"গল্প কখনো কখনো k2 হয়ে চেপে বসে স্রষ্টার ফুসফুসে। তিনি তখন সৃষ্টির গন্ধ পান। কলম্বাসি চোখে স্পর্শ করতে চান শিল্পের চর। কেবল ফর্ম নয়, টেনশনাল সিমেট্রিতেই নির্মাণ করেন টেক্সট-এর ইমারত। ভাঙতে চান, গড়তে চান, ভেঙ্গে ভেঙ্গে আদল দিতে চান নতুন কোন রূপের। এই 'নতুন কোন রূপ'-এর খোঁজেই যেন নতুন করে পথ চলা।" কথাগুলি যখন স্বয়ং লেখক তাঁর বইয়ের 'ভূমিকা'য় বলেন তখন প্রাথমিকভাবে তাকে বিনীত অহংচর্চাও মনে হতে পারে। আর যে পাঠকের 'ইবলিশনামা' পড়া আছে, তাঁর মনে হবে গল্পকার লতিফ এখানে তাঁর দ্বিতীয় শরটি নিক্ষেপ করছেন আরো অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসে, অনেক বেশি দায়বদ্ধতার থেকেই। 'দায়বদ্ধতা' শব্দটা বহু ব্যবহারে ক্লিশে হলে একে পাঠক প্রতিস্থাপন করুন স্বাজাত্যবোধ, সমমর্মিতা এইসব শব্দ দিয়ে।
\\r\\n
'বাহের দ্যাশ আর দেউনিয়া বিবি' নামটি শুনলেই যাঁরা এই অঞ্চলের ভাষা জানেন না বা ভারতের উত্তর-পশ্চিমবঙ্গের মানুষ নন তাঁরা ঠোক্কর খাবেন। ‘বাহের দ্যাশ’ বলতে রাজবংশী নশ্য শেখ অধ্যুষিত কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, আলিপুর এই অঞ্চলকেই বোঝায়। 'বাহে' শব্দটি 'বাবা হে' বাক্যবন্ধটির অপভ্রংশ। (যদিও আজও দুঃখজনকভাবে শব্দটি কিছুটা উন্নাসিকতা ও অবহেলার শরীরভাষ্য বহন করে।) আর দেউনিয়া মানে দেওয়ানি বা মোড়ল। জমিদারতন্ত্র হয়তো নেই, কিন্তু অলিখিত দেওয়ানী, মাতব্বর ও মোড়লেরা কিন্তু আছেই। জামার রং বদলায়, দিন বদলায় না। "মনে হয় এ মুখ, ও মুখ, সব মুখ এক।"
\\r\\n
কোচবিহারের ভূমিপুত্র গবেষক অধ্যাপক গল্পকার লতিফ হোসেন নিজে নশ্যশেখ পরিবারের সন্তান। নশ্যশেখরাও একসময়ের রাজবংশী। ফলে সহজেই কোচবিহার ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলের সাবঅলটার্ন ও ধর্মে মুসলমান মানুষদের অবস্থা, দুরাবস্থা, রাজনীতি, দৈনন্দিন যাপন সব উঠে এসেছে লেখকের জাদুকলমে। মাত্রাবোধে লেখক নিজে সমমর্মী হয়েছেন, কিন্তু বায়াসড হননি কোনো চরিত্র বা ঘটনার প্রতি। প্যাচপ্যাচে আবেগের বদলে একটা নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গিতে অনেকটা ওপর থেকে দেখছেন গল্পকার। যেমন রুবেল সরকারকে নিয়ে 'নস্যকথা' নামের গল্পটি। "রুবেল সরকার। সরকারের খাতায়---ওবিসি। সাবকাস্ট নশ্য। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে--শেখ। তাহলে গোটাটা গিয়ে দাঁড়ালো-- নশ্যশেখ।' একবিংশ সভ্যতার বিজ্ঞান প্রযুক্তির চূড়ান্ত উন্নয়নের যুগেও, রুবেলকে বা ওরফে লতিফকে রাষ্ট্রীয় বা ধর্মীয় কারণে এইরকম একটা আইডেন্টিটি যখন বহন করতে হয়, বা যখন লতিফকে এরকম সংলাপ লিখতে হয় ---
\\r\\n
"---ছিঃ, পেটে ভাত নেই আর সংস্কার মারাচ্ছো! ওসবে কি কাজ?
\\r\\n
---আছে মহারাজ, কাজ আছে। মরা সংস্কার মরে যাওয়া মানুষের দোসর। না হলে এভাবে কাগজ দেখাতে বলে? কার সাহস?"
