‘আমার যে কিছু কথা ছিল, দাদা’।
মনোময়ের অফিসে কথা বলতে বলতে সন্ধ্যে ছ’টা বেজে গিয়েছিল। মনোময়ের সাথে অ্যাটাচড আর্দালি রয়ে গিয়েছে। বাকি অফিস ফাঁকা। সরকারি অফিস, বিশেষ কাজ না থাকলে ছ’টার আগে ফাঁকা হয়ে যাওয়ারই কথা। মনোময় এর মধ্যে অনেকটাই ধাতস্থ হয়েছেন। রত্নদীপকে ‘এবার তাহলে উঠি’ বলব বলব করেও বলতে পারছিলেন না। ইতোমধ্যে মনোময় নিজের পরিবারকে বিপদে না ফেলে কীভাবে কাজ করবেন ভেবে নিচ্ছিলেন। বাংলাদেশের পরিস্থিতি একরকম ছিল। সেখানে প্রতিরক্ষা দপ্তর যেভাবে সর্দারের বিষয়টিকে নিয়ে সক্রিয় হয়েছিল, তেমনটা পশ্চিমবঙ্গে সম্ভব হবে না বলেই মনোময় বুঝে নিয়েছে। কারণ সর্দারের দলবলের এই দেশে তেমন রেজস্টার্ড ক্রিমিনাল অফেন্স নেই। ইন্টারপোলের রেড লিস্টেড বলে লালবাজার একবার রেড করেছে। বারবার করবে না মনোময়ের কথায়। নিজের অবস্থান বুঝে নিয়ে মনোময় হটকারি সিদ্ধান্ত না নেওয়ার কথাই বিবেচনা করলেন। রত্নদীপের কথা শুনে বললেন, ‘এতক্ষণ তো তুমিই বলে চলেছ। আবার নতুন কী কথা বলবে ?’
আমার নিজস্ব কিছু কথা রয়েছে’, রত্নদীপ শান্ত স্বরে বলল ‘।
নিজস্ব বলতে ? সর্দারের কথার বাইরে ?’ ‘
হ্যাঁ’ ‘।
মনোময় ঠিক ধরতে পারছিলেন না। প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি সর্দারের সাথেই কাজ করছ বলে মনে করছিলাম’।
সাথে কাজ করা আর দলে কাজ করা এক কথা নয় দাদা ‘। আমি সর্দারের সহযোগী, কিন্তু তাঁর দলের সদস্য নই’।
হুমম, তুমি এসোসিয়েট ‘। শুনেছি আগে। বল তোমার কথা’, মনোময় কৌতুহলী হলেন।
আমার গোবিন্দমূর্তিটি চাই’ ‘।
মানে ?’, মনোময় প্রথমে কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না ‘।
মানে প্রতাপাদিত্য উড়িষ্যা থেকে যে সোনার গোবিন্দমূর্তিটি এনেছিলেন সেটি চাই আমার’ ‘।
মনোময় কিছুক্ষণ রত্নদীপের দিকে তাকিয়ে থেকে অস্ফুটে বললেন, ‘সে মূর্তি কোথায় আছে ?’
