একটা প্রাচীরের কাছে এসে টোটোওয়ালা টোটোটা থামিয়ে দিলেন হঠাৎ। বললেন, নামুন দিদি। একটা জিনিস দেখাই।
সামনে সাদা প্রাচীরখানা অনেকখানি লম্বা। নামলাম। পায়ের কাছে গোটা তিন চার আলগা ইট দেখিয়ে দিয়ে বললেন, এতে ওঠেন দেখতে পাবেন। উপর দিয়ে উঁকি মেরে অবাক হয়ে গেলাম। একটা স্টেশন। স্টেশনের নামটা চেনা। কিন্তু স্টেশনের সাইনবোর্ডের রঙটা অচেনা। হলুদ নয় সাদা। লেখাটা সাদায় কালো দিয়ে। স্টেশনটা হিলি। প্ল্যাটফর্মে শেড নেই। ঘাস মাটির প্ল্যাটফর্ম। বৌ বাচ্চা লোকজন বসে আছে ব্যাগপত্র নিয়ে মাটিতেই। বন্দুকধারি পাহারা দিচ্ছে। দু এক মিনিট কাটার সাথে সাথে একটা ট্রেনের শব্দ। আস্তে আস্তে দাঁড়িয়ে পড়ল ট্রেন। গাড় সবুজ রঙের ট্রেনখানা।
ওটা বাংলাদেশের ট্রে…ন। ওটা বাংলাদেশের ট্রে…ন।
ট্রেনের শব্দের মাঝে শুনতে পাচ্ছি কথাটা। টোটো চালক পিছন থেকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছেন।
হঠাৎ এরকম বিদেশের একটা স্টেশন ট্রেন যাত্রী এতো কাছ থেকে জাস্ট একটা প্রাচীরের ওপর দিয়ে উঁকি মেরে দেখতে পেয়ে কিরকম অবাক হয়ে গেলাম। আরও একটু অবাক হলাম পায়ের দিকে চোখ পড়ায়। একখানা সাদা রঙের পিলার। ছোট। তিন কোনা ধরণের। সেই পিলারের গা দিয়ে উঠে গেছে প্রাচীরটা। পিলারের গায়ে কালো দিয়ে খোদাই করে লেখা বাংলাদেশ। নিচে বাংলায় কিছু নম্বর কিছু অক্ষর। আসলে আমি দাঁড়িয়ে আছি ভারত বাংলাদেশের ঠিক মাঝখানে।
যে পথ দিয়ে এখানে এসে পৌঁছোলাম পাশে শুধুই পরপর ট্রাক দাঁড়িয়ে ছিল। মাল বোঝাই ট্রাক। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ট্রাকগুলো। এই বেশ অনেকখানি পথে কোনও ট্রাককে একবারও স্টার্ট দিতে দেখিনি। রাতভোরে মালদা থেকে বাস ছেড়ে সকালবেলা বাস এসে পৌঁছেছিল বালুরঘাট বাসস্ট্যান্ড। তারপর আবার বাসে হিলি বাসস্ট্যান্ড। সেখান থেকেই এই টোটো চালকের সঙ্গে আলাপ। সেই থেকে টোটোতে করে যে এলাকায় এদিক সেদিক ঘুরছি সেটা হিলি। কিরকম অদ্ভুত যেন ব্যাপারখানা! এ জায়গারই একখানা স্টেশন। একই নামের স্টেশন। কয়েক মিটার দূরেই। অথচ কারো কোনও ট্রেন ধরার তাড়া নেই। কেউ ব্যাগ কাঁধে ট্রেন ফেল করার আশঙ্কায় ছুটছে না। রিকশ সাইকেল বেল বাজাচ্ছে না স্টেশনে ঢোকার তাড়ায়। ট্রেন ধরতে হবে বলে কেউ চেঁচিয়ে উঠছে না পাশের লোকটার উপর। পেছন থেকে আবার চিৎকার। নেমে আসুন দিদি তাড়াতাড়ি। এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো যাবে না। ঝামেলা হয়ে যাবে মিলিটারি চলে এলে।