\\r\\n
---তখন একদিকে তা যেমন একটা সুস্পষ্ট রাজনৈতিক প্রশ্নের ইঙ্গিত বহন করে, ঠিক তেমনি সমাজ ও সভ্যতাকে লজ্জা দিয়ে প্রত্যেকটি পাঠককেও যেন তার অস্তিত্ব নিয়ে একটা প্রশ্ন তুলে দেয়। প্রশ্ন কর্তা তখন রাষ্ট্র, প্রশ্নকর্তা তখন সমাজ, প্রশ্নকর্তা তখন আমাদের ভুল রাজনীতি। বেশি ভাবতে গেলে মাথা ঘোরে। "তার চেয়ে বরং তুমি-আমি পাশাপাশি ঘর করি। স্বপ্ন বুনি। সংসার সংসার খেলায় 'উনুন' সাজাই।"
\\r\\n
আবার 'তাসুক ভুসুক' গল্পে এমএ, বি.এড ফারজানা খাতুন, ওর মায়ের অনেক কষ্টের টাকা জমিয়ে জমিয়ে কেনা জামদানি শাড়িটা পরেও বিয়ের পাত্রের সামনে 'বিক্রির বাজারে' পরীক্ষা দিতে গিয়ে অমনোনীত হলে, বলে-"ওদের মুখে বমি করে দিতে ইচ্ছে করে।" ফরজানার পরিবার সমাজের কাছে মান-সম্মান বাঁচাতে মেয়ের বিয়ে দ্রুত হওয়ার জন্য ঘরে নিয়ে আসে এক ফকির। সেই ফকিরের হাত নেমে আসে ফারজানার স্তন বরাবর....। লতিফের মতো এ গল্প আমরা কোচবিহারবাসী সবাই কমবেশি জানি। আমরা বলতে পারি না, লতিফ বলতে পারে। "---বালের সতীত্ব। স্বগতোক্তি কখন সশব্দে জেগে ওঠে। এ সমস্যা কিন্তু শুধু নশ্যশেখ সম্প্রদায়ের তা তো নয়, এ সমস্যা প্রান্তিক মানুষ সবারই কমবেশি। শুধু প্রান্তিকই বা বলি কেন, এইরকম ফকিরের আবির্ভাব কিন্তু সমাজের ওপরতলার অংশেও আছে সমানভাবে। লতিফের আখ্যান তারই দর্পণ।
\\r\\n
আমাদের এই প্রবন্ধের শিরোনামের যে নামগল্প 'একজন ন্যাংটো মানুষ এবং না-সময়ের গপ্পো' তাতে সময় নিজেই একটা চরিত্র। "সময় ভাঙে, সময় গড়ে। সময় মারে, সময় মরে। সময় হাসায়, সময় কাঁদায়। সময়ের ভেতর অজস্র না-সময়ও আছে।" গল্পের নায়ক উজান এই না-সময়ের ভেতরকার মানুষ। অথবা ও নিজেই নিজেকে ভাবে একটা বিকল্প সময়। গল্পে কাহিনীর যে আভাস তা যে খুব নতুন, সে কথা বলা যায় না, তবে এর ট্রিটমেন্ট সত্যিই অসাধারণ। লাশ কাটা ঘরে উজান কখনো নিজেই নিজের শরীর শব-ব্যবচ্ছেদ করেছে; কখনো নগ্ন হয়ে, কখনওবা সময়কে অতিক্রম করে অন্য কোনো বিকল্প সময়ে। এই গল্পটিকে ‘গল্প’ না বলে, একটা ‘টেক্সট’ বলতে ইচ্ছে করছে শুধু, কেননা মাঝে মাঝেই গল্পের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে তীব্র কবিতার ঘ্রাণ।
\\r\\n
"এমন তাপমান আছে যা কোন থার্মোমিটারে মাপে না,
\\r\\n
শুধু গায়ের চামড়া তাদের আলাদা করে চিনতে পারে :
\\r\\n
শিশুর কবোষ্ণ নিঃশ্বাস যা মাখন তোলা দুধের গন্ধ ছড়ায়.... "
\\r\\n
মনে পড়ে লেখক সচেতনভাবেই ভূমিকায় বলেছেন --"কেবল ফর্ম নয়, টেনশনাল সিমেট্রিতেই নির্মাণ করতে হয় টেক্সট-এর ইমারত। "
\\r\\n
আবার মূল গ্রন্থটির নামগল্প 'বাহের দ্যাশ আর দেউনিয়ার বিবি' সবদিক থেকেই বইটির লিডিং গল্প। 'বাহের দ্যাশ' বলতে শুধু কোচবিহার নয়,জলপাইগুড়ি আলিপুর নিম্ন আসামের দু একটি জেলা এবং অবশ্যম্ভাবী অধুনা বাংলাদেশের রংপুর, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম এইসব। ডেমোগ্রাফিটা একই। 