সেটাই আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে’ ‘।
মনোময় বেশ কিছুক্ষণ রত্নদীপের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘যশোরের গোপালপুরে মন্দির নির্মাণ করে সেই মূর্তি স্থাপন করেছিলেন প্রতাপ জানি। বল্লভাচার্য সেই মন্দিরের পুরোহিত হয়েছিলেন’।
দাদা, সেই মূর্তি অনেকদিন আগেই চুরি গিয়েছে’ ‘।
বল কী !’ ‘
সতীশচন্দ্র মিত্র কিছু ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছিলেন ‘। আপনি আগে পড়ে নিন, দাদা। এই মূর্তিটি আমার চাই’।
ছেলেমানুষের মতন চাই চাই করলেই কী আর পাওয়া যায় নাকি ?’, মনোময় বেশ বিরক্ত হলেন এবারে ‘।
দাদা, এমন একটি ঐতিহাসিক মূর্তি এভাবে হারিয়ে যাবে সেটা তো আর হতে দেওয়া যায় না’ ‘।
কিছুক্ষণ নিজের মনে ভেবে নিয়ে মনোময় বললেন, ‘তুমি আজ এসো। আমিও বের হব। পড়াশোনা করি আগে। তারপর কথা বলব তোমার সাথে’।
বেশ দাদা ‘। আপাতত সর্দারকে এ বিষয়ে কিছু বলার দরকার নেই’, বলে রত্নদীপ উঠে বেরিয়ে গেল।
মনোময় গাড়ি আসতে বলে ভাবতে লাগলেন এ বেশ ভালোই জট পড়ে যাচ্ছে ক্রমশঃ। ছিল সুলতান দাউদের মুদ্রা আর প্রতাপের গুপ্তধন। এখন আবার হল সোনার গোবিন্দমূর্তি। এর উপরে আবার সর্দারকে বলা যাবে না মূর্তির কথা। আচ্ছা ফ্যাসাদ হল। যাহোক, আগে সেসব পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাক। তারপর দেখা যাবে কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। এসব ভাবতে ভাবতে অফিস থেকে বেরিয়ে এলেন মনোময়।
***
হসপিটাল থেকে ছাড়া পেয়ে রতন গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসেছে। আপাতত কিছুদিন কাজকর্ম করা যাবে না। ঘাড়ের উপর দিকে যে আঘাতটা রতন পেয়েছিল তাতে তার প্রাণ চলে যেতে পারত। মা ষষ্ঠীর দয়ায় এযাত্রা বেঁচে গিয়েছে। স্যারের লোক হাতে কিছু টাকা দিয়ে দিয়েছে। ফলে কাজে না গেলেও ঘরে খাবারের টান পড়বে না। তার উপর বউটা ক’দিন ধরে কান্নাকাটি করছে। মোহর টোহরের কথা অবশ্য বউ জানে না। কিন্তু কিছু একটা গণ্ডগোল আছে বুঝেছে। মেয়েদের মন, কিসব গন্ধ ঠিক পেয়ে যায়। ‘তোমায় কেন মারল ? তুমি কী করেছিলে ?’ এসব প্রশ্ন করে করে মাথা খারাপ করে দিয়েছে একেবারে। ডাক্তার বেশি কথা বলতে বারণ করেছে বলে টলে ঠান্ডা করা গেছে কিছুটা।
কিন্তু মোহরের ডাব্বাটা গেল কোথায় ? ইস্, এতোগুলো মোহর ! লাখ টাকার উপর পেয়ে যেত রতন। যদিও আসলেই কত দাম সে জানেই না। তবুও লাখ টাকা তো হতই মনে হয়। বেচারা শামসুল ! মরেই গেল ছেলেটা ! স্যারের লোক খালি বড় বড় কথাই বলে যাচ্ছে। হ্যান করেগা, ত্যান করেগা। আরে ধুর, ঘন্টা করেগা। লছমনকে খুঁজেই পায়নি এখনও।
***
বাড়ি ফেরার পথে গাড়িতে বসে প্রথম ফোনটা করলেন চৈতালিকে। চৈতালি সজলদের ব্যাচের অফিসার। বেশ ঝকঝকে স্মার্ট মেয়ে। হাওড়াতে থাকে, শ্রীরামপুরে অফিস। মনোময়ের ফোন পেয়ে বেশ খুশি। মনোময়ের এক্টিভিটির কারণে ও গর্ব বোধ করে সেকথা জানাল। উত্তরপাড়ায় সাবর্ণ চৌধুরীদের বিষয়ে খোঁজ খবর নিতে বললেন। অফিসের কাজের বাইরে ঐতিহাসিক তদন্তমূলক কাজে মনোময় তাকে কিছু দায়িত্ব দিচ্ছে শুনে চৈতালি কথায় চাপা উচ্ছ্বাস দেখা গেল।
দ্বিতীয় ফোনটা মনোময় করলেন সজলকে। আজকের সারাদিনের ঘটনাগুলি সজলকে জানিয়ে রাখলেন। এই ধরণের অফিসের বাইরের কাজে সজলই একপ্রকার মনোময়ের প্রধান সহকর্মী বলা যায়। আগের দুটো ক্ষেত্রেই বেশ সাহায্য করেছে। এবারও সজলের থেকেই নিত্যর ফোন নাম্বার নিয়েই কলকাতা পুলিশে যোগাযোগ করেছিল। সর্দারের হুমকির কথা শুনে সজল বলল, ‘স্যার, বাংলাদেশের কেসটার সময় আপনার সাথে ইন্টারপোলের অফিসারদের যোগাযোগ হয়েছিল। আপনি তাদের জানিয়ে রাখুন না কেন ?’
