অরিজিৎ মন্ডল: সালটা ২০০৪, আমার বয়স তখন ১২ বছর, নিজের বাড়ির থেকে অনেক বেশি সময় কাটতো মাসির বাড়িতেই। নিজের বাড়িতে বাবা-মা ছাড়া আর কেউ নেই, বাপ-মার এক সন্তান আমি। নিজের পড়াশোনা করে স্কুল ছুটি থাকলেই মায়ের সঙ্গে সোজা মাসির বাড়ি। অবশ্য মা মাঝে মাঝে বেশ বিরক্ত হত এই প্রতি সপ্তাহে মাসির বাড়ি নিয়ে যেতে। তাই মাঝে মধ্যেই বড়দা এসে নিয়ে যেত। ও বলাই হয়নি, আমার মাসির চার ছেলে, মেসো চাকরি করতেন রেলের একটি বড় সংস্থায়। তিনি ছিলেন ভিষণ উদার প্রকৃতির মানুষ, আর মাসিমাকে পাড়া-পড়শীর মানুষ বলতেন সাক্ষাৎ মা লক্ষী। আসলে মাসিমা প্রতিদিন সন্ধ্যায় মাথায় ঘোমটা দিয়ে বাড়ি থেকে প্রদিপ আর ধুনুচি নিয়ে বটতলায় যেত বাবা মহাদেব কে পুজো করতে। তো ওই প্রদিপের আলোয় নাকি সাক্ষাৎ মা লক্ষীর মত লাগতো তাকে।
একটু প্রতিপত্তি থাকায় গ্রামের মানুষজন মেসো মাসিকে যথেষ্ট সম্মান ও করত। আর দুজনেই ছিল ভিষণ ভালো মনের মানুষ। বাড়ির হাঁড়ি কোনদিন খালি থাকত না। পরিবারের লোকজন ছাড়াও পাড়ার কেউ না কেউ সে বাচ্ছা বা বুড়ো ওই বাড়িতে প্রতিদিন পাত পাড়ত। আর হাসিমুখে তাদের খাওয়াত মাসিমা।
ওই বাড়িতে সরস্বতী পুজো হত ধুমধাম করে। তিন চার দিন আগে থেকেই তোড়জোড় শুরু হয়ে যেত। ফুল যোগাড়, ঠাকুর আনা, হ্যাঁ সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল প্যান্ডেল বাঁধা। না কোন ডেকরেটরর্স কে বলা হত না নিজেরাই করে নিতাম আমরা। পাড়ার ছোট বড় সবাই মিলে আমরা রাত জেগে প্যান্ডেল বানাতাম।
আর আমাকে ভিষণ সাহায্য করতে দীপিকা দি। দীপিকা দি ছিল আমার মাসির বাড়ির ভাড়াটে। দিদি, দাদা, মা, বাবা আর ছোট বোনের সঙ্গে থাকত দীপিকা দি। তার পর পুজোর দি, ভোরবেলা স্নান সেরে মণ্ডপে হাজির। দীপিকা দি কে আমি ডেকে আনতাম প্যান্ডেলে দেখতে না পেলে। তার পর সবাই মিলে অঞ্জলি দিয়ে কুল খেতাম। তার পর দুপুরে জমিয়ে আড্ডা, বটতলার একদিকে মহাদেবের থান অন্যদিকে সরস্বতী পুজো হত। পাশেই ছিল তেঁতুল গাছ। দুপুরে সেখান থেকে তেঁতুল পেড়ে কাঁচালঙ্কা, বিটলবন মাখিয়ে খাওয়ার মজাটাই ছিল আলাদা। দীপিকা দি আমাকে খুব ভালোবাসত, আমার জন্য ঝাল কম দিয়ে মাখিয়ে দিত। জানত আমি কম ঝাল খাই।
সরস্বতী পুজোর পর আসত শিবচতুর্দশী। বটতলায় বেশ বড় করে পুজো হত। সেখানেও আমি, দীপিকা দি আর দাদা-দিদিরা মিলে ফুল সাজানো, পুজোর ফল কাটা, বেলপাতা, তুলসিপাতা, দুর্বা জোগাড় করার কাজে হাত লাগাতাম। রাতে একদিকে বাবার মাথায় জলঢালা হত আর অন্যদিকে চলত সিনেমা। হ্যাঁ সেই ভিসিয়ার ক্যাসেট চালিয়ে ১৮ ইঞ্চির কালার টিভিতে। এই পুরোটাই সেদিন মাসির বাড়ি থেকে বার করে রাস্তার একধারে সেট করা হত সবার জন্য। আমি কখন কি করছি কি খাচ্ছি সবটাই গাইড করত আমার দীপিকা দি।