ওই যে পরপর ট্রাক অপেক্ষা করে আছে একটু দূরে এগিয়ে যেতেই বুঝলাম ট্রাকগুলো বাংলাদেশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু দূর এগিয়েই রেলগেট। রেলগেট আর দেশের চেকপোস্ট একসাথে। ওই রেলগেটের ওপার দিয়েই ওদেশের ট্রেন পাস করে হিলি স্টেশনের দিকে চলেছিল। ট্রাকগুলো মাল নিয়ে চলে যাবে ওপারে। পারমিট করানোর জন্য ওভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, সকাল থেকে বিকেল বা মাঝেমাঝে রাত কাবার করেও দাঁড়িয়ে থাকবে হয়ত।
সেই সকাল থেকে এই পড়ন্ত বেলা অবধি যিনি হিলির এসব গল্প করে আসছেন তিনি হিলির এই টোটো চালক নিহারবাবু। আসতে আসতে তিনি রোডের ধারে বড়সড় একখানা দাঁড়িয়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের ট্যাঙ্ক দেখিয়েছিলেন। নতুন করে রঙ হয়েছে। মোড়ের মাথায় চারপাশে ফুলগাছ লাগিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা। ছোটবেলায় মুক্তিযুদ্ধ চোখে দেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় এপারের হিলিতেও ক্যাম্প হয়েছিল। সেনারা এপার থেকে যুদ্ধ করেছিল। এপাশে আশ্রয় নিয়েছিল। এপারের মানুষ যোগ দিয়েছিল ওদেশের মুক্তিযুদ্ধে। কখন কখন গুলির আওয়াজ পাওয়া যেত, ওপারের কোন কোন এলাকা থেকে শহীদ হয়ে চলেছিল তাজা তাজা প্রাণেরা সব ইতিহাস আউরে চলেছেন। টোটো যত এগোচ্ছিল নিহারবাবুর গল্পে হিলিকে তত চিনছিলাম। রাতের পর রাত অন্ধকারে মিটিং। হ্যারিকেনের আলো। আহত মুক্তিযুদ্ধের সেনাদের ঘরের মেয়েদের ছেঁড়া শাড়িতে গরম জলে ব্যান্ডেজ করে দেওয়া। বড় বড় কড়াইতে মুক্তি যুদ্ধের সেনাদের রান্নাকরে দেওয়া। এসব স্মৃতিগুলো এই অচেনা যাত্রীটিকে বলতে পেরে বারবার বক্তার গলার স্বরে হাসি হাসি ভাব ফুটে উঠছিল পেছনের সিটে বসেই আন্দাজ করতে পারছিলাম।
ওই রেলগেটের আগে দু তিনটি পাড়া ঘুরে এসেছি। আসা অবধি যতগুলো পাড়ায় গলিতে ঘুরছি যতবার টোটো থামিয়ে জিজ্ঞাসা করেছি এ পাড়া থেকে কেউ বাইরের রাজ্যে লেবারের কাজে যায় কিনা, বারবার একটাই উত্তর কানে এসছে। হ্যাঁ তো। বলেই ভাষাটা কিরকম অচেনা হয়ে গেছে। বাকিটা আর বুঝতে পারিনি। ওগুলো আদিবাসীপাড়া, বললেন নিহারবাবু।
রেলগেটের ওপরের ও দেশ দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। ওপারটা দিনাজপুর। এ পারটা দক্ষিণ দিনাজপুর। মানুষ ব্যাগ বোঁচকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এপারে আসার জন্য। আর এপাশেও রেলগেটের পাশে লাইন পড়েছে। চেকিং হবে দুপাশে। বিএস এফ বি ডি আর রাইফেল। দু দেশের সীমান্তের পিলার। জাল দেওয়া চেকিং খুপড়ি। মুখে কথা কম কম।