ইন্টারপোলের বিভিন্ন দেশের দায়িত্ব পালন করে সেই দেশের এনসিবি বা ন্যাশানাল সেন্ট্রাল ব্যুরো। তোমার হয়তো মনে আছে যে আমাদের ভারতে এনসিবি হল সি-বি-আই বা সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন। এখন সি-বি-আই-এর কোনো তদন্তের জন্য কিছু ক্রাইটেরিয়া রয়েছে। রাজ্য সরকার বা হাইকোর্ট ইত্যাদি থেকে নির্দেশ না পেলে ওরা কাজ শুরু করে না। অনেক হ্যাপা, সজল’। ‘
‘কিন্তু স্যার সর্দারের নামে তো রেড অ্যালার্ট জারি রয়েছে’, সজল যুক্তি দিল।
‘থাকলেও সি-বি-আই-এর হাতে এতো এতো কেস রয়েছে যে ওরা এমনিতেই হিমশিম খায় তদন্তের কাজে’।
‘তাহলে ?’, সজল বেশ হতাশ হয়েছে বোঝা গেল।
‘তাহলে আর কী। আমরা সিকিউরিটি এজেন্সিদের কাজে মাথা ঘামানোর চেষ্টা করব না, সজল। বরং গুপ্তধন আর গোবিন্দমূর্তির বিষয়ে মাথা দেব ভেবেছি’।
সজল কিছু না বলে ভাবতে লাগল। মনোময় ‘আজ শুক্রবার। তুমি আর চৈতালি রোববার আমার ফ্ল্যাটে দুপুরে চলে এস। লাঞ্চ করতে করতে আলোচনা করা যাবে খন’ বলে ফোন রাখলেন।
সজল ফোন শেষ হওয়ার পরে ভাবতে বসল। মনোময় স্যার কী ভয় পেয়ে গেলেন ? মনোময়কে যে চোখে দেখে সজল তাতে ভয় পাওয়া মানুষ হিসেবে তাঁকে দেখতে চায় না। তবে মনে হয় ভয় নয়, সতর্ক থাকতে চাইছেন স্যার। এমনিতেই ডিপার্টমেন্টে শত্রু রয়েছে। এর উপরে ইন্টারন্যাশানাল ক্রিমিনালের বিষয়ে জড়িয়ে পড়লে শত্রুরা ক্ষতি করতে চাইবে। মনোময় স্যার বা তাঁর পরিবার গুণ্ডাদের হাতে আক্রান্ত হলে ডিপার্টমেন্ট পাশে তো দাঁড়াবেই না, উল্টে এক্তিয়ারের বাইরে কাজ করার জন্য একঘরে হয়ে পড়বেন। সজল খানিকটা বুঝতে পারল মনোময় স্যারের পরিস্থিতি। তবে সজল একটা ব্যাপারে নিশ্চিত যে ভারতে সর্দারের নিজস্ব দলবল বলতে তেমন কিছু থাকার কথা নয়। সর্দারকে কিছু করতে গেলে অন্য মাফিয়া দলের সাহায্য নিতে হবে। কিন্তু যাই হোক, অযথা ঝুঁকি নেওয়ার মানে হয় না। খানিকক্ষণ এলোমেলো চিন্তা করার পরে সজল রোববারের লাঞ্চের নিমন্ত্রণের জন্য অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল। এমনিতে চৈতালি সজলের বন্ধু। তিনজনে বসে ঠিক করে নেওয়া যাবে পরবর্তী পদক্ষেপ।
***
মনোময় বাড়ি ফিরে সুজাতাকে হুমকির কথা কিছু বললেন না। আজ শুক্রবার বলে কাল-পরশু সপ্তাহান্তের দুদিন ছুটি। মনোময় চা খেয়ে কাজে বসলেন। আজকের হাতে পাওয়া পুঁথির অংশটি যত্ন করে রেখে দিলেন পরে পড়বেন বলে। তার আগে গোবিন্দমূর্তিটির বিষয়ে কিছু পড়ালেখার প্রয়োজন। সতীশ চন্দ্রের বইটি এবং অন্যান্য ডকুমেন্ট ঘেঁটে যা মনোময় বুঝলেন সেটি এইরকম।
