চিঠি

 


স্নেহের ভাই,


চিঠি লেখার রেওয়াজ তো এখন উঠেই গেছে।লিখতে হলে , লেখে লোকে কেজো চিঠি।কম্পিউটারে কি বোর্ডে হাত রেখে।কাগজ কলমে চিঠি লেখা? শেষ কবে লিখেছি মনে পড়ে না রে।


আবার লিখতে বসলুম চিঠি। প্রেমপত্র কখনো লিখি নি।লেখবার দরকার ই হয় নি।কারন জানতে চাস?


অকপটেই বলি, বিশুদ্ধ প্রেম আমার জীবনে কখনো আসে নি।


তুই নিশ্চয় ই আমার লেখার খুত ধরে বলবি, প্রেমের আবার বিশুদ্ধতা কি? তুই কি দাদা সেই ,' শুচি বামনীর হাজার মরণ, হেগো কাপড়ে দুগ্গা স্মরণ ' গোছের প্রেম করতিস?


                    আসলে কি জানিস ভাই, আমার অকালে হারিয়ে যাওয়া বন্ধু অনিরুদ্ধ যখন বলেছিল ,তুই রীতিমতো প্রেমে পড়েছিস-- তখন ও আমার মনে হয়েছিল; প্রেমের আবার ' রীতিমতো' বলে কিছু হয় নাকি?


স্মৃতি হাতরে মনে পড়ে ; অ্যাকসিডেন্টে আমার মুখ টা তখন ক্ষত বিক্ষত। আমার কর্মক্ষেত্রের মধ্যেই , ছোট্ট একটা ডেরা ছিল একটু গড়িয়ে নেওয়ার।


আমার সেই ডেরাতে সে এলো ডাক্তার হিশেবে।ক্ষতবিক্ষত মুখের আদল আবার ফিরিয়ে আনতে ঘৃণকুমারীর মলম দেওয়ার কথা বললো।কিন্তু আমার মুখের দাগ তখন মনের গুমোট কাটাতে কেমন যেন একটা নোতুন স্বাদ দিলো। এ স্বাদের আস্বাদন তো আমি কখনো আগে পাই নিকেন আমার সেই অসুস্থ অবস্থার সঙ্গীন দশার মধ্যেও একটু অন্যরকম লাগতে শুরু করলো ডাক্তারের অ্যালোভেরাওয়ালা ক্রিম ব্যবহারের কথাতে?


                      একে কি ' পূর্বরাগ ' বলে? তুই তো অর্থনীতির কৃতিছাত্র। তাবলে কি চন্ডীদাস তো ঠোঁটের আগায় বসে থাকেন না? যখন অনিরুদ্ধ আমাকে বললো , তুই কিন্তু প্রেমে পড়েছিস, তখন কিন্তু আমার মনে হয় নি, প্রেমে ' পড়া' হয় না।' প্রেম' হয়। সেই যে রে ভাই , আমাদের দাদাকে যদি কেউ বলে, ব্যবসায় নামলাম।দাদা তাকে যেমন বলেন, ব্যবসায় ' নামা' আবার কি? নেতিবাচক নয়।ইতিবাচক।' ব্যবসা শুরু করলাম'- দাদার এই কথাটা সেদিন মনে আসে নি।


কেন আসে নি বল তো? বড্ড বেশি স্বপ্ন দেখে ফেলেছিলাম বলে? স্বপ্ন দেখা কি খারাপ ভাই? এই যে আমরা , মানে তুই আর আমি ঠিক করেছি, মণিকর্ণিকাতেই দুজনে অঙার হবো।অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার বই আমার বুকের উপর দিয়ে , জ্বালানি কাঠকে জ্বলতে বলে , তারপরেও তুই বলবি; আকাশ তলে এসে , অঙার হলো আলো। হয়ত , কবির ভাষা ধার করে বলবি, ওঁ কৃৎ স্মরো।


যদি জানতে পারি ঠিক কবে মণিকর্ণিকায় মহামায়া আমার মায়া গ্রন্থি খুলবেন, তার ঠিক আগের দিন, যদি শরীরে বল থাকে, কেদারঘাটের পাশে বি ১৩ /২০১ সোনারপুরার সামনে , যে বাড়িটা এখন লোকে বলে মাধব পন্ডিতের বাড়ি, তার ঠিক সামনেই সীতারামের দোকানের মালাই কিন্তু খাওয়াস ভাই। যদি নিজের যাওয়ার শক্তি আমার না থাকে, নিয়ে এসে খাওয়াস।