রেলগেট ছেড়ে আমরা বর্ডারের রোড দিয়ে এবার এগিয়ে চলেছি। রাস্তাটা একেবারে ফাঁকা। দুপাশে দূরে দূরে গাছ। এবার দূরে একখানা বন্ধ হওয়া রাইসমিল দেখিয়ে দিলেন নিহার বাবু। আবার থামল টোটো। কাছে এগিয়ে গেলাম। এপাশ ওপাশ দিয়ে জংলা গাছ ঘিরে ধরেছে রাইসমিলটাকে। দরজা জানালা ইট কাঠ মেশিনপত্র ভেঙে পড়েছে। অনেক কিছু চুরি হয়ে গেছে। অনেককিছু তুলে নিয়ে গেছে। আমি বাইরে থেকে দেখার চেষ্টা করে যাচ্ছি জঙ ধরা অবশিষ্ট কলকব্জা। সেই ভগ্নস্তুপ রাইসমিলের যেখানে দরজা আঁটা থাকত সেগুলো এখন ফাঁকা। সেই ফাঁকগুলো দিয়ে দেখা যাচ্ছে সেই বাংলাদেশের রেললাইনটা।
রাধাকৃষ্ণ রাইস মিল। উনি বলে চলেছেন, আগে এই রাইসমিলের খুব নামডাক ছিল। দুপার থেকেই ট্রাকে করে ধান আসত এই রাইস মিলে। লড়ি লড়ি চাল ভাঙিয়ে নিয়ে যেত দূর দুরান্ত থেকে। তারপর আস্তে আস্তে মিলিটারি চেকিং বাড়ল। গাড়ির ধান নামিয়ে চেকিং হত। ঝামেলা বেড়ে গেল এই মিলে ধান আনা ধান ভাঙানো। তারপর বন্ধ হয়ে গেল রাইসমিলটাই। এই একখানা না্কি! অনেককটা রাইসমিল ছিল। কত মানুষ কাজ করত রাইসমিলে। যখনই বর্ডারের কড়াকড়ি বাড়তে শুরু করল। আস্তে আস্তে রাইসমিলগুলো বন্ধ হয়ে গেল। আসলে নানা সন্দেহ!পাচারের মাল আসে নাকি। কোন লোক ঢুকছে! ধান ভাঙতে এসে কে অতো ঝামেলা পোয়াবে?
ভাঙা রাইসমিলটা ছেড়ে বর্ডার রোড দিয়ে আবার চলেছি। এখানে কাঁটাতারের হাইট ছোট। কোথাও বসানো হচ্ছে সবে। রাস্তার পাশে সাপের মতো পেঁচিয়ে থাকা কাঁটাতারগুলো পড়ে আছে। খাঁ খাঁ একটা রাস্তা। আশপাশের গাছগুলোর রঙ উত্তর ২৪ পরগনার গঢ় কালো সবুজের মতো নয়। কেমন একটা ছাড়া ছাড়া ভাব ডালে পাতায় মিলে। থামিয়ে দিলেন টোটো। কাঁটাতারের ওপারে একখানা পাড়া দেখিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলেন। ওটা জিরোপয়েন্ট। টোটো থেকে নেমে পাহারাদারের সাথে কথা বলে নিয়ে গেলেন পাড়াটায়। বর্ডার রোড থেকে পাড়াটার দিকে মুখ করে হাঁটতে হাঁটতে সামনের দিকে তাকালে আবার দেখা যাচ্ছে সেই রেললাইনটা। তারপর ওদেশের মাঠ। এ পাড়াটার নাম হিন্দু মিশন পাড়া। বিশাল সাইজের একখানা বটগাছের ছায়া রেললাইন ক্রস করে মানুষেরগড়া এই সীমারেখাকে উপেক্ষা করে ওদেশে পৌঁছে গেছে। পাড়ার মানুষের মুখগুলোর ধরণ ট্রাইবাল টাইপের। মোটা ঠোঁট। চোয়াল উঁচু।এ পাড়া থেকে অন্য রাজ্যে কতজন বাইরে যায় প্রসঙ্গটা সবে উঠেছে তখন পাড়ার লোকেদের সাথে। হঠাৎ একটা রেলগাড়ির শব্দ। দরজায় লোক বসা। জানালা দিয়েও প্যাসেঞ্জার দেখা যাচ্ছে। ইলেক্ট্রিক ট্রেন নয়। চোখটা ওদিকে চলে গেল সবার।