উড়িষ্যা থেকে প্রতাপাদিত্য একটি শিবলিঙ্গ এবং একটি গোবিন্দমূর্তি এনেছিলেন। শিবলিঙ্গটি ‘উৎকলেশ্বর’ নামে স্থাপন করা হয়েছিল বেদকাশী নামক স্থানে। প্রতিষ্ঠাতা রূপে বসন্ত রায়ের নাম পাওয়া যাচ্ছে। একটি গোলাকার প্রস্তরফলকে শিলালিপি পাওয়া গিয়েছে। তাতে লেখা রয়েছে,
নির্মমে বিশ্বকর্মা যৎ পদ্মযোনি-প্রতিষ্ঠিতং
উৎকলেশ্বরসংযজ্ঞ শিবলিঙ্গমনুত্তমম্।
প্রতাপাদিত্যভূপেনানীতমূৎকলদেশতঃ
ততো বসন্তরায়েন স্থাপিতং সেবতঞ্চ তৎ।।
পদ্মযোনি হলেন ব্রহ্মা। বিশ্বকর্মা নির্মিত ব্রহ্মা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত উৎকলের শিবলিঙ্গ প্রতাপাদিত্য নামে ভূপতি এনেছিলেন, যাকে বসন্ত রায় স্থাপিত করেছিলেন।
সতীশচন্দ্র প্রাচীন যশোরের একটি ম্যাপ দিয়েছিলেন। সেই ম্যাপে সাতক্ষীরা অঞ্চলটি রয়েছে মাঝামাঝি স্থানে। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের টাকী এবং হাসনাবাদের পূর্বদিকের অঞ্চলটিই হল সাতক্ষীরা। এই সাতক্ষীরার দক্ষিণেই রয়েছে প্রতাপনগর, ঈশ্বরীপুর এবং ধুমঘাট। ধুমঘাটে প্রতাপের একটি দুর্গ ছিল। ধুমঘাটের উত্তরে গোপালপুর এবং উত্তর-পূর্বে বেদকাশী। কপোতাক্ষ আর শাকবাড়িয়া নদীর মাঝে হল বেদকাশী নামের জায়গাটি। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কারণে কপোতাক্ষ নদের কথা আমরা জেনেছি। বেদকাশীর পশ্চিমদিকে রয়েছে গোপালপুর নামের জায়গাটি। এই দুই জায়গায় দুই মন্দির নির্মাণ করে শিবলিঙ্গ এবং গোবিন্দমূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।
হুগলির ত্রিবেণী অঞ্চলটির নামকরণের সাথে গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী নদীর নাম যুক্ত হয়ে রয়েছে। এলাহাবাদ বা প্রয়াগ হল একটি ত্রিবেণী। সেখানে গঙ্গা এবং যমুনা যুক্ত হয়েছে। সরস্বতী নদী নাকি অন্তঃসলিলা হয়ে সেখানে যুক্ত। সেই ত্রিবেণী হল ‘যুক্ত ত্রিবেণী’। হুগলির ত্রিবেণী হল ‘মুক্ত ত্রিবেণী’। মনোময় এক জায়গায় পড়েছেন যে সেখানে তিন নদী মুক্ত হয়েছে। গঙ্গার ধারাটি শ্রীরামপুর, হাওড়া হয়ে নেমে এসেছে। সরস্বতীর খাতটি জনাই, চণ্ডীতলা হয়ে। বর্তমানে সরস্বতীর ধারাটি প্রায় অবলুপ্ত হলেও একসময়ে এটিই ছিল প্রধান জলপথ এই অঞ্চলে। সপ্তগ্রাম থেকে সমুদ্রগামী নৌকা এই পথেই যেত। অপর একটি ধারা পূর্বদিকে গিয়েছিল। যার নাম যমুনা। সম্ভবত এই যমুনার তীরেই ধুমঘাটের তিন মাইল উত্তরে গোবিন্দমূর্তিটি স্থাপন করে গোপালপুর নামক স্থানটির জন্ম হয়েছিল। প্রধান উদ্যোক্তা অবশ্যই বসন্তরায়। কারণ তিনি মনেপ্রাণে বৈষ্ণব ছিলেন। তবে প্রতাপাদিত্য পরের দিকে শক্তিসাধক তান্ত্রিক হয়ে উঠলেও বংশের বৈষ্ণব রীতি অস্বীকার করতেন না। বৈষ্ণব কবি গোবিন্দদাস প্রতাপের রাজত্বকালেও যশোরে আসতেন। তাঁর পদাবলীতে লেখা রয়েছে,
