এপার বাংলার বেশিরভাগ মানুষ ই কেবল ,' আশার ছলনে ভুলি' ঘিরেই চেনেন গোলাম মুরশিদকে।উনিশ শতকের বুদ্ধিদীপ্ত বিভাসাকে বাঙালির কাছে বস্তুনিষ্ঠ ভাবে তুলে ধরবার ক্ষেত্রে গোলাম মুরশিদ নিজের ছিলেন আলোকবর্তিকা--
উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের যে ধারা, তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল নব উদীয়মান বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্তের ভিতরে। সেই জাগরণের প্রভাব বেশ কিছু ইতিহাস গত কারণেই বাঙালি মুসলমানের উপরে তেমন একটা পড়ে নি।যদিও বাঙালি মুসলমানের মধ্যে আধুনিকতার প্রতি আগ্রহ উনিশ শতকের শেষকাল থেকেই ধীরে ধীরে বিকশিত হতে থাকে । দুই বাংলার বড় দুটি শহর কলকাতা আর ঢাকা কে কেন্দ্র করে যেমন বাঙালি মুসলমানের মধ্যে একটি মধ্যবিত্ত সমাজ তৈরি হতে শুরু করে, ঠিক তেমন ই দুই বাংলার গ্রামীণ প্রেক্ষাপটেও বাঙালি মুসলমানের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষা এবং আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার দিকে আগ্রহ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।
কলকাতা, ঢাকা দুটি বড় শহরকে কেন্দ্র করে বাঙালি মুসলমানদের সাহিত্য- সংস্কৃতি- সমাজসেবা মূলক ক্ষেত্রে যেমন বিভিন্ন সভা সমিতি অনুষ্ঠিত হয় এবং সংগঠন তৈরি হয় তার রেশ ধীরে ধীরে গ্রাম বাংলাতেও পড়তে শুরু করে। নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে বাঙালি মুসলমানের মধ্যে আধুনিক শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি একটা নতুন চেতনার ধারা তৈরি করে। যে ধারাটি পরবর্তীকালে বিগত বিশ শতকের বিশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সন্নিহিত নানা ধরনের সারস্বত সমাজকে কেন্দ্র করে 'মুসলিম সাহিত্য সমাজ' এবং 'শিখা' গোষ্ঠী ,যাকে অন্নদাশঙ্কর রায় ,'বাংলার দ্বিতীয় জাগরণ 'বলে অভিহিত করেছিলেন, সেই ধারা ,বাঙালি মুসলমান মানুষের চিন্তা চেতনার ক্ষেত্রে আধুনিক, বিজ্ঞানমুখী, ধর্মনিরপেক্ষ ভাবনার বিকাশের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
বিশ শতকের প্রথমার্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে যে জাগরণ তা সার্বিকভাবে বাঙালি মুসলমানের চিন্তা চেতনার জগতকে এক নতুন আলোর সামনে এনে দাঁড় করিয়েছিল। কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন ,আবুল ফজল , কাজী নজরুল থেকে শুরু করে রমেশচন্দ্র মজুমদার, মোহিতলাল মজুমদার ,অন্নদাশঙ্কর রায় --কে না ছিলেন সেই জাগরণ পর্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
এই জাগরণের সলতে পাকানোর ক্ষেত্রে মীর মোশাররফ হোসেন থেকে শুরু করে মুজফফর আহমেদ, সুফিয়া কামাল কখনো সঙ্গবদ্ধ ভাবে বা কখনো এককভাবে আলোর অভিমুখে এই সঞ্চারী ধারাকে অগ্রবর্তী করে নিয়ে গিয়েছেন। সেই ধারাই পরবর্তীকালে বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে শুরু করে শেষ দশকগুলি জুড়ে ,এমনকি একুশ শতকের দ্বারপ্রান্তেও গোটা বাঙালি সমাজকে, হিন্দু- মুসলমান নির্বিশেষে ,আধুনিক চিন্তা চেতনা, বিজ্ঞানমুখী ভাবনা ,সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই ,ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা সঞ্চার ,গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ,দেশপ্রেম --এ সমস্ত কিছু সঞ্চারের ক্ষেত্রে বিশেষ রকমের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে।