হ্যাঁ যায় তো, এ পাড়ার পেরায় সব ঘর থেকেই এখন বিদেশে লেবারের কাজে গেছে। সবে কথাটা শুরু হচ্ছে মাঝে কোথা থেকে লম্বা লম্বা মানুষ ঢুকে পড়ল পাড়ার ভেতর। মুখগুলো পাড়ার লোকের থেকে পুরোপুরি আলাদা। এরা সীমান্তরক্ষী। আমাকে পাড়ায় ঢুকতে দিলেও দূর থেকেই আমাকে ফলো করছিল বুঝতে পারলাম। হঠাৎ মাঝে ঢুকে পড়ায় বক্তারা সবাই গেল থেমে। এই হঠাৎ ঢুকে পড়া দলটা আমাকে বেশ গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করে বসল, আপকো জো পুছনে থা হো গায়া? বেরোন বেরোন।
খানিকটা তাড়া করার মতোন করে বের করে দিলেন। এ পাড়ার বিশেষত্ব জানলাম টোটোতে যেতে যেতে। এ পাড়াটা এখন সাধারণের জন্যে প্রবেশ নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে। আগে হিলিতে এমনটা ছিলনা। জিরো পয়েন্টেও মানুষ ঢুকতে পারত। এই কাঁটাতার নতুন বসছে। কড়াকড়িটাও এখানে নতুন প্রকৃতির। এ পাড়াটাই ছিল এক সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান। ওই যে বড় বটগাছটা বারবার কথা বলতে বলতে চোখে পড়ছিল ওই গাছতলাটায়। ওই গাছতলাই ছিল একটা সময় মুক্তি যোদ্ধাদের মিটিং করার জায়গা। রোজ যখন বেলা পড়ে অন্ধকার হয়ে আসত মুক্তি যোদ্ধারা আসত ওপারের নানা পাড়া থেকে। পাড়ার ওই যে ছোট ছোট কুঁড়েঘর ওগুলোতে অস্ত্র লুকিয়ে রাখত। আর ওই যে বটগাছতলায় মন্দিরটা ওটা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন ডেরা। খান সেনারা এলে ওখানে লুকিয়ে পড়ত। মুক্তি যোদ্ধাদের রান্না হত ওই সব ঘরে। এখন ঘরগুলোতে সদস্য গুনতিতে কমে আসছে। ওই ঘরগুলোর ছেলেরা আর কেউ পাড়ায় থাকে না। পাড়া ছেড়ে এই হিলি ছেড়ে চলে যায় অন্য রাজ্যে। দিল্লি হরিয়ানা পুনে মুম্বাই কেরালা। পাড়ার বারো আঠারো কুড়ি বাইশের ছেলেরা এখন কোনও ঠিকাদারের আন্ডারে দাদনে খাটা লেবার। যাদের কাজের টাইম বেতন সব কিছু নির্ধারিত হয় ঠিকাদারের মর্জিমতো। দেশের শ্রমআইনের মতো নয়। কোনও ঘরে থেকে গেছে তার যুবতী বৌ। বা পড়ে থাকা যুবতী বৌটি হয়ত চলে গেছে অন্য কোথাও। লোকে বলেছে পালিয়েছেরে অন্য ব্যাটাছেলে নিয়ে। থেকে গেছে বাচ্চা কাচ্চা। আছে কিছু বৃদ্ধ বৃদ্ধা। বা বৌ বাচ্চা সব নিয়ে চলে গেছে লেবারের কাজে। টিনের ঘুপচি যুজ্ঞির ভেতর সংসারটির আশ্রয় হয়েছে মাস কয়েকের জন্য। বাবা জোগাড়ের কাজ করবে একটু বেশি হপ্তা পেয়ে। মা যোগাড়ের কাজ করবে বা কন্সট্রাকশান সাইটের এক দেড়শ লেবারের রান্না করবে একটু কম হপ্তায়। আর শিশুটি হবে বিনা