ঊর্মি রহমান- উদার সুরে আনন্দগানের জীবন

ঊর্মি রহমান, এক বর্ণময় জীবন।বাঙালি সংস্কৃতির এই চিরন্তন উপাসকের স্মৃতি, এক বেদনা বিহ্বল অনুভূতি। ধর্মান্ধতা যখন সংস্কৃতির অঙ্গনকে ঢেকে দিচ্ছে, তখন আমাদের আশ্রয় ঊর্মি রহমানেরাই-

 

 

১৫ সেপ্টেম্বর '২৪, দুপুরবেলায় এপিক থিয়েটার ও কলকাতা মঙ্গল শোভাযাত্রার অন্যতম সংগঠক দিলীপ মজুমদারদারের ফোন পেয়েছিলাম, "ঊর্মিদি চলে গেছেন একটু আগে। জানোই তো অসুস্থ ছিলেন দিদি। খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। আমরা গড়িয়া শ্মশানে আসছি।"

 

 

ঊর্মিদি মানে ঊর্মি রহমান চলে গেছেন। ছোট অথচ এই অসময়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই খবর। মানে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতিকে প্রতিদিন চ্যালেঞ্জ জানানো একটি বর্ণময় লড়াকু মানুষের জীবনাবসান হল। অথচ সাংবাদিক ও ইংরাজি এবং বাংলা দুভাষাতেই লেখালেখিতে সমান দক্ষ ঊর্মিদি প্রথাগত অর্থে রাজনৈতিক নেত্রী ছিলেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তরে বামপন্থী ছাত্র রাজনীতির পরে আর সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যুক্ত থাকেননি। কিন্তু বাংলাদেশের প্রথম যুগের মহিলা সাংবাদিকদের মধ্যে অন্যতমা ঊর্মি রহমান সারাজীবন নিজের সাংবাদিকতা পেশার মতো শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চাকেও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর রাজনীতির বিরুদ্ধে ব্যবহার করতেন। এককভাবে তো বটেই সংগঠিতভাবেও। মুক্তমনা উদার সামাজিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন তাই ব্যক্তিজীবনে ঊর্মিদি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাচরণ করতেন না। বাংলাদেশের মাটিতে এই সিদ্ধান্ত কতটা দুঃসাহসী তা এই বাংলায় বসে আমাদের পক্ষে অনুমান করা কষ্টসাধ্য। এই মানসিকতার বীজ বপন হয়েছিল তাঁর শৈশবেই। ঊর্মিদির বাবা সৈয়দ শফিকুর রহমান ও মা শাহেদা রহমান দুজনেই উদার মনের মানুষ ছিলেন। তিন কন্যার বাবা মা হিসাবেও যথেষ্ট গর্বিত ছিলেন তাঁরা। ঊর্মিদির প্রথম বেতনের টাকায় কেনা পাঞ্জাবি পরে আনন্দে আত্মহারা  শফিকুর রহমান সাহেব বন্ধুবান্ধব প্রতিবেশীদের দেখিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার শেষে ইউনেস্কো ফেলোশিপ নিয়ে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় এবং তারপর ফিলিপিনসের ম্যানিলায় অবস্থিত প্রেস ফাউনশন অফ এশিয়ায় গবেষণা শেষ করে ঊর্মি রহমান বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে যুক্ত হয়ে লণ্ডনে চলে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশে ফিরে আসার পরে তাঁকে পাওয়া গিয়েছিল একই মেজাজে। আবার পাকাপাকিভাবে কলকাতায় আসার পরেও ঊর্মিদি নিজের কাজকর্ম একইরকমভাবে চালিয়ে গেছেন। যতদিন শারীরিকভাবে সক্ষম ছিলেন বিভিন্ন সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সাংস্কৃতিক কর্মসূচিতে হাজির থাকতেন। কলকাতায় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। নেটওয়ার্ক অব উইমেন ইন মিডিয়া, ইণ্ডিয়া বেঙ্গল চ্যাপ্টারের কো অর্ডিনেটর হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের তরুণ প্রজন্মের মহিলা সাংবাদিকদের আপনজন হয়ে উঠতে পেরেছিলেন উর্মিদি। এঁরা ঊর্মি রহমানের মতই তারকা সাংবাদিক হওয়ার চেয়েও অ্যাকটিভিস্ট হতে বেশি আগ্রহী। নারীর অধিকার ও পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে সতত উজ্জ্বল ঊর্মি ছায়া দেখেছি এঁদের মধ্যে। উর্মি রহমান তাঁদের মনে এই বিশ্বাস চারিয়ে দিতে পেরেছেন যে, নারীর অধিকার মানেই মানবাধিকার। 