সদ্য প্রয়াত হিউম্যানিস্ট গোলাম মুরশিদ সেই চেতনারই ধারাবাহিকতা তাঁর গোটা জীবন ধরে বজায় রেখেছিলেন। উনিশ শতকের বাংলা ও বাঙালি ছিল তাঁর চর্চার ভুবনের সব থেকে হৃদয়গ্রাহী বিষয়। অনেকটা যেন উপনিষদে সেই বাণী ,'মনের আনন্দ প্রাণের আরামে'র মত ,তিনি উনিশ শতক এবংউনিশ শতকের বাঙালিকে ঘিরে নিজের চর্চা কে স্থাপন করেছিলেন। এই স্থাপন পথে নানা ধরনের সামাজিক এবং রাজনৈতিক চাপ তাঁকে অতিক্রম করতে হয়।
তাঁর কর্মময় জীবনের প্রথম দিকটায় তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের যে আর্থ-সামাজিক অবস্থা ,সেটা তাঁকে অনেক বেশি উদ্বুদ্ধ করেছিল উনিশ শতকের আলোক প্রাপ্তি ঘিরে নিরলস গবেষণার বিষয়টিকে। উনিশ শতকের মন ও মনন কে উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে তিনি বিদ্যাসাগর থেকে রবীন্দ্রনাথ হয়ে একেবারে হাল-আমলের বাংলা ভাষার সংকট ,আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারির স্বীকৃতি এবং সেই স্বীকৃতি যে নিছক কোন ও একটি বিশেষ ভাষা র স্বীকৃতি তা নয় , সামগ্রিকভাবে সমস্ত রকম মাতৃভাষার স্বীকৃতি, যে সমস্ত ভাষা প্রায় অবলুপ্তির পথে ,সেইসব সংখ্যালঘু ভাষার প্রতি ও স্বীকৃতি --এ কথাটা জোর গলায় বলবার মতো মেরুদন্ড নিয়ে নিজের জীবন ও সাধনাকে অতিবাহিত করে গেলেন গোলাম মুরশিদ।
উনিশ শতকের বাংলা বা বাঙালিকে নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে আলোচকদের মধ্যে অনেক সময় দেখতে পাওয়া যায়, নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গির বড়ই অভাব। ব্যক্তি স,ম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাতিত্ব উনিশ শতককে ঘিরে আলোচনার সময় ,আলোচকদের মনে অনেক ক্ষেত্রেই এমন ভাবে ভিড় করে আসে যে ,লেখা বা মূল্যায়ন কোন ও কিছুর মধ্যেই শেষ পর্যন্ত নিরপেক্ষতা বজায় থাকে না। কোন ও ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা অনেক ক্ষেত্রে এমন একটা জায়গা তৈরি করে ফেলে যে ,সেই ব্যক্তিটিকে আলোচক, কার্যত দেবত্ব আরোপ করে ফেলেন।ফলে একপেশে একটা মূল্যায়ন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সম্বন্ধে শেষ পর্যন্ত তিনি করে বসেন।
একজন ব্যক্তি যে রক্ত মাংসের মানুষ, তাঁর চিন্তা চেতনার মধ্যে ঠিক ,বেঠিক সবকিছু থাকতে পারে এবং চিন্তা চেতনার মধ্যে একটা বিবর্তনের ধারাবাহিকতা, যেটা জীবনের একটা অঙ্গ।আর মন মানসিকতার সম্যক বিকাশের ক্ষেত্রে এই চিন্তা চেতনার বিবর্তন একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়--সেটাও অনেক সময় সঠিকভাবে ফুটে ওঠে না।
এখানেই সদ্য প্রয়াত গোলাম মুরশিদ ছিলেন একজন অত্যন্ত ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। নিজের গবেষণার জগতকে প্রসারিত করবার ক্ষেত্রে তিনি যেভাবে নিরপেক্ষতাকে একমাত্র প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন, তেমনটা কিন্তু দুই বাংলাতেই উনিশ শতকে ঘিরে আলোচনার সময় বেশ অভাব ই আমাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়।