এত হি বিরহে আপহি মুরছই, শুনহ নাগর কান।
প্রতাপ আদিত, এ রস ভাসিত, দাস গোবিন্দ গান।।
গোপালপুরে গোবিন্দ মন্দির স্থাপনের সময়ে বসন্ত রায় এবং প্রতাপের মধ্যে রাজ্যভাগ হয় নি। বা হলেও পরস্পরের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল। বিশাল সে মন্দির চত্বরের চারদিকে চারটি উচ্চ মন্দির। সতীশচন্দ্রের সময়ে অর্থাৎ প্রায় একশো বছর আগেই মন্দিরগুলি ভেঙ্গে পড়েছে। সতীশচন্দ্র একটি মন্দিরের চূড়া ভাঙ্গা অবস্থায় দেখেছিলেন। সেটির উচ্চতা ছিল প্রায় ৩০ ফুট। মন্দিরগুলির পশ্চিমদিকে ছিল দোলমঞ্চ। উত্তরদিকে এক দীঘি।
এক বিশাল মহোৎসব করে মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। উড়িষ্যা হতে আগত বল্লভাচার্য সেবায়েত হলেন। কিন্তু পরম বৈষ্ণব বসন্তরায় নিজ রাজ্যে কী নতুন মন্দির তৈরি করেছিলেন ? করবারই কথা। মনোময় এই পয়েন্টটি নোট করে নিলেন।
কিন্তু সে কাহিনি ভিন্ন। কিন্তু গোপালপুরে স্থাপিত গোবিন্দদেবের মূর্তি নিয়ে নাটক কিছু কম হয় নি। প্রতাপের পতনের পরে ওই অঞ্চলের অধিকার প্রাপ্ত হন বসন্তরায়ের এক পুত্র চাঁদ রায়। তিনি বল্লভাচার্যের পুত্র রাঘবেন্দ্র অধিকারীকে গোবিন্দের সেবায় ২৮৬ বিঘা জমি দান করে দেন। সেই জমি বংশ পরম্পরায় ভোগের অধিকারও দেন। নানা প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক কারণে অধিকারীরা বিগ্রহ নিয়ে পরমানন্দকাটি নামক এলাকায় চলে আসেন। চাঁদ রায়ের পৌত্র শ্যামসুন্দর রায় সেখানে মন্দির ও দোলমঞ্চ গড়ে দেন। একশো বছর নিরুপদ্রবে চলছিল। একশো বছর বাদে ঐ অঞ্চলের জমিদারি লাভ করেন কলকাতার পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর পরিবার। গোবিন্দ মন্দির ও বিগ্রহের মালিকানা নিয়ে সেই সময়ে ঠাকুর পরিবারের সাথে অধিকারীদের বিবাদ শুরু হয়। কিছুকাল বাদে গোবিন্দমূর্তি নিয়ে অধিকারীরা গোপালপুরে ফিরে আসে। কিন্তু ঠাকুরেরা সেই বিগ্রহ বলপূর্বক দখল করতে চায় এই অভিযোগে অধিকারীরা গোবিন্দমূর্তি রামজীবনপুরে লুকিয়ে রাখে।
রামজীবনপুর ছিল নুরনগরে। সেই নুরনগরের জমিদারী তখন চাঁদ রায়ের বংশধরের অধীনে ছিল। অর্থাৎ পুনরায় সেই গোবিন্দ বিগ্রহ বসন্তরায়ের বংশধরের হাতেই এসে যায়। এই সময়ে ঠাকুর পরিবার অধিকারী পরিবারের বিরুদ্ধে ঠাকুর (বিগ্রহ) চুরির মোকদ্দমা করেন। ১৭৯৮ সালে যশোর ফৌজদারি আদালতে রায় অধিকারী পরিবারের পক্ষে যায়।
