়ে বেড়ায়।

 

 

গাঁয়ের মজলিসে মাষ্টার, চাষাভুষো, চটকলের কুলি, মসজিদের খতিব, ঘন্টা নেড়ে দু-চার ঘর হিন্দুর বাড়ি যজমানি করে সংসার চালানো পুরুত -সকলেই একসঙ্গে বসে। পড়াশুনো জানা হরিপদ মাষ্টার যেমন একটু খাতির পায় তার ধীর,স্থির,মেধাবী আচরণের জন্যে, ঠিক তেমনই মসজিদের ইমাম সম্ভ্রম আদায় করে নেন আপন ব্যক্তিত্ব বলে। ইমাম তমিজুদ্দিনও কথা বলে কম। ধবধবে সাদা দাড়ি আর ভীষণ মায়া মাখানো চোখের দৃষ্টি দিয়ে ইমাম সাহেব গাঁয়ের সকলের মন জয় করে নিয়েছেন। ভিন-গাঁ থেকে ইমামতির জন্যে এই ছেরামপুরে এলেও এই গাঁয়ের জল বাতাসের সঙ্গে তিনি যেন এক হয়ে গেছেন। (ক্রমশঃ) 

  • গৌতম রায়
  • দ্বাদশ