পুজো ছাড়াও আমি মাসির বাড়ি গেলেও দীপিকা দি কে ডেকে আনতাম, দাদাদের একটা আস্ত ক্যারামবোর্ড ছিল, সেটা বটতলায় পেতে খেলতাম, আস্তে আস্তে বাকিরাও হাজির হত। খেলা শেষ হতেই সবাই চলে যেত বাড়ি। বোর্ড টা তোলার জন্য দীপিকা দি আমাকে হেল্প করত। এটা ভারি বোর্ড তুলতে পারতাম না। মাসিমা বা দাদাদের কাছে বকা খেলেই দিদির কাছে গিয়ে কাঁদতাম। আদর করে দিদি বলত, "ছেলেরা আবার কাঁদে নাকি?" সব আবদার অভিমান ছিল দিদির কাছেই।
তার পর একটু বড় হলাম, নিজের পড়াশোনার চাপ, সঙ্গে পারিবারিক অর্থিক সংকটের কারনে মাসির বাড়ি যাওয়াটা কমে এল। না তখন মোবাইল ছিল না। তাই দীপিকা দির সঙ্গে যোগাযোগ ও করা হয়নি। গেলে দেখা করতাম বসে গল্প করতাম অনেক্ক্ষণ ধরে। ফিরে এলেই খুব মন খারাপ হত৷ আসলে আমার বন্ধু বা দিদি মানে যার কাছে আমি খুব স্বাছন্দ বোধ করতাম সে আমার ওই দিদি। মাঝে কেটে যায় অনেকটা সময়। প্রায় দেড় বছর পর মাসির বাড়ি এলাম। কোনরকমে ব্যাগটা রেখেই ছুটলাম দিদির ভাড়া ঘরের দিকে। গিয়ে দেখি ঘরে তালা মারা। ভাবলাম কোথাও গিয়েছে। তাই হাত মুখ ধুয়ে একটু খেয়ে নিলাম। তার পর সন্ধ্যা হতেই আবার গেলাম, না, এখনো তালা মারা, ভাবলাম রাতে ফিরবে কোথাও গেছে হয়ত সবাই মিলে। ফিরে এলাম ঘরে। রাতের খাওয়া শেষ হল ১০ টা নাগাত, হাত-মুখ মুছে আবার গেলাম, না এখনো ফেরেনি কেউ, তালা মারাই রয়েছে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। হয়ত বেড়াতে গেছে কাল আসবে বলে মনকে সান্তনা দিলাম। ঘুম আসছিল না, এপাশ-ওপাশ করতে করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালে ঘুম ভাঙল মাসিমার ডাকে। উঠেই ব্রাসটা নিয়ে ছূটে গেলাম দিদির ঘরের দিকে। না, কেউ আসেনি যেমন ভাবে তালা মারা ছিল তেমনটাই আছে। খুব কষ্ট হচ্ছিলো, এতদিন পর এলাম দিদির সঙ্গে এখনো দেখা হলনা। সকাল গড়িয়ে দুপুর দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে না তালাটা কেউ খুললনা, ফিরলনা দিদি। রাতে বাবা আসবে বাড়ি ফিরতে হবে। এক অজানা কষ্ট বুকের মধ্যে চেপে ধরে রেখেছে। কোথায় গেল দিদি? কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। বাবা এসে গেছে আর মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে বার হতে হবে। একটু মাজা খাওয়ার নাম করে বের হলাম বাড়ি থেকে, বটতলার কাছে গেলাম যদি চেনা কাউকে দেখতে পাই, যদি কেউ দিদি কোথায় গেছে বলতে পারে। না কাউকেই পেলাম না সেখানে। ফিরে এলাম বাড়ি। বড়দা আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে ডেকে জিজ্ঞেস করল "কী হয়েছে?" বললাম "দীপিকা দি রা কোথায়? ২ দিন ধরে দেখতে পাচ্ছিনা" বড়দা বলল "ওরা তো এখান থেকে ভাড়া ছেড়ে দিয়েছে, চলে গেছে অন্য যায়গায়, কোন ঠিকানা দিয়ে যায়নি"...........
বুকের মধ্যে পাহাড় ভেঙে পড়ল, বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি করব। একটা অসম্ভব কষ্ট বুকটাকে চেপে ধরছিল। দুচোখে জল ভরে এল, হঠাৎ বাবা ডাকল, চল এবার যেতে হবে। চোখের জল চোখে রেখেই বাবার সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ির উদ্দেশে।।