সমগ্র বিষয়টিকে বোঝার জন্য মনোময় একখানি গুগল ম্যাপ তৈরি করলেন। ম্যাপে দেখা যাচ্ছে জাহাজঘাটা নামক স্থানটি। এর নিকটেই ছিল গোপালপুর। পরমানন্দকাটি সামান্য উত্তর-পশ্চিমে। এর দক্ষিণে হল নুরনগরের রামজীবনপুর।
মনোময় দেখছিলেন যে মোকদ্দমার এখানেই ইতি নয়। কয়েকবছর বাদে বাংলা সন ১২৩৫ এ অধিকারীরা রায়পুর গ্রামে নিজেদের বাসভবন গড়ে তোলার পরে সেখানে গোবিন্দমূর্তি নিয়ে আসতে গেলে রায়পরিবার বিগ্রহ হস্তান্তরে অরাজি হলেন। মোকদ্দমা হল। ১৮৩০ সালে বারাসাত ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে কিছু ফয়সালা হল। স্থির হল যে রাজারা মূল মালিক হলেও সেবায়ত হল অধিকারীরা। ফলত পূজার অধিকার তাদেরই।
আবারো শতবছর অতিবাহিত হল। এবারে দুই যতীন্দ্রকে নিয়ে বিবাদ শুরু হল। একজন টাকীর জমিদার যতীন্দ্রনাথ চৌধুরী। অপরজন রায়বংশের কাটুনিয়ার জমিদার যতীন্দ্রমোহন রায়। বাংলা সন ১৩১০ এ টাকীর জমিদার রাস উৎসব উপলক্ষ্যে অধিকারীদের থেকে গোবিন্দমূর্তি চেয়ে আনলেন। কিন্তু অধিকারীরা কোন অধিকারে টাকীর জমিদারকে বিগ্রহ প্রদান করল এ নিয়ে নুরনগর এবং কাটুনিয়ার জমিদারেরা বিবাদ শুরু করে দিলেন। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়াল। অনেকবার রায়পুরে আক্রমণ হল। জোর করে গোবিন্দমূর্তি ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হল। অধিকারীদের বাড়িতে পুলিশ পাহারার বন্দোবস্ত হল। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। গোবিন্দমূর্তি এবং শ্রীরাধিকামূর্তি অপহৃত হল। সকলে অনুমান করল যতীন্দ্রমোহন রায়ই চুরি করিয়ে সেই মূর্তিদ্বয় নিজের অধিকারে নিয়েছেন। কিন্তু সেই মূর্তির সন্ধান আর পাওয়া গেল না।
কয়েকবছর বাদে কাটুনিয়ার রাজাদের দোল উৎসবে সেই গোবিন্দদেবের সদৃশ মূর্তি দেখা গেল। এদিকে অধিকারীদের মন্দিরেও একইরকম মূর্তি পুনস্থাপিত হল। উৎকল থেকে আনীত আদি গোবিন্দমূর্তিটি কোথায় গেল সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া গেল না পরবর্তী একশো বছরেও। মনোময় অনুমান করলেন যে রত্নদীপ এই হারিয়ে যাওয়া গোবিন্দমূর্তির সন্ধান করছে। মনোময় জায়গাগুলির নাম নোট নিয়ে রাখতে গিয়ে ভাবলেন মূর্তি যখন হারিয়ে গিয়েছে তাহলে খামখা পরমানন্দ কাটি, কাটুনিয়া, নুরনগর ইত্যাদি নামগুলি লিখে নিয়ে বিশেষ লাভ নেই।
খাতাপত্র রেখে মনোময় দেখলেন রাত অনেক হয়েছে। সুজাতা এবং মেয়ে স্বাতী অনেক আগেই ঘুমিয়ে কাঁদা হয়েছে। বইপত্র, ল্যাপটপ গুছিয়ে মনোময় চললেন শোবার ঘরের দিকে।