বেতনের হেল্পার। মায়ের হাতে হাতে জল তুলে দেবে। ইট তুলে আনবে। আর খাবারের লাইনে দাঁড়াবে থালা হাতে। ওই পাড়া থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম তাড়া খেয়ে। অন্য একখানা পাড়ায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ল নিহারবাবু। এই নতুন পাড়াটা সীমান্ত থেকে এক কিলোমিটারের ভেতর। রাস্তার পাশে বি এস এফ দু এক খানা প্রশ্ন করে ছেড়ে দিলেন। সীমান্ত থেকে একটু দূরে বলে এখানে ঢুকতে আর অতো কড়াকড়ি নেই। পাড়ায় ঢুকতেই কোমর অবধি দেওয়ালের ছোট্ট খুপড়ি চোখে পড়ল। নিতান্ত অনারম্বর ভাবে দেওয়ালের নিচে দাঁড়িয়ে আছে যীশুখ্রীষ্ট। তারপাশে চেয়ারের উপর বসা আর এক বি এস এফ। পায়ে চকচকে কালো বুট। আমার আধার কার্ডটা দু তিন বার নেড়েচেড়ে দেখে ছেড়ে দিল। পাড়াটা আর পাঁচটা পাড়ার মতোন না। ঘরগুলো দূরে দূরে। সামনে যেদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছি গলিটা গিয়ে একটা খোলা মাঠে মিশে গেছে। আশেপাশে দু একজন বেরিয়ে এলো বাইরে। পাড়ার নাম জিজ্ঞাসা করায় নিহারবাবু বললে বৈ গ্রাম। জটলা থেকে একজন মহিলাকে নিয়ে এলেন সামনে। ঠোঁট মোটা। ভারি চেহারা। হাইট সাড়ে চার ফুটের বেশি হবে না। হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছিলেন প্রথমে নিহার বাবুর সাথে। নির্বাক দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার সময়টুকুতে বারবার চোখ পড়ছিল ভদ্রমহিলার হাতের আঙুলগুলোর দিকে। আঙুলের সামনের দিকটা যেরকম সরু হয়ে আসার কথা ওনার উলটো। আঙুলের মাথার দিকগুলো যেন আরও বেশি করে মোটা হয়ে এসেছে। হাতের পেশি দেখে বারবার ইট বহন করার কথা মনে হচ্ছিল। ভারি কিছু যারা তোলে তাদের হাতের পেশিগুলো এরকম বেশ শক্তিশালি দেখতে লাগে। নিহারবাবু কিসব বুঝিয়ে দেওয়ায় আমার সাথে কথা বলতে এগিয়ে এলেন ওই মহিলা। খোলা মাঠটার দিকে পিঠ দিয়ে টোটোতে এক হাতে ঠেস দিয়ে আমার দিকে দাঁড়ানো। পাড়ার নামটা একবার ওনাকে জিজ্ঞাসা করায় ভারি একখানা গলার স্বরে যে উত্তরটা দিলেন আর বুঝতে পারলাম না। যেটা বুঝলাম সেটা ওনার স্বামীর কবরের জায়গার নাম। পাঞ্জাব। যা যতটুকু বলে চলেছেন বেশিরভাগ কথাগুলোই অস্পষ্ট। অনেক কষ্টে দু-চারবার প্রশ্ন করে যে নামটি বুঝলাম মুনি মারডি। যার ঘটনাটা শোনার জন্য টোটো দাঁড় করিয়েছিলেন নিহারবাবু তিনি মধু হেমব্রম। ইনি তার বিধবা স্ত্রী। কিভাবে মধু হেমব্রমের এক্সিডেন্ট হয়ে গেল সেটা জানার জন্য একই প্রশ্ন করে চলেছি বারবার। বেশিরভাগ কথা খুব মৃদু গলার স্বরে