মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে প্রথম নজরুল-জন্মবার্ষিকী এবং ' গণকন্ঠ

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয় দীর্ঘ নয় মাসের রক্তাক্ত যুদ্ধের পরে। ১৯৭২ সাল অর্থাৎ ১৩৭৯ সালের ১১ই  জ্যৈষ্ঠ কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হয় নতুন বাংলাদেশে, নতুন পরিস্থিতিতে। এই উপলক্ষে বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক সংবাদপত্র নজরুলকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। দৈনিক প্রগতিশীল সংবাদপত্র ' গণকণ্ঠ 'বের করে ৮ পৃষ্ঠার একটি বিশেষ ক্রোড়পত্র। বাঙলাদেশের স্বাধীনতার বয়সী এই সংখ্যাটা এতদিন আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখা ছিল। ইদানীং বয়সের ভারে এর পৃষ্ঠা জীর্ণ হয়ে পড়েছে। ধরতে গেলে পাতা ঝুর ঝুর করে খসে যায়।  কোথাও আবার কিছু কিছু  অক্ষর কিট অবহেলার সুযোগে গিলে ফেলেছে। কালের গ্রাস থেকে রক্ষার এখন একমাত্র উপায় এর অন্তর্গত পাঠ-পর্যালোচনা। এই বিবেচনা থেকেই নজরুল ইসলামের একশ পঁচিশতম জন্মবার্ষিকীতে এই বিশেষ সংখ্যাটির পরিচিতি তুলে ধরার তাগিদ  অনুভব করি । কেননা এই সংখ্যাটির স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক সাগর রক্ত পেরিয়ে আসা একটা দেশের মুক্তির কথা।


১৯৭২ সালে রচিত বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে চারটি মৌল স্তম্ভের মধ্যে গরীব মানুষের মুক্তির কথা লেখা আছে ' সমাজতন্ত্র ' শব্দটির সঙ্গে। ' গণকণ্ঠও' তার এই নজরুল ইসলামবিষয়ক ক্রোড়পত্রে বিন্যস্ত লেখাগুলোর বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এই 'সমাজতন্ত্রকেই' মানদন্ড করেছিল। পত্রিকার বিভিন্ন লেখা নিয়ে আলোকপাত করার আগে আমরা একবার ক্রোড়পত্রের পৃষ্ঠাগুলো উল্টেপাল্টে দেখে নেবো। প্রথম পৃষ্ঠায় অর্ধ পাতা জুড়ে ছড়িয়ে আছে শিরোনাম : 'এগারোই জ্যৈষ্ঠ ১৯৭৯ নজরুল জন্মবার্ষিকী বিশেষ সংখ্যা গণকণ্ঠ।' এর বা পাশে আছে শিল্পী মোস্তফা মনোয়ারের নির্মিত নজরুল ইসলামের আবক্ষ ভাস্কর্য মূর্তির দুটি ছবি। বাকি অর্ধেক অংশে আছে আতাউর রহমানের প্রবন্ধ ' সাম্যবাদী নজরুল 'লেখাটির বাকি অংশ দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় গিয়ে শেষ হয়েছে। সঙ্গে আছে একটি ছবি। তার ক্যাপশনে লেখা আছে : 'বিদ্রোহী কবি নজরুলের জীবনীচিত্রের শিল্প-নির্দেশে ছিলেন শিল্পী কামরুল হাসান।' এখানে দেখা যায় কামরুল হাসান ছবি আঁকছেন। এর ডান দিকে আছে দুটি কবিতা :  ১. 'সেই কবি, নজরুল।' কবি অরূপ তালুকদার ; ২. 'নজরুল স্মৃতির উপমা।' কবি কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী । নিচে প্রবন্ধ আছে শেখ আকিম উদ্দীন আহাম্মদের      ' নজরুলকে নিয়ে'লেখাটি শেষ হয়েছে সাতের পাতায়। তিনের পৃষ্টায় আছে অধ্যাপক এনামুর রহমানের প্রবন্ধ          ' নজরুল কাব্যে গণকণ্ঠ ' সঙ্গে নজরুল ইসলামের একটি ছবি। এ ছাড়া আছে সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের লেখা     ' নজরুল প্রসঙ্গে 'সঙ্গে কবিপুত্র সব্যসচীর ছবি। এ ছাড়াও আছে তিনটি কবিতা। ' নজরুলের বেঁচে থাকা ' কবি আবু বকর সিদ্দিক। শামসুর রাহমান লিখেছেন  'কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি 'এই পৃষ্ঠার শেষ কবিতা ' নজরুল ' লিখেছেন কবিবন্ধু পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় । আর আছে একটা ছবি পুলিশ ইন্সপেক্টর রফিকউদ্দিনের স্ত্রীর, যিনি নজরুলকে আসানসোলের রুটির দোকানে খুঁজে পেয়েছিলেন এবং ময়মনসিংহ নিয়ে গিয়ে সন্তানবৎ মানুষ করেছিলেন।