এমন একটা সময়ে গোলাম মুর্মশিদ বিদ্যাসাগরকে নিয়ে ভাবনাচিন্তা প্রসারিত করতে শুরু করলেন ,যখন তাঁর স্বদেশ, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ,একটা বড় রকমের রাজনৈতিক সংকটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। গত শতকের সাতের দশকে, এমন একটা সময় বিদ্যাসাগরকে ঘিরে গোলাম মুরশিদের গবেষণা পর্ব এবং বিদ্যাসাগর কে নিয়ে দুই বাংলার চিন্তা চেতনার সম্মিলিত ধারার একত্রিকরণের উদ্যোগ, সেই সময়কালটা ছিল কিন্তু মুক্তচিন্তা চর্চার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সংকটের কাল।
পাকিস্তানি হানাদারেরা মুক্তচিন্তা চর্চার ক্ষেত্রেও হিন্দু -মুসলমান বিভাজনে বিশ্বাস করতেন। সারস্বত সমাজকে তারা হিন্দু মুসলমানের বিভাজিত করে দেখতেই অভ্যস্ত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাদের কাছে কখনো বাঙালি কবি ছিলেন না ।ছিলেন হিন্দু কবি ।সেই কারণে তারা ছয়ের দশকের শুরুতেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে নানা ধরনের সদম্ভ উক্তি অবিভক্ত পাকিস্তানের ফৌজি শাসক আইয়ুব খান করেছিলেন। যার বিরুদ্ধে বাঙালির জাগ্রত বিবেক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল।
তাই গোলাপ মুরশিদ যখন সাতের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের এক ঝরো রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে বিদ্যাসাগরকে নিয়ে চর্চার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করবার চেষ্টা করলেন, তখন তাঁকে প্রথম থেকেই বহু বাধার পাহাড় অতিক্রম করতে হয়েছিল। সেই বাধার পাহাড় অতিক্রম করবার ক্ষেত্রে তাঁর জীবন সংশয় হয়েছিল। পরিবার-পরিজনের জীবন সংশয় হয়েছিল ।কিন্তু সারস্বত চর্চার ধর্মনিরপেক্ষ এবং আধুনিক মনন থেকে এক মুহূর্তের জন্য গোলাম মুরশিদ নিজেকে বিচ্যুত করেননি।
এপার বাংলার বহু গুণীজনের লেখা তিনি বিদ্যাসাগর চর্চা ঘিরে স্ব সম্পাদিত গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। এ কারণে তাঁকে পাক হানাদারদের কাছে নানা ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। আর চিরকালই তো 'দালাল 'শব্দটি শাসকের কাছে খুবই জনপ্রিয় শব্দ। তাই গোলাম মুরশিদকে খুব সহজেই বিদ্যাসাগর চর্চায় এপার বাংলার মনীষার সম্মিলন ঘটানোর দায়ে' ভারতের দালাল 'বলে অভিহিত করতে পিছপা হয় নি পাক শাসকেরা।
কিন্তু কোন ও অবস্থাতেই গোলাম মুরশিদ কে নিজের আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারা যায়নি ।একথা আরো জোরদার ভাবে বলতে হয় রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে তাঁর বিস্তারিত গবেষণার প্রেক্ষিতে ।রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে তাঁর গবেষণা রবীন্দ্রনাথের জীবনীর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার স্পর্ধা রাখে ।সেকালের পূর্ববঙ্গ ঘিরে রবীন্দ্র মানসের উদ্ভাসন, তাকে যেভাবে সুনির্দিষ্ট তথ্যপঞ্জি এবং সমসাময়িক ঘটনাক্রমে র নিরিখে গোলাম মুরশিদ সারস্বত সমাজের কাছে তুলে ধরেছেন , তা ঘিরে এপার বাংলায় খুব একটা আলোচনা না হলেও ,রবীন্দ্রচর্চার ক্ষেত্রে সে কাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ।পূর্ববঙ্গ কে বাদ দিয়ে রবীন্দ্র মনীষার সম্মুখ চর্চা হতে পারে না ।আর পূর্ববঙ্গের রবীন্দ্র মনীষার বিভিন্ন ধারা-উপধারার বিচরণ ,সেটি গোলাম মুরশিদের গবেষণা বাদ দিয়ে আলোচিত হতে পারেনা।