নিজের ভাষায় বলে চলেছেন। আমার প্রশ্নগুলো আদৌ বুঝতে পারছেন কনা বুঝতে পারছিনা। কোঁকড়া চুলগুলো ঘাড় অবধি ছাঁটা। ওই ছাঁটা চুলের উপর দিয়ে মাথায় বেশ বড় করে ছাপা শাড়িতে ঘোমটা ঢাকা। ঘোমটা দেওয়া মাথাটা খোলা আকাশের দিকে তুলে ভারী ভারী হাতদুটো ওরকম উঁচুর দিকে তুলেই স্বামীর মৃত্যুটা বোঝাতে কোনও একটা শব্দ করে চলেছেন মুখে। বার কয়েক শোনার পর বুঝলাম শব্দটা লিফট। উঁচুর ওই লিফটের জন্যেই তার স্বামীর এক্সিডেন্টটা ঘটেছিল। কিছুতেই বুঝতে পারা যাচ্ছিল না লিফট ছিঁড়ে পড়ে মানুষটি মারা গেছে নাকি লিফটটি মানুষটির উপর ছিঁড়ে পড়েছে। আরও দু চারটে প্রশ্ন। তারপর বোঝা গেল লিফট বলতে যেমন শপিং মল ফ্ল্যাটবাড়ি হোটেলের লিফটের কথা আমার মাথায়ঘুরছিল, এ লিফট সেরকম কিছু না। অস্থায়ী গোছের মাল তোলার জন্য শ্রমিক তোলার জন্য একটা ব্যবস্থা। সেই অস্থায়ী লিফ্টটিতে মানুষটি ছিলেন না। মানুষটিই তুলে দিয়েছিল ইট সিমেন্ট লোহা লক্কর। তুলে দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল ঠিকঠাক পৌঁছাচ্ছে কিনা। লিফট উপরে না উঠে পড়ল এসে নিচে যেখানে মানুষটার মাথাখানা ছিল।
জায়গাটা পাঞ্জাব। কোনও এক সিটি কলেজ। সিটি কলেজে সেদিন অন্যদিনের মতোই ক্লাস চলছিল। পাশেই চলছিল কলেজ বাড়ির এক্সটেনসন। আন্ডার কন্সট্রাকশান রুমে সিমেন্টের সাথে ইট বালি চুন সুরকি মিশছিল নিয়মমাফিক।কোন এক ঘরে হয়ত অংকের যোগ বিয়োগ গুন ভাগের সূত্র মিলে চলেছিল, মিলে চলেছিল রসায়নের এক পদার্থের সাথে অন্য পদার্থ তরল কঠিন গ্যাসিয় কি মিশলে কি হবে তার সূত্র। প্রামাণ্য সূত্রগুলি প্রবেশ করছিল পরিষ্কার পরিষ্কার মাথায়। হঠাৎ ঘটে গেল অন্য এক গড়মিলের অংক। ইট বালি সিমেন্ট লোহালক্করের ভারে কোনও এক মাথার শারীরবৃত্তীয় গঠন দিল বদলে। মাথার ভেতর হার মাংস মজ্জা ঘিলুগুলো একেবারে লন্ডভন্ড দিয়ে মানুষটা গেল আধামরা হয়ে। সেদিনের আর ক্লাস চলেছিল কি চলেনি জানা হয়নি তবে মুনি মারডির জীবন হিলির এই আদিবাসি পাড়াতেই কাটতে লেগেছিল এই মারাত্মক খবরখানা পাওয়ার পরেও।
মুনি মারডি তার ছেলে এবং তার স্বামী মধু হেমব্রম সবাই দাদন খাটা লেবার। অগ্রিম টাকা নিয়ে বছর বছর রওনা দেয় হিলির কোনও কোনও ঠিকাদারের আন্ডারে ঘর ছেড়ে সংসার ছেড়ে এগারো মাসের লেবার হয়ে। সেবার পাঞ্জাবের ওই কলেজ বিল্ডিংএ ছিল ওদের দাদনের কন্ট্রাক্টের জায়গা। কন্ট্রাক্ট অনুযায়ী মাসগুলো শেষ হল মুনি মার্ডি আর মধু হেমব্রমের। শেষ হলনা কেবল ছেলের কাজ। কেন শেষ হল না সে কথা আর উদ্ধার করতে পারিনি মুনি