নজরুল মানস

শরীরের মৃত্যুর এতগুলো বছর পরেও সম্যক নজরুলচর্চায় কোথায় যেন একটা খামতি।টুকরো ছবিকে যে যার মত সাজিয়ে গাঁথতে চান নজরুলমালা।সেই মালা গাঁথা হয় না সম্পূর্ণ নজরুলফুলে--
 
নজরুলকে ঘিরে বাঙালির আবেগ আজ আর দেশের ঘেরাটোপে আবদ্ধ নয়।দেশের বেড়াজালকে অতিক্রম করে নজরুল আজ সমগ্র বাঙালির। অখন্ড বাঙালি আবেগ ঘিরে আমরা দেখতে ভালোবাসি নজরুলকে।কিন্তু কবির নিজের জীবনের বিবিধ টানাপোড়েনের বিনিসুতো তাঁকে একটা পরিপূর্ণ সত্তায় বাঁধবার সুযোগ পায় নি। নজরুল নিজে যতদিন কর্মক্ষম ছিলেন, ততদিন কখনো ই নিজেকে অপরিবর্তনীয় চেতনার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরতে আগ্রহী ছিলেন না।উর্ধ গগণে মাদল বাজিয়ে চলাই ছিল তাঁর বেঁচে থাকার প্রধান ছন্দ।সেই ছান্দসিক যাপনচিত্রে নানা সময়ে নানা সঙ্কট এসেছে।সবথেকে বেশি এসেছে অর্থসঙ্কট।কিন্তু কোন ও প্রতিবন্ধকতাই কখন ও ই কবিকে পুরোপুরি প্রতিষ্ঠানের গোলাম করে দিতে পারে নি। যদি কেউ তাঁকে ভিন্নতাহীন একটা উপকরণে তৈরি মনোলিথ বলে ঠাওরে থাকেন, বলতে দ্বিধা নেই, তিনি নজরুলকে চিনতে খুব ই ভুল করবেন। 
নজরুল নামক মালাটি কেবলমাত্র একটি ফুলেই গাঁথা হয় নি কখন ও।রজনীগন্ধা, কাঁঠালিচাঁপা, স্বর্ণচাঁপা, টগর, জবা, গোলাপ আবার আকন্দ- ধুতরোর সন্মিলিত মালা ছিলেন তিনি। নজরুলের কর্মক্ষম জীবনের বিভিন্ন ক্রমগুলির দিকে যদি আমরা একটু নজর দিই, তবে দেখতে পাব যে, বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁর চর্চার এবং যাপনে বিবর্তন ই ছিল অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।
নজরুলের মধ্যে একইসঙ্গে বিদ্রোহী সত্তা এবং প্রেমিক সত্তা কাজ করতো। এই দুই বিপরীতমুখী সত্তার মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, সেটা কিন্তু নজরুলের জীবনে কখন ও  দেখা যায়নি। সকল দ্বন্দ্ব বিরোধ মাঝে জাগ্রত যে ভালো, সেই তো তোমার ভালো--এটাই ছিল  তাঁর সামগ্রিক জীবন ,কর্ম পদ্ধতি এবং সৃষ্টির মূল রহস্য। কখনো কখনো মনে হয় ,একটা আপাতত বৈপরীত্যের মধ্যে দিয়ে নজরুল যেন তাঁর চলবার পথকে যেভাবে তৈরি করেছিলেন তা যথার্থভাবে হয়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের সেই উক্তি ,আমার পথে পথে পাথর ছড়ানো।
আমরা দেখি ব্যক্তি নজরুল তাঁর গোটা জীবন দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করেছেন।সেখানে কখনো তিনি রেলের ভাড়াই জোগাড় করতে পারছেন না , অথচ তিনি গাড়ি চড়তে ভালোবাসেন ।গাড়ি চড়বার ক্ষেত্রে তাঁর একটা শিশুদের মত ভাললাগা ,ভালোবাসা রয়েছে ।
এই আপাত বৈপরীত্যের  মধ্যে দিয়ে নজরুল যেন নিজের জীবন থেকে ছেঁকে তুলেছিলেন তাঁর সমগ্র সৃষ্টিকে ।তাই নজরুলের সৃষ্টির মধ্যে কখনো আরোপিত কোন ও বিষয় কে আমরা দেখতে পাই না। কল্পনাবিলাসী ছিলেন নজরুল,এ কথা  নিশ্চিত ভাবে কথা বলা যায়। কিন্তু সেই কল্পনা ,কখনো কষ্টকল্পনা ছিল না ।বাস্তবের জমিতে দাঁড়িয়েই ভবিষ্যতের স্বপ্ন তিনি দেখতে ভালোবাসতেন। আর সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করবার লক্ষ্যেই তিনি তাঁর সৃষ্টিকে পরিচালিত করেছিলেন। তাই তাঁর স্বপ্ন ছিল , নিজের  সৃষ্টিকে  সমকালীনতায় এবং ভাবীকালের  উদ্দেশে পরিচালিত করবার।