'বাঁশ ব্যাচেয়া মাইয়া' পোষার কথা শোনেনি কেউই। তবু পরিস্থিতির শিকার হয়ে ওঠে নশ্যশেখ সম্প্রদায়, রাজবংশী সম্প্রদায় এবং এই অঞ্চলের হতভাগ্য মানুষেরা। আবার এই গল্পেই ধর্মীয় নীতি বা মূল্যবোধকে আঘাত করতে চেয়েছে বা প্রশ্ন করতে চেয়েছে লতিফ। "কোনো যুদ্ধাক্রান্ত সময়ে পুরুষশূন্য কোনো ভূখণ্ডে নারীদের ভবিষ্যৎ আর উত্তরাধিকারের প্রশ্নে বহুবিবাহকে যদি মান্যতা দেওয়া হয়, তাহলে সময়ের ফেরে তা সঠিক বলে মনে হতে পারে, কিন্তু সময় আর স্থানের বিবর্তনে সেটা পুরুষতন্ত্রের ভোগ বিলাসের ফাঁদ ছাড়া কিছু নয়।"--এ উপলব্ধি তো শুধু নসিবের নয়, এ উপলব্ধি লতিফেরও বা হয়তো আমাদের সবারই। আবার প্রেমের তো কোনো ধর্মবিচার হয় না। "প্রথম জীবনে হিন্দু মেয়ের প্রেমে পড়েছিল নাসির আলী। প্রিয়া দাসের হাতে হাত রেখে বলেছিল, আজীবন এ হাতের গিট খুলবে সাধ্যি কার! পরে সম্পর্ক বনাম সামাজিক অবস্থানের হাতাহাতিতে যখন সমাজ জিতল, তখন প্রিয়া দাস হারিয়ে গেল। লাস্যময়ী রুবিনা এল কোমর দুলিয়ে।" কিন্তু শেষ বয়সেও "ও তো মনে মনে আজও প্রিয়া দাসকেই খোঁজে। ওকে ভুলবার আছিলায় রুবিনা খাতুনের বুকে খুঁজে পেতে চেয়েছিল এক সমুদ্র প্রেম, যে তার ভাঙ্গা পাঁজরে প্রলেপ দেবে। কিন্তু পেয়েছে কি!..." এই আখ্যান আমাদের পরিচিত। কিন্তু উপস্থাপনা নতুন। শব্দ, বর্ণ, অক্ষর, রেফ, র-ফলা দিয়ে লতিফ যে ছবি আঁকে তা এক কথায় অনবদ্য। দেউনিয়ার বিবি এক মাঝ বয়সী প্রৌঢ়া, ভাগা পানের গন্ধ তুলে, লাল টুকটুকে ঠোঁটে তার আদরের নাতিকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়---“আয় নিন্দ, বায় নিন্দ, পাইকুরের পাত। কনকাট্টা কুকুর আসিল, ঝিত করি থাক...।" আসলে এইসব ছবি, এই সব গল্প আমরা যারা উত্তরপূর্ব ভারতের এই অংশের মানুষ তাদের কাছে খুব পরিচিত। আমরা লিখতে পারিনি, লতিফ লিখেছে। হয়তোবা যা বাংলা ভাষায় প্রথম না হলেও, প্রতুল নয়। উপস্থাপনই টেক্সট-কে নতুন করে তুলেছে। এখানেই লেখকের নিজস্ব দক্ষতা। নতুন করে, নতুন দৃষ্টিতে তিনি ভাবতে শেখান।
\\r\\n
‘মৃত্যু’ লেখককে খুব ভাবায়। অনেক গল্পে মৃত্যু যেন একই সাথে চরিত্র ও প্রেক্ষিত হয়ে উঠেছে। 'তিরিশ পেরোনো কুসাইদ কন্যা ফারজানা খাতুন'-এর গল্প তো এই অঞ্চলের অনেক মেয়েরই ললাট-লিখন। 'তাসুক ভুসুক' তো এম.এ, বি.এড ফারজানার বাধ্যতার ডায়েরি। আবার শ্রেণীকে নিয়ে স্যাটায়ার আছে 'দহন' গল্পে। কিন্তু প্রশ্নটাকে তো এড়ানো যায় না। "খিধের থেকে বড় ভাইরাস কিছু হতে পারে....?"
\\r\\n
আসলে লতিফের সব গল্পই 'ভয়ের উত্তরাধিকার'। দারিদ্রের ভয়, ক্ষুধার ভয়, লড়ার ভয়। এত ভয় নিয়েও মানুষগুলো লড়ে যাচ্ছে, যুঝে যাচ্ছে সমাজের সাথে, প্রতিকূলতার সাথে। এক অদৃশ্যভয় যা প্রজন্মবাহিত। সে ভয় 'ভাঙা শার্সি'; সে ভয় 'মানুষটা মরেনি'; সে ভয় 'একজন ন্যাংটো মানুষ আর না সময়ের গল্প'-এ, সে ভয়ে--'রাতের ক্রমশ বয়স বাড়ে, ধোঁদা শেয়ালের করুণ আর্তিকে গায়ে মেখে। 'তাই এত মৃত্যু কথা, তাই এত কবর-কাহিনি।
\\r\\n
বইটি সম্পূর্ণ পড়া হলে লেখকের মতো পাঠকেরও মনে হবে--"সময় ও সমাজের নগ্নতা অন্বেষণে একটা আনন্দ আছে, এতে বোঝা যায় তুমি নিজে কতটা নগ্ন বা তোমার শরীরে কতখানি কাপড় আছে!"