মার্ডির মুখের কথা থেকে। শুধু বুঝলাম মুনি মার্ডি পাড়ার লোকের সাথে ফিরে এল হিলির পড়ে থাকা সংসারে। মধু হেমব্রম ফিরল না। আরও কিছু দিন খাটুনি মানে আরও কিছু টাকা। আশা ছিল আরও কিছুর। ছেলেরও কাজ হবে বাবারও আরও একটু ইনকাম হবে। একসাথে ফিরবে হিলির নিজের পাড়ায়। তিনদিন হাসপাতালে কোমায় থাকার পর মারা গেল মধু মারডি। বারতি ওই কটা দিনে মধু মার্ডির উপার্জন কতটা কি বেড়েছিল জানিনা তবে ছেলে টিপের টাইম শেষ করেই হিলি ফেরার অনুমতি পেয়েছিল।
তাদের একসাথে দাদনে যাওয়ার পর্ব আর লিফট ভেঙে স্বামীর মৃত্যু, দুটো পর্বেই মুনি মান্ডির মুখের ভঙ্গী বদলায়নি একটুও। ভারী ভারী চোখে ভাঙা গলার স্বরে থেমে থেমে বলে চলেছিলেন সবটা। এরপর যে প্রসঙ্গে এই আদিবাসি ভদ্রমহিলা বেশ উৎসাহ পেলেন সেটি হল মধু হেমব্রমের কবর।
মধু হেমব্রমের ওই ভাঙাচোরা শরীরখানা সমাধি দেওয়ার প্রনালিটুকু হাত নেড়ে নেড়ে বোঝানোর চেষ্টা করতে শুরু করলেন। অনেকগুলো অস্পষ্ট শব্দের মাঝে যতটুকু স্পষ্ট শব্দ পাওয়া গিয়েছিল তাতে দাঁড়ায়, কথা বললাম এইখানের ফাদারের সাথে সিস্টারের সাথে। আর ছেলে তখন উখানে। সে সেই বিদেশের মিশনে গিয়ে কথা বলল ওইখানের ফাদার সাথে। বাঁশ ফাঁস কুড়াল টুড়াল বার করে দিল পাঞ্জাবের ওই মিশন। জায়গা দিল।
বার করে দিল মানে?
কবরে লাগে। বিদেশের মিশনও কবর দেওয়ার জায়গা দিল।
বাকিটা হল, সেই কাজের সাইট দিয়েছিল মধু হেমব্রম মারা যাওয়ার ক্ষতিপূরণ বাবদ পঞ্চাশ হাজার টাকা। সেই পঞ্চাশ হাজার খরচ করা হবে কোন খাতে? এই প্রশ্ন নিয়ে বারবার ছুটে গিয়েছিল সদ্যবিধবা লেবারের বৌটি ওদের বৈগ্রামের মিশনের উঁচু মাথার মানুষের কাছে।
এই আদিবাসী খ্রীসচান মহিলাটির আর দেখা হয়নি তার স্বামীর মৃতশরীরখানা। স্বামীর বডিখানা শেষ দেখা দেখার থেকে মিশনের ফাদারের পরামর্শ ছিল ওই দূর রাজ্যেই বডি সমাধিস্ত হয়ে যাক। আর এখানে আশপাশের সমাজের লোকজনকে ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়ে খাইয়ে দেওয়া হোক। উপদেশ অনুযায়ী সমাধি হল।
ই পাড়া উ পাড়া উই পাড়ার লোগকে খাওয়ালাম। ঘোমটা সমেত মাথাটা ঘুরিয়ে একেবার ডানে বাঁয়ে সামনে পিছন দেখিয়ে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল যে লোক সে খাইয়েছিল। খ্রীসচান মতে পারলৌকিক কাজে কোনও ঢিলেমি তার হয়নি।
ছেলে ফিরে এলো একলা। মুনি মার্ডি আর কখনও যায়নি পাঞ্জাব। সমাধিটুকু আর দেখেও নি সে। যায় এখন অন্য রাজ্যে। অন্য অন্য দলের যোগাড়ে হয়ে।
টোটো আবার চলল আরেক আদিবাসি পাড়ার দিকে…
(চলবে)