বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমার একজন শ্রদ্ধেয় নেতার জীবনাবসান হলো। আকবর হায়দার খান রনোর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনো পরিচয় ছিল না। তাঁর লেখা পড়েছি , তার সম্পর্কে সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনে চোখ বুলিয়েছি আর তাঁর উপর পুলিশের যে সামান্য তথ্য রয়েছে তাও দেখেছি। তাতে মনে হয়েছে তিনি এক লড়াকু নেতা , চিন্তক এবং সমাজতন্তের পথের পথিক।
সাথী আকবর খান হায়দার রনো হলেন সৈয়দ নৌসের আলীর পৌত্র। নৌসের আলী ছিলেন কৃষক প্রজা পার্টির নেতা এবং অভিবক্ত বাংলার স্বাস্থ্য মন্ত্রী। পরে তিনি বাংলার আইনসভার স্পিকার হয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৩৯ সালে তিনি কংগ্রেস যোগ দেন এবং ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরে তিনি পূর্ববাংলার মানুষ হয়েও পশ্চিমবাংলায় থেকে যান এবং পরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মার্ক্সবাদীর সদস্য হন।কলকাতায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসাবে হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীসাহেবের ভাব শিষ্য কামরুদ্দিন আহমদ লিখেছিলেন যে পাকিস্তান সরকার দুই জন মুসলমান বাঙালি কে ভিসা না দেবার কৃষ্ণতালিকাতে রেখেছিলেন তার মধ্যে একজন হলেন নৌসের আলী আর অন্যজন হলেন স্বনাম ধন্যা নজরুল গীতি গায়িকা ফিরোজা বেগম।
১৯৬১ সালে সাথী রনো কমিউনিস্ট পার্টি র সদস্য হন। সেই সময় ১৯৬২ র ছাত্র ও শিক্ষা আন্দোলনে তাঁর, কাজী জাফর এবং রাশেদ খান মেননের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। পরবতীকালে কমিউনিস্ট পার্টি সংশ্লিষ্ট ছাত্র ইউনিয়ন ভাগ হলে তিনি ছিলেন চীনপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত। ১৯৬২ সালে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো কারাগারে তাঁকে জেরা করবার অছিলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক বাঙালি অফিসার তাঁকে বলেন
আপনার স্বাধীনতার জন্যে শুরু কবে করবেন? আমরা সেই সময় বন্দুক ঘুরিয়ে পাকিস্তানের বিদ্রোহ শুরু করব।
রনো ভাই তাঁকে বলেন তার জন্যে আরো এক দশক অপেক্ষা করতে হবে।
ষাটের দশকে প্রবাদ প্রতিম কৃষক নেতা মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। শেখ মুজিবর রহমান ধানমন্ডিতে তাঁর পড়শী ছিলেন। একবার কারাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোনো এক কমিউনিস্ট নেতার সঙ্গে রনো ভাই কে দেখে বলেছিলেন
এই ওকে আপনারা দলে টানবার চেষ্টা করবেন না। ও আমার। রনো তুই আমাদের সঙ্গে আয়।
রনো ভাইর আর একটা গল্প হলো ১৯৬৯ সালে ওনার সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের দেখা। সেদিন সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক সহযোগীদের বিদায় দিয়ে রনো ভাইকে বলেছিলেন:
এই আমার বাড়ির বারান্দা দেখেতেছোস। এই বারান্দায় স্বাধীন বাংলার প্রথম মন্ত্রী সভার বৈঠক হবে একদিন।
১৯৬৬ সল্ থেকে সাথী রনো শ্রমিক আন্দোলনে যোগ দেন। ঢাকার উপকণ্ঠে টঙ্গী অঞ্চলে তাঁরা গড়ে তোলেন জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন কাজী জাফর এবং রাশেদ খান মেনন। ১৯৬৯ এর গণ বিদ্রোহে তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সেই সময়ের একটা ঘটনা সাথী রনো উল্লেখ করেছেন। কোনো অচেনা যুবক মৌলানা আব্দুল খান ভাসানীর কাছে এসে বলেন আপনার সঙ্গে চীনের যোগাযোগ রয়েছে। আমাদের বাঙালিদের কে চীন কে অস্ত্র দিতে বলেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে রনো এবং তাঁদের বিপ্লবী কেন্দ্র যোগ দেন। রনো কলকাতায় এসে সে সময়ের ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মার্ক্সবাদীর সম্পাদক প্রমোদ দাশগুপ্তর সঙ্গে দেখা করেন। প্রমোদ দাসগুপ্ত তাঁর প্রতি খুবই সহানুভূতিশীল ছিলেন। বাংলাদেশের শিবপুরে মুক্তিযুদ্ধর সময় তাঁদের ঘাঁটি ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে সত্তরের দশকে কাজী জাফর যে লন্ডন যান তাঁর ভিসা করে দিয়েছিলেন সেই সময় পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসু।
রনো ভাই পরবর্তীকালে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে উল্লেখ্য ভূমিকা পালন করেন পাঁচ দলীয় জোটের তাত্ত্বিক নেতা হিসাবে। তাঁর সঙ্গী কাজী জাফর যদিও এরশাদের সরকারের প্রধান মন্ত্রী হন। রনো ভাই কিন্তু সে পথে যান নি। পরবর্তীকালে তাঁর একান্ত ঘনিষ্ট সহযোগী রাশেদ খান মেনন আওয়ামীলীগের সরকারের সহযোগী দলের সদস্য হিসাবে মন্ত্রী হলেও রনো ভাই বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে থেকে যান। এবং শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য থাকেন। সৎ চিন্তাশীল এবং সংস্কৃতিবান বামপন্থী রাজনীতিবিদ হিসাবে আকবর হায়দার খান রনো ভারতবর্ষ বলে উপমহাদেশের ইতিহাসে চিরজীবিত থাকবেন।