চতুর্থ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত হয়েছে আহমদ শরীফের ' নজরুল কাব্যে বীর ও বীর্য প্রতীক ' প্রবন্ধের অংশবিশেষ। এই লেখাটি প্রথমে প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে দেশের দুর্বার। গণ-অন্দোলনের সময়ে দৈনিক ইত্তেফাকের নজরুল সংখ্যায়। এই পৃষ্টায় ছাপা হয়েছে মঞ্জুশ্রী চৌধুরীর প্রবন্ধ ' নজরুল কাব্যে ধর্ম ' রায়েছে নজরুলের কবিতার চারটি উদ্ধৃতি। পাঁচের পৃষ্ঠায় প্রবন্ধ লিখেছেন ফজলুল কাদের কাদেরী ' কবি নজরুল ইসলাম : একটি অসাধারণ নাম এক অনন্য প্রতিভা ' শিরোনামে । সঙ্গে নজরুলের ছবি। কবিতা লিখেছেন অমূল্য সরকার ' আমার সান্ত্বনা হয়ে ।' 'নজরুলের কবিকন্ঠ' শিরোনামে প্রবন্ধ লিখেছেন আবুল ফজল। রয়েছে নজরুলের একটি কবিতার কোটেশন । ছয়ের পৃষ্ঠায় আছে নজরুল বিষয়ে লিখিত দুটি বইয়ের পর্যালোচনা। শিরোনাম :          ' নজরুলের ওপর লেখা দুটি অনবদ্য বই ' জ্যৈষ্ঠের ঝড় এবং নজরুল বিচিত্রা। সঙ্গে আছে বই দুটির কভারের ফটো। কবিতা আছে তিনটি, যথা ' চিরোজ্জ্বল এই গ্রহ' ( নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ),          ' নজরুল : জন্মদিনে' ( সিকান্দার আবু জাফর), ' নজরুল ইসলাম' ( আতাউর রহমান)। একদম ওপরে আছে একটি ছবি। ক্যাপশনে লেখা আছে : 'নজরুলের জন্মদিনে সঙ্গীতশিল্পী জপমালা ঘোষ নজরুলকে মালা দিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাচ্ছেন। তিনি সম্প্রতি নজরুলের ' লিচু চোর ' কবিতাটি রেকর্ড করেছেন।'


সাতের পৃষ্ঠায় প্রবন্ধ আছে দিলওয়ারের ' বর্তমানের কবি আমি ভাই ' আছে দুটি কবিতা : ' এসো কবি মালা দেবো ' ( মনোয়ার হোসেন জাহেদী) এবং ' একটি     সৈনিকের কবিতা ' ( গৌতম সেনগুপ্ত)। অষ্টম পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে রমেন দত্তের লেখা ফটো-ফিচার : ' সেই রঙিন নজরুলের খবর কি ? ' সঙ্গে ফটো রয়েছে আটটি।


পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন প্রবন্ধ ও কবিতায় নজরুল ইসলামের প্রগতিশীল মনন, সাম্যবাদ নিয়ে তাঁর নিজস্ব চিন্তা এবং কবিতায় তার প্রতিফলন, কবির রাজনৈতিক মতাদর্শ ও বিশ্বাস, রাজনৈতিক জীবন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাঁর অবদান, শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতায় উদ্বেগ উইপ্রকাশ , কবির ধর্মনিরপক্ষতা, তাঁর ধর্মচিন্তা, সম্প্রীতির বন্ধন ইত্যাদি নানান বিষয় বিম্বিত ও বিশ্লেষিত হয়েছে। প্রথম প্রবন্ধ  আতাউর রহমানের                  ' নজরুলের সাম্যবাদ, এই সংখ্যার সবচেয়ে দীর্ঘ রচনা। এতে লেখক সমকালের বঙ্গদেশের বামপন্থা, কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের মুক্তি নিয়ে মুজফফর আহমদের পার্টি গঠন, নজরুলের সম্পৃক্ততা, মার্ক্সীয় সাম্যবাদী দর্শন ও নজরুলের সাম্যবাদের মধ্যেকার পার্থক্য নির্দেশ করে কিভাবে তা তাঁর কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে, লেখক তার স্বরূপ অনুসন্ধান করেছেন।


দ্বিতীয় পৃষ্টায় পাঁচ কলাম  জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লেখাটা শেষ হয়েছে। অরূপ তালুকদার তাঁর কবিতা ' সেই তুমি, নজরুল '-এ বলেছেন ,  কবির যে চোখ ' কখনও প্রদীপ্ত ', কখনও শিশির সিক্ত আর বেদনায় নীল ' কিংবা 'যে নিষ্ঠুর হাতে' 'বিদ্রোহের বিমূর্ত শব্দাবলী,' 'তোমার তুর্যের নিনাদে মুহূর্তে ভাঙ্গে বিশাল দুর্মর প্রাকার' 'সেই তুমি,  নজরুল পদ্মার তীরে তীরে ঘুরে যাবে নাকি আরবার?' মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ দেখে যাওয়ার আহ্বান জানান কবি।


দ্বিতীয় পৃষ্ঠার শেখ আকিম উদ্দীন আহম্মদের  'নজরুলকে নিয়ে ' প্রবন্ধে লেখক নজরুলের দায়বদ্ধতা ও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে নজরুল ইসলামের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোকপাত করেছেন। তিনি লিখেছেন : '  আমরা আজ স্বধীন হয়েও যে যুগ - সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছেছি, তাতে নজরুলের মতো একজন বিদ্রোহী তেজোদীপ্ত পুরুষের নেতৃত্ব একান্ত প্রয়োজন। কবির কবিতা বিশ্লেষণ করে করে লেখক দেখিয়েদিয়েছেন ব্রিটিশ আমলে তাঁর দায়বদ্ধতার কথা। সাতের পৃষ্ঠায় প্রবন্ধের শেষে লেখক বলেছেন : ' কবি আজ দুরারোগ্য ব্যাধির কবলে। সাগর ঘেরা নদী মেখলা সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলিমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। যে দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে উন্নতশিরে, উচ্চকন্ঠে, স্বধীন চিত্তে মুক্ত আকাশের নীচে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলে, সেই দেশের আকাশ-বাতাস, সাগর, নদী, বন বনানী, আজ স্বাধীনতার উজ্জ্বল আলোতে দীপ্তিমান। হে মৌন ধ্যানী কবি --- আজ তোমার অভিযান শেষ হয়েছে --- যাদের তুমি স্বাধীণতা সংগ্রামে মুখর করে তুলেছিলে --- যাদের তুমি অগ্রপথিক, অগ্রনায়ক আখ্যায়িত করেছিলে আজ তারা তোমাকে হাতছানি দিয়ে উদাত্ত কন্ঠে আহবান করছে -- তুমি এসো।'


বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে নজরুল ইসলামের কবিতা এবং গান সংগ্রামী মানুষের রক্তে যে উন্মাদনা ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল, যুদ্ধোত্তোর          বাংলাদেশের পুনর্গঠনের সময়েও তেমনি কবির কবিতা ও গান হোক জনগণের জনগণের সাংস্কৃতিক অস্ত্র , লেখক বার বার সেই কথাটিই বলেছেন তার এই প্রবন্ধে।


চতুর্থ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছে আহমদ শরীফের ' নজরুল কাব্যে বীর ও বীর্য প্রতীক ' লেখক প্রবন্ধে বলেছেন :        ' নজরুল ছিলেন বিপ্লবী ও বিদ্রোহী।' তাই ' সামাজ ও ধর্মবুদ্ধির সংস্কারে, আর্থিক জীবনের রূপান্তরে এবং রাষ্ট্রীয় স্বাধীণতা অর্জনে তাঁর আকুতি-আকুলতার তীব্রতাই তাঁকে ' মারি অরি পারি যে - কৌশলে ' মতে প্রবর্তনা দিয়েছিল। এসব কিছুর মূলে রয়েছে শোষিত-পীড়িত মানুষের প্রতি দরদের গভীরতা।' লেখক বলেছেন :    ' তাঁর কল্পনা উদ্দীপ্ত হয়েছে রণ, রক্ত, রুদ্র, শক্তি, ঝড়, সূর্য, বহ্নি, মৃত্যু প্রভৃতি অবলম্বনে। এগুলোকে তিনি বল - বীর্যের প্রতীকরূপে গ্রহণ করেছেন।' মঞ্জুশ্রী চৌধুরী লিখেছেন : ' নজরুলের কাব্যধর্ম ' লেখক তাঁর প্রবন্ধে বলেছেন যে, নজরুলের কবিতার মূল সুর মানবিকতা। তাই ' নজরুলের কাব্যজগত -- বিশ্ব- মানবতার মহামিলন ক্ষেত্র।' তিনি বলেছেন : ' কাব্যের মাধ্যমে নজরুলের সামজবিপ্লব, মানুষের অধিকার স্বীকার করে নেবার, স্বীকার করিয়ে নেবার বলিষ্ঠ চাতুর্য, সমাজতান্ত্রিকতার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত --- বাংলাসাহিত্যের গণমুখী ভাবধারা পুষ্ট আভিজাত্যকে প্রতিষ্ঠা করেছে। ' ধর্মনিরপেক্ষ এক গভীর মনন সারা জীবন কবিকে স্নাত করে রেখেছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তাঁকে আন্তর্জাতিক এক মানবিক বোধে উন্নীত করেছে।



পাঁচের পৃষ্ঠায় ফজলুল কাদের কাদেরীর তাঁর ' কবি নজরুল ইসলাম : একটি অসাধারণ নাম এক অনন্য প্রতিভা ' শীর্ষক প্রবন্ধে সাধু ভাষায় বলেছেন : ' নজরুলের বিদ্রোহী মন প্রচলিত রীতিনীতি ও সংস্কারের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়া ছিল। অত্যাচারিত, নিপীড়িত লাঞ্ছিতদের মুক্তির বাণী, আশার বাণী তিনি           শুনাইয়াছেন।' বিশিষ্ট কথাশিল্পী আবুল ফজল তাঁর প্রবন্ধ 'নজরুলের কবিকন্ঠে ' নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা বিশ্লেষণ করেছেন এই ভাবে : ' কবির কন্ঠস্বর আজো পুরোনো হয়নি।, তাঁর প্রয়োজন আজো হয়নি নিঃশেষিত। বরং তার প্রয়োজন যেনো আরো বেশি করে দেখা দিয়েছে। যে সামাজিক পরিবেশে নজরুল এসব কবিতা লিখেছিলেন, তার কোনো রূপান্তর ঘটেনি, অধিকন্তু অবক্ষয় রূপ নিয়েছে আরো সর্বগ্রাসী  এখন। এ পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয় একমাত্র নজরুলের কবিকন্ঠই হতে পারে আমাদের দিশারী। ' কবি অমূল্য সরকার তাঁর ' আমার সান্ত্বনা হয়ে' কবিতায় যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে নজরুল ইসলামকে তাঁর স্বপনের বঙ্গভূমির কথা বলেন। তিনি বলেন : ' তুমি কি দেখছ।/ কীরকম অসম্ভব ভালবাসা বেশে/ এদেশ তোমার কৃষ্ণচূড়া হলো --/ তোমার গানের পাখী,/ তোমার ইচ্ছার, তোমার সাধের আকাঙ্ক্ষার স্বপ্ন,/ তোমার পাপড়ি রাঙ্গা এই বাংলাদেশ।' কবি নজরুল ইসলামের চেতনার উত্তরাধিকারের কথা বলেন এই ভাবে : ' কেবল এখনো আছে আমার ছেলের হাতে আমার সান্ত্বনা /দৃঢ়বদ্ধ একখানা অগ্নিবীণা।'