মালাই , বাবরি ঘিরে শিবরাম চক্কোত্তির অবসেশন , সেটা ঘিরে তোর ও যে অবসেশন নেই, তা বলি কি করে? নেহাত দুধ , দৈ খেলে তুই সহ্য করতে পারিস নেকো।


জানিস তো ভাই, সেই ডাক্তারের অ্যালোভেরা ক্রিম ব্যবহার ই করি নি।কেন করি নি? ডার্মাটোলজিস্ট নিলয় দিয়েছিল, কনট্রাকটিব্যাক্ট।বিশ্বাস করেছিলাম সেটার উপরেই বেশি। তোর মনে প্রশ্ন উঠতেই পারে, প্রথম থেকেই কি আমার মনে ডাক্তারের বিধান ঘিরে সংশয় ছিল?


না রে ভাই।বাবার যখন প্রস্টেট কার্সিনোমা ধরা পড়লো, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন; অ্যালোভেরার পাতার ভিতরে যে ঘন থকথকে জেল টা থাকে , তারসঙ্গে তিল আর আঁখের গুড় মিশিয়ে খেতে। বাবা খেতেন সেটা অনেকদিন।বাবা তো আর জানতেন না তাঁর অসুখ ঘিরে।মাকে ও বলি নি।মাব্রুয়াৎ সত্যমঅপ্রিয়ম।অপ্রিয় সত্য না বলাই তো ভালো।


অপ্রিয় সত্য বললে, অনেক যে খেসারত দিতে হয়, আমরা দুটি ভাই, শিবের গাজন গাইতে গাইতে , তার থেকে ভালো আর কে বুঝেছে বল? শিবের গাজন। তুই কি কখনো সমরেশ বসুর শহরে বুড়োশিবতলাতে শিবের গাজন শুনেছিস? বড্ড শখ করে এই বুড়োশেবের থানের কাছে একটা ফ্ল্যাট কিনেছিলাম রে ভাই।সেকালের এম এল এ র সৎ ভাইয়ের তৈরি করা ফ্ল্যাট।কিনেছিলাম, ২০০৫ সালে।টাকা যে পুরো দিয়ে দিয়েছি, সেটা চিঠি দিয়ে সেই প্রমোটার জানালেও , আজ ও রেজিস্ট্রি করে দেয় নি।গ্যারেজ কিনেছিলাম ।টাকা পেয়েছে, চিঠিতে লিখলেও তার পজেশন যেমন আজ ও পাই নি, পাই নি ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রেশন।


সেকালের এম এল এ এর ভাই বেশ ভালো ই আছে একালে।শুধু মাঝে মাঝে মন খারাপ লাগে , সেই ফ্লাটে কখনো মাকে নিয়ে যেতে পারি নি বুড়োশিবের গাজন শোনাতে। মা থাকতে আমাদের মাকে ঘিরে আবেগ আর মা না থাকতে সেই আবেগের যে দেখনদারি - দুটোকে কখনো মেলাতে পারি না।


জানিস তো ভাই, ডাক্তারের প্রেমে পড়েছি, মাকে বলতে পারি নি।একটু ভয় ছিল।ভয় টা এই কারনে ছিল যে, মা ছিলেন ট্রাকিকার্ডিয়ার রুগী।একটু বেশি উত্তেজিত হলেই পালস টা বেড়ে যেত।দু তিন দিন অমনটা থাকত।


যাক সেসব কথা তোকে একদিন সামনা সামনিই বলবো। গুরুদেবের সেই গানটি, ' ওলো সই, আমার ইচ্ছে তোদের মত মনের কথা কই' - তেমনিই কোনো এক ঝিম ধরা সন্ধ্যেতে গঙ্গা বা পদ্মা বা সেনহাটি গাঁয়ের সেই বিরাট দীঘি, যে দীঘিতে আজ ও কালের সাক্ষী হয়ে কয়েকশো বছর বয়সী কচ্ছপ যুগল আছে- তার ধারে বসে সেসব গপ্পো তোকে বলবো।


শামসুর রাহমানের ভাষায় বড্ড বলতে ইচ্ছে করে, ' এসো , হাতেহাত রাখি পূর্বপুরুষের মৃত্তিকায়' এই কবিতায় ছিল গৌতম আর সুজাতার কথোপকথন।' সুজাতা' কে -- সেটা বুঝে নেওয়ার ভার একটা সাক্ষাৎকারে কবি পাঠকের উপরেই ছেড়ে দিয়েছিলেন।