 সে কারণেই চড়ৈবতি  মন্ত্র ছিল নজরুলের জীবনের একেবারে বাস্তব একটি পর্যায়।
আমাদের কখনো নজরুলকে মনে হয় রাজনীতি নিয়ে তিনি অসম্ভব মত্ত ।আবার সেই নজরুলকেই মনে হয় ,তিনি কি রাজনীতি বিবাগী? রাজনীতির প্রতি তাঁর কি একটা অনীহা? যে নজরুল কে আমাদের মনে হয় প্রবলভাবে ধর্মহীন একজন মানুষ, সেই নজরুলকেই আবার আমরা দেখতে পাই ভক্তি রসে পরিপূর্ণ একজন পরম ধার্মিক ব্যক্তিত্ব ।
ধার্মিক কিন্তু কোন ও অবস্থাতেই ধর্মান্ধতার কালো অন্ধকারে নিজেকে তিনি আবদ্ধ করতে রাজি নন ।ধর্ম আর ধর্মান্ধতার কোথায় ফারাক,  সেই লক্ষণ রেখাটা নজরুল যেমন নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন, এবং প্রাণপণ চেষ্টা করে গেছেন সেই উপলব্ধির কথা সমকালকে বোঝাতে । ভাবি কালের জন্য সেই লক্ষণ রেখার বৃত্তটিকে পরিচিত করে দিতে।
 এই যে আপাত বৈপরীত্য তার মধ্যে দিয়েই যে ঐক্যের পরিবেশ গড়ে তোলা, সেদিকেই কিন্তু নজরুল তাঁর জীবনের সমস্ত গতিপথ কে পরিচালিত করেছিলেন।
কবি গোলাম মোস্তফা নজরুল সম্পর্কে লিখেছিলেন; 
কাজী নজরুল ইসলাম
 বাসায় একদিন গিছলাম ।
ভায়া লাফ দেয় তিন হাত
 হেসে গান গায় দিনরাত
 প্রাণে ফুর্তির ঢেউ বয়
 ধরার পর তার কেউ নয়।
নজরুলের অন্যতম সেরা জীবনীকার সদ্যপ্রয়াত গোলাম মুরশিদ ,  গোলাম মুস্তাফার লেখা এই কবিতাটি নজরুল সম্পর্কে বারবার উল্লেখ করতে ভালোবাসতেন। গোলাম মুরশিদ মনে করতেন;  মাত্র চব্বিশটি শব্দের মধ্যে দিয়ে যে যথার্থতায়  কবি গোলাম মোস্তফা ,নজরুলকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন ,এমনটা বোধহয় নজরুলের জীবনী  বা নজরুলের জীবন ও সাহিত্যে নিয়ে শত শত পৃষ্ঠার বই লিখেও লেখকেরা  কখনো ফোটাতে পারেননি।
              আসলে নজরুল বলতে বাঁশি আর রণতুর্য --এই ছবিটাই আমাদের কাছে একটা অদ্ভুত ভালোলাগা, ভালোবাসা ,কল্পনা এবং বাস্তবতা --এই অবিমিশ্রু একটা চিত্র এঁকে দেয়। একদিকে আমরা খুঁজে পাই এক বিদ্রোহী বীরের ছবি ।যে বিদ্রোহের অগ্নিগীতি তে আমাদের অন্তরাত্মা বারবার খুঁজে নিতে চায় স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতা কেবলমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়। কেবলমাত্র অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নয়। মনের মুক্তি ।মনের বিকাশ। আবার সেই রবীন্দ্রনাথের ভাষাতেই বলতে হয় ; এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়।
