সুনীলের ' আত্মপ্রকাশ' 

 
অনেকের ই ধারণা বেপরোয়া জীবনের ধারাভাষ্য লিখেছেন সুনীল ' আত্মপ্রকাশে' ।সময়ের ঝাপটে তরী বাওয়া এক স্বপ্নালু যুবকের দেশ হারানোর ব্যথা খোঁজার চেষ্টা এই উপন্যাসে বেশিরভাগ পাঠক ই করে না---
 
 
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের' আত্মপ্রকাশ' কে কয়েকটি যুবকের বেপরোয়া জীবনের কথা বলে ধরে নিলে ভুল হবে। দেশভাগের তীব্র যন্ত্রণা নবযৌবনকে কিভাবে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল, এ কাহিনী একটা ভিন্ন আঙ্গিকে তার ই সাক্ষ্যবহন করছে।' আত্মপ্রকাশ' কে কয়েকটা যুবকের ছন্নছাড়া যাপনের কাহিনী হিশেবে দেখা , এই উপন্যাসের প্রতি চরম অবিচার।কাহিনীর কুশীলবদের কারো প্রত্যক্ষ স্বদেশ হারানোর যন্ত্রণা , কারো বা সামাজিক কাঠামোর উপর দেশভাগের আঘাত জনিত প্রতিক্রিয়ার প্রভাব--দুই অংশের ভিতরে এই প্রভাব কি ভাবে সামাজিক বিন্যাসকে বিভ্রান্ত করতে পারে-- ,' আত্মপ্রকাশ' তার ই সামাজিক বিবরণ এবং মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ।
                           সুনীলের বহুল আলোচিত ,বহুল পঠিত ' আত্মপ্রকাশ' ঘিরে সাধারণ ভাবে পাঠকের মনে আলোচকেরা সুনীলদের সেই সময়ের বোহিমিয়ান জীবনের আখ্যান হিসেবেই উপন্যাস টিকে দাগিয়ে দিয়েছেন।আর সেই ধারাপাতকে বজায় রাখতে পাঠক উপন্যাসের অন্তরে যে কথা উঠে আসছে , সেদিকে কখন ও বিশেষ একটা নজর দেওয়ার সুযোগ ই পান নি।প্রচলিত ধারার আলোচনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েই বেশির ভাগ পাঠক একটা বয়সকালের বেপরোয়াপনাকেই এই উপন্যাসের উপজীব্য বলে ধরেছেন।আর সেই ভাবেই একটা মতের চশমা চোখে এঁটেই তাঁরা আত্মপ্রকাশ পড়তে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছেন।সেই আঙ্গিকেই তাঁরা সুনীলের প্রায় সামগ্রিক সৃষ্টির মূল্যায়ণ করতেও অভ্যস্থ হয়ে পড়েছেন।
                 উপন্যাসের প্রায় শুরুতে সুবিমলের দীর্ঘশ্বাস ফেলা কথা,' ভাবছি, কবিতা লেখা ছেড়ে এবার নভেল টভেল লিখতে শুরু করবো।'( পৃ- ১০, ' ৯৮ সালের মুদ্রণ, আনন্দ) এই যে দীর্ঘশ্বাস, তর ভিতর দিয