            ছয়ের পৃষ্ঠায় আছে দুটি বইয়ের বর্ণনাত্মক পর্যালোচনা এবং তিনটি কবিতা। 'নজরুলের ওপর লেখা দুটি অনবদ্য বই ' শিরোনামের এই রচনায় অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত রচিত নজরুল ইসলামের জীবনী       ' জ্যৈষ্ঠের ঝড়' এবং সাহিত্যম থেকে প্রকাশিত নজরুলের সব ধরনের এক রচনা-সংকলন ' নজরুল বিচিত্রা ' নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এই রিভিউয়ে লেখকের কোনো নাম নেই। কবি সিকান্দার আবু জাফর লিখেছেন কবিতা ' নজরুল : জন্মদিনে 'কবি তাঁর কবিতায় নজরুলের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের গুণ কীর্তন করেছেন এই ভাবে : ' শান্তিহারা প্রাণের ডালায় অগ্নিজ্বালা কুড়িয়ে নিয়ে/ ত্রস্ত পায়ের ধূলায় যতো ভয়ের বাধা/ উড়িয়ে দিয়ে/ আচম্বিতে মূর্ছা ভাঙার কলধ্বনি/ এনেছে সে,/ তাঁর দেওয়া সেই অভাবিত ঋণের দলিল/ছিঁড়বে কে?' কবি এইভাবে পর্যায়ক্রমে নজরুলের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। কবি আতাউর রহমান তাঁর ' নজরুল ইসলাম' কবিতায় নজরুল ইসলামের ভেতরের সত্তার মুখচ্ছবি আমাদের দেখিয়ে দেন। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় কথাসাহিত্যিক। কিন্তু তিনি কবিতা লিখেছেন নজরুলকে নিয়ে 'চিরোজ্বল গ্রহ ' শিরোনামে। কবি নজরুলকে 'রবীন্দ্রনাথের সৌরমন্ডলে একটি চিরোজ্বল গ্রহ' বলে অভিহিত করেছেন।


সাতের পৃষ্ঠায় রয়েছে কবি দিলওয়ারের প্রবন্ধ ' বর্তমানের     কবি আমি ভাই'তিনি নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা বিশ্লেষণ করে বলেছেন : ' নজরুলের গণমুখী কবি - চেতনার কাল আমরা এখনো পেরোতে পারিনি। তাঁর সৃষ্টির তাই আমাদের ভীষণ প্রয়োজন।' কবি মনোয়ার হোসেন জাহেদী তাঁর ' এসো কবি মালা দেবো ' কবিতায় যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন : ' আবার তুমি এসো হে ' উড়নচণ্ডী কবি নটেশ '/ দেখে যাও, এদেশে গেস্টাপো পেতেছিলহিংস্র জাল।/ তুলেছিলো মানুষের রক্ত মাংসে পৈশাচিক কার্নিভাল।' তিনি আরো বলেছেন : ' তবু তুমি এসো, দেখে যাও/ত্রিশ লক্ষ প্রাণের রক্ত জমাট মাটি থেকে --/ অংকুরিত কয়েকটি টিউলিপ অথবা রক্ত গোলাপ দিয়ে/তোমাকে মালা দেবো একটি নবজাত দেশ/তার নাম বাংলাদেশ।'