 সেই আলোর সন্ধান ,আলোর পিপাসা ,এটাই যেন নজরুলের সামগ্রিকতার একটা পরিপূর্ণ পরিচয়। যদি এক কথায় আমাদের মনে হয়,  কোন ও শব্দের উচ্চারণের ভেতর দিয়ে নজরুলকে আমরা পরিপূর্ণভাবে মেলে ধরতে পারবো, তাহলে প্রথমেই বলতে হয়, আলোর পিয়াসা। সেই আলোর সন্ধানে নজরুলের যে যাত্রা, সেই যাত্রায় ধর্মীয় আচার-আচরণ, সামাজিক রীতি-নীতি ,রাষ্ট্রের আইন কানুন-- কোনও কিছুই কখনো বিবেচ্য হচ্ছে না ।কোনও গণ্ডির মধ্যে নজরুলকে বেঁধে রাখা তাঁর স্বকালেও যেমন সম্ভব হয়নি ,আবার ভাবি কালেও সেটা সম্ভব পর হবে না ।
          নজরুল মানেই একটা বেপরোয়া বিদ্রোহ ।যে বিদ্রোহের মধ্যে কেবলমাত্র প্রতীকী বিদ্রোহের একটা মূর্ত প্রতীক, মূর্ত ছবি, বিমূর্ত ধারণা-- এসব লুকিয়ে নেই।
নজরুল তাঁর প্রথম জীবনে দেশের পূর্ণ স্বাধীনতার আহ্বান জানিয়ে যথার্থভাবে কারাবাস করেছিলেন। নজরুলের এই কারাবাস পর্ব ঘিরে ব্রিটিশের অত্যাচার, তা আমাদের অনেকেরই জানা। এই পর্বের ইতিহাস অধ্যাপক অরুণকুমার বসু এবং গোলাম মুরশিদ , তাঁদের নজরুল জীবনী গ্রন্থে খোদাই করেছেন।
 তা সত্ত্বেও কোথাও এসে যেন আমাদের বলতেই হয়, যদি কেবলমাত্র বিদ্রোহী বলে  নজরুলকে দেগে দেওয়া হয় ,তাহলে বোধহয় তাঁর সামগ্রিকতার প্রতি আমরা সুবিচার করব না ।এক মরমী প্রেমিক, সেটাই যেন নজরুলের সামগ্রিক সত্তার যথার্থ প্রকাশ। বিদ্রোহী সত্তার মধ্যেও প্রেমিক সত্তা কিন্তু নজরুল সযত্নে রক্ষা করে গেছেন ।সে প্রেম কিন্তু কেবলমাত্র ব্যক্তিপ্রেম বা নারীপ্রেমে আবদ্ধ নয়।  শুধুমাত্র দেশপ্রেমে ওআবদ্ধ নয়। সর্ব অর্থে এক মানবপ্রেমী সত্তা --সেটাই হলো সামগ্রিকভাবে নজরুলের সত্তা।
             নিজেই একটি বক্তৃতায় নজরুল অপপটে বলেছিলেন যে, কেবলমাত্র বিদ্রোহী- বিদ্রোহী বলে তাঁর সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের মনের ভিতর যেন একটা ভয় ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি অকপটে নিজের সম্পর্কে স্বীকার করেছিলেন, তিনি এসেছেন ,প্রেম নিতে আর প্রেম দিতে ।তাই প্রেমে প্রতিবাদে চিরপ্রণম্য  সত্তা হলেন নজরুল। এই সত্তার মধ্যে ফুর্তির  ঢেউ রয়েছে ।বিষণ্ণতার ঘন কালো মেঘ রয়েছে। যে বিষন্নতার গুরু ভারে  নজরুল একটা সময়ে একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন এবং তার নিজের উপরে বিষণ্ণতা যেভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল ,তা তাঁর শরীরকেও অনেকখানি আক্রান্ত করেছিল। তাঁর অসুস্থতা ঘিরে যে বাস্তবতা বা প্রচার ,যাই থাকুক না কেন, বিষন্নতার জের  শরীরে এবং মনে ক্লান্ত করে তুলেছিল নজরুলকে, সে বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। 
                ফুর্তিবাজ নজরুল আর বিষন্ন নজরুল--এই দুটোকে মাথায় রেখেই যেন আমরা সামগ্রিকভাবে নজরুল কে বিচার করি ।তা না হলে নজরুলকে বিচার করতে গিয়ে আমরা আবার ভুল করে ফেলব। এখন বোধহয় সময় এসেছে নজরুলকে ঘিরে সমস্ত ধরনের ভুল কে অতিক্রম করে র,ক্তমাংসের নজরুলকে যথার্থভাবে আমাদের চেতনার আরোহীনিতে স্থাপন করবার।

  • সম্পাদকীয়