 

ঊর্মি রহমানের সাংবাদিকতায় আসা লেখালেখিকে ভালোবেসেই। ১৯৭৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ ফাইনাল পরীক্ষার ফল বেরোনোর আগেই পারিবারিক সূত্রে ঘনিষ্ঠ বিশিষ্ট সাংবাদিক জহুর হুসেন চৌধুরীর হাত ধরে দৈনিক বাংলা সংবাদপত্রে সাংবাদিক হিসাবে যোগ দেওয়ার সময় শুনেছিলেন রাতেও কাজ করতে হবে। বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি সম্মতি দিতে। সিনিয়র সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত ও রণেশ দাশগুপ্তের অভিভাবকত্বে হাতে কলমে কাজ শিখেছিলেন ঊর্মি। ঘটনাচক্রে মহম্মদ জাহাঙ্গীর এই পত্রিকায় উর্মিদির সহকর্মী ছিলেন। মহম্মদ জাহাঙ্গীরের সঙ্গে ঊর্মিদির বিবাহিত জীবন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৮৫ সালে যখন বিবিসির চাকরি নিয়ে তিনি লণ্ডনে পাড়ি দিলেন তখন তাঁর পুত্র নিতান্তই দেড় বছরের শিশু। সেখানে প্রযোজক ও উপস্থাপক হিসাবে আট বছর যুক্ত থাকার সময় উর্মি রহমান সহকর্মী হিসাবে পেয়েছিলেন সিরাজুল রহমান, দীপায়ন চট্টোপাধ্যায়,শ্যামল ঘোষ,গোলাম মুর্শিদ, সুভদ্রা ঊর্মিলা মজুমদার মানসী বড়ুয়া, গোলাম কাদের এবং সাগর চৌধুরীকে। মহম্মদ জাহাঙ্গীরের সঙ্গে আইনি বিচ্ছেদের নয় বছর পরে ঊর্মিদি সাগর চৌধুরীর  সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন।  বিবিসির সঙ্গে চুক্তি শেষ হওয়ার পরেও তিনি একটি স্থানীয় সরকারি সংস্থায় কাজ করেছেন। ত্রিশ বছরের কাছাকাছি সময় ইংল্যাণ্ডে থেকেও ঊর্মি রহমান ব্রিটিশ নাগরিকত্ব গ্রহণ করেননি। বাংলাদেশের পয়লা বৈশাখ,একুশে বইমেলার টান অনুভব করে যত দিন পেরেছিলেন যোগ দিয়েছেন, জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা মনে করতেন মুক্তিযুদ্ধকে, তাই শাহবাগ আন্দোলনের সময় ভারত থেকে পৌঁছে গিয়েছেন ঢাকায়। শেষ দিকে অসুস্থ অবস্থাতেও কলকাতায় আনোয়ার শাহ রোডের বাসভবন থেকে খোঁজ খবর রাখতেন বাংলাদেশের।

 

 

বাংলাদেশের সাংবাদিকমহলের অনেকেই আজও বলেন, ঊর্মি রহমান দুহাতে লেখেন। নয়ত এত গুলো বই! "বিলেতে বাঙালি: সংগ্রাম ও সাফল‍্যের কাহিনী", "পাশ্চাত্যে নারী আন্দোলন", "নস্টালজিয়া ও অন্যান্য গল্প",  "আত্মকথনে সময় ও সৃজনকথা, "নদীর কথা, পাহাড়ে সাদা ঘোড়া,পুকুর ভাবনা ও একটি সকাল, পশু পাখিদের কথা, রোল্ড ডালের গল্প(অনুবাদ, দুই বাংলার রান্না, দুই নদীর গল্প উপন্যাস- তালিকা দীর্ঘ হতে পারে অনায়াসে।

 

 

গত ১৫ সেপ্টেম্বর কোনও ধর্মাচরণ ছাড়াই গড়িয়া আদি মহাশ্মশানে শেষকৃত্য হয়েছিল ঊর্মিদির। কলকাতা পুরসভার কর্তব্যরতা মহিলা চিকিৎসক ডেথ সার্টিফিকেটের প্রিন্ট আউট বার করার সময় আমাদের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করলেন, ধর্মের জায়গায় লেখা আছে মুসলিম! উত্তর দিলেন সাগরদার ভ্রাতুষ্পুত্র, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র অধ্যাপক রাজর্ষি মুখোপাধ্যায়, "আমার জ্যাঠাইমা কোনও ধর্মাচরণ করতেন না"। 

 

(তথ্যসূত্র- সাংবাদিক মাহমুদা আকতার)

 

  • চয়ন ভট্টাচার্য