এই বিশেষ সংখ্যার আটের পৃষ্ঠা বা শেষ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে রমেন দত্ত-রচিত একটি ফটো-ফিচার ' সেই রঙিন নজরুলের খবর কি?'   নজরুল ইসলাম ছিলেন বিপ্লবী ও বিদ্রোহী। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক এবং ধর্মনিরপেক্ষ। কিন্তু ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্বর ভিত্তিতে জন্ম নেয়া পাকিস্তান- আমলে তৎকালীন শাসকশ্রেণি নজরুলকে মুসলমানিকরণের জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। তারা নজরুলকে নিয়ে তাঁর জীবনভিত্তিক একটা রঙিন সিনেমা বানায়। সেই সিনেমায় নজরুলকে পুরোপুরি মুসলমান হিসেবে তাঁকে দেখানো হয়েছে। এই সিনেমা বানানোর কাজে বাংলাদেশের  বেশ কিছু বিশিষ্ট মানুষকে যুক্ত করা হয়েছিলো। ছিলেন চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদীন, কামরুল হাসান এবং ভাস্কর মুস্তাফা মনোয়ার  প্রমুখ। এবং পরিচালক ছিলেন মেহবুব রহমান । মুক্তিযুদ্ধের পর নবগঠিত সরকার নজরুলকে ১৯৭২ সালের ২৪ মে ভারত সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে স্থায়ীভাবে ঢাকায় নিয়ে যান। তিনি হন বাংলাদেশের জাতীয় কবি। ১১ই জ্যৈষ্ঠ বাংলাদেশে তাঁর প্রথম জন্ম দিন পালিত হয় জাঁকজমকের সঙ্গে। সেই দিন তিনি ঢাকায়। আর ওই দিনই প্রকাশিত হয় এই বিশেষ সংখ্যাটি।


প্রতিবেদক লিখেছেন যে, এই ফিল্মে নজরুলের জীবন চিত্রিত করতে গিয়ে বিকৃত করা হয়েছে। তিনি লিখেছেন : ' অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত এই উদ্যোগ জনচিত্তে সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হয়েছে। নজরুলের প্রকৃত স্বরূপকে বিকৃত করে তাঁকে ইসলামী ভাবাদর্শের ধারক এবং সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির কবি হিসেবে চিত্রিত করার অপচেষ্টা ঐ ছবিতে যথেচ্ছভাবে অনেক অলীক দৃশ্য ও ঘটনার অবতারণা করা হয়েছে।'


ফিল্মটি বানাতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হয়েছিলো। অভিনয়- শিল্পী ও চিত্রশিল্পীদের সাম্মানিক না দিয়ে বরং তাঁদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। কিছু সাংবাদিককে তখন সিনেমাটিকে দেখানো হয়েছিলো। কিন্তু তাঁরা এর বিরুদ্ধে তাঁদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। প্রতিবেদক বলেছেন , সেই সিনেমাটি এখন খুঁজে বের করে পরিবর্তিত পরিস্থিতে এর ভুল এবং ভ্রান্তি পরিহার করে,নুতন করে,  রিমেক করে, জনগণের কাছে নিয়ে আসা দরকার। কেননা একদা বাংলাদেশের বিশিষ্ট চিত্রশিল্পীদের তুলির আঁচড় পড়েছিল এই সেলুলয়েডে। গণকণ্ঠ-পত্রিকার এই বিশেষ সংখ্যাটা ঐতিহাসিক বিচারে একটা বিশেষ সময়কে ধারণ করে আছে। তাই এর গুরুত্ব অপরিসীম।

  • চিত্ত মণ্ডল