তোর দাদা তো জীবনে কখনো ' সুজাতা ' পায় নি।তবে আবার গুরুদেবকে স্মরণ করেই বলতে হয়,' ভালোবেসে ছিনু এই ধরণীরে, ভালোবেসেছিনু।' তাই নাকের বদলে নরুণের মত ' সুজিপিসী' র গল্প একদিন তোকে বলবো।


আচ্ছা , ছোটবেলা, বেশ অনেকটাই ছোট তখন ।কিন্ডার্গার্টেনে পড়ি।সেকালের কিন্ডারগার্টেন।কয়েদিদের যেমন খাঁচাওয়ালা গাড়িতে করে কোর্টে চালান করা হয়, তার ই ছোট সংস্করণ।তুই ও নিশ্চয় তেমন খাঁচাওয়ালা ভ্যানে করে ছোটবেলাতে ইস্কুলে গেছিস।


আচ্ছা, তুই ইস্কুলে যাওয়ার সময়ে, খুব ছোটবেলায় , কাঁদতিস? ইস্কুল ফোবিয়া জানিস তো ভাই, আমার বেশ ভালো রকম ই ছিল।পড়াশুনোতে ভালো ছিলুম না বলেই তেমন ফোবিয়া তৈরি হয়েছিল, তাইই না , বল্?


ওরিয়েন্টাল সেমিনারি ঘিরে রবীন্দ্রনাথের শিশু বয়সে ঠিক যেমনটি মনে হতো, এখন এই পড়ন্ত বেলায় মনেহয়, আমার ও সেই শিশুকালে মনে হওয়াটা বুঝি তেমনটাই ছিল।আসলে ছোট থেকেই দেখতাম, ভালো ছেলেদের উপর ইস্কুলের স্যারদের ভালোবাসাটা একটু বেশি। সেই ভালোবাসার জেরে , পড়াশোনোতে তেমন একটা ভালো ছিল না যেসব ছেলেরা , তাদের যে পিছিয়ে পড়াটা , হ্যাঁ, সেই পিছিয়ে পড়াটা যেন বেশ একটু উপভোগ ই করতেন একটা বড়ো অংশের মাষ্টারমশাইয়েরা।


যে ইস্কুলের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেই ইস্কুলের প্রিন্সিপাল ছিলেন ব্যক্তিত্বময়ী নয়, আজ একটু পরিণত মন নিয়ে মনেহয়, তিনি ছিলেন, বিশেষ রকমের খান্ডারনী। এখন মনেহয়, নিজের জীবনে সন্তান ঘিরে পাওয়া - না পাওয়ার হতাশা- যন্ত্রণার শোধ যেন তিনি তুলতেন তার ছাত্রদের মধ্যে।


জানি না মন্তেশরী প্রশিক্ষণ তাঁর ছিল কিনা।কিন্তু ছোটদের ইস্কুলের বড়দিদিমণি হওয়ার মত বড় মন যে তাঁর ছিল না , সেটা এখন বেশ বুঝতে পারি।


সেই দিদিমণির ছেলেকে তুই চিনিস হয়তো। অনন্ত নামে চিনিস ই।সেইন নদীর দেশে তার খ্যাতি নিয়ে বাঙালির পুকুরে এককালে একজন দুজন ঢিল ছুঁড়েছিল।পুকুরে একটু ঢেউ উঠেছিল।তারপর অবশ্য সবটাই মিলিয়ে গিয়েছে।কেউ আর তাকে মনে রাখে নি।


                    সেই ছেলেকে ঘিরে একটা মানসিক অস্থিরতা নিশ্চয় ই ওই দিদিমণির ছিল।তা না হলে , কিন্ডারগার্টেন ইস্কুলের সর্বেসর্বা হয়েও মানুষটি কেন ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ভালোবাসতে পারতেন না, বল তো ভাই? শাসন করে , পরে তো কখনো তাঁকে কাউকে সোহাগ করতে দেখি নি।ছাত্রছাত্রীরা সাময়িক ভয় পেতে পারে কোনো শিক্ষককে।কিন্তু সেই ভয়টা স্থায়ী হবে কেন, যতদিন সে ওই ইস্কুলের ছাত্র থাকবে?


                        ওই দিদিমণির বরের সঙ্গে আমার, তোর দাড়ি না কাটার আলসেমির খুব সিমিলারিটি লাগে।এই যে শহরে থেকে অনেক দূরে গেলে , তুই মাঝে মধ্যেই সুনীল গাঙ্গুলীর ' অরণ্যের দিনরাত্রি' র চরিত্রের মতো নাগরিক সভ্যতা থেকে দূরে থাকবার প্রতীক হিশেবে দাড়ি কাটায় খামতি দিস, তোর নিজের ভাষায় আলসেমি লাগে-- এটা সেই দিদিমণির বরের সঙ্গে তুলনা করেও আমার মনে হচ্ছে , পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে গালে ঠান্ডা কম যাতে লাগে, গাল যাতে অহেতুক ফেটে না যায়, তারজন্যে দাড়ি না কাটবার যে টিপস উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় দিতেন-- তার সঙ্গেই তোর এই উপমাটা বেশি মেলে।


আচ্ছা ভাই , একেবারে ডিসেম্বরের শীতে বেনারসে তুই স্নান করিস রোজ? স্নানে আলসেমি আসে?  না , আসে না? আমার এককালে( যে কাল কালের স্রোতে ভেসে গেছে) আসলেও শেষ পর্যন্ত স্নান টা কিন্তু করতাম ই।আমাদের সেকালে তো এত গিজার , স্নানের জল গরমের হাজার কিসিমের সুবিধা ছিল না।হয়ত রান্নার ফাঁকেই দিদিমা, মা, ছোটমাসী নাইবার জল গরম করে দিতেন।হি হি, হা হা করতে করতে নাইতুম।


ভাই, মনে পড়ে , ছোটবেলায় লোহার বালতিতে করে( তখন প্লাস্টিকের বালতির চল হয় নি) জল রেখে দেওয়া হতো রোদের ভিতরে।বালতির জলে যাতে পাখি মুখ না দেয়, তারজন্যে বালতির মুখ ঢেকে দেওয়া হতো চুবড়ি দিয়ে।বাঁশের ফালার চুবড়ি।প্লাস্টিকের চুবড়ি তখন কোথায়?


মনেপড়ে ভাই, পুরনো -  ছেঁড়া কাপড়চোপড় দিয়ে দিদিমা- ঠাকুমাদের চুবড়ি কেনা? এখন তো ধামা দেখতে ছুটতে হয় সেই বৃদ্ধা ফ্লিল্ম অ্যাকট্রেসের বাড়ি-- যিনি ছোট্ট ধামায় মুড়ি নিয়ে আর অন দি রক্স হুইস্কি খান। সেখানে গেলে ধামা দেখতে পাওয়া যাবে।


অমন দেখবার ' সৌভাগ্য' তোর হয়েছে বলে মনে হয় না।


চিঠিটা কি বড্ড বড়ো হয়ে যাচ্ছে? দেখেছিস, নিজের ভাইকে কেমন ' শান্তিপুরী লব্জ' বলে যে কথাবার্তার ধরণ , তেমন ভাষাতে কথা বলছি!


আসলে কি জানিস ভাই, আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলনে স্বামী বিবেকানন্দের ভূমিকা যে আমজনতার কাছে তুলে ধরবার ক্ষেত্রে তুই ভগীরথের ভূমিকা পালন করেছিলি, তাই তোকে চিঠি লিখতে গেলে, আমার বিষয় নিয়ে নয়, শব্দ চয়ণ নিয়ে খুব ' কিন্তু কিন্তু' লাগে।


আচ্ছা ভাই, তুই কাউকে বকতে পারিস? কেউ ভুল করলে , তাঁকে বকিস? আমার মনে হয় না।বকুনি দেওয়া - এটা তোর স্বভাব বিরুদ্ধ।হয় সেই লোকের ভুলটা নিজে শুধরে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে ,তাকে বুঝিয়ে দিস , ভুলটা কোথায়।আর তা না হলে, বকে নয়, ভালোবেসে, স্নেহের স্বরে তাঁর ভুল টা ঠিক করে দিস। আমার ধারণা, তোর কাছ থেকে শিখে, অমন ভুল সে কখনো আর করে না।


                     আজ এখানেই শেষ করি রে ভাই।সবাইকে নিয়ে খুব থাকিস।সবাইকে খুব ভালো রাখিস।ইতি।


তোর দাদা।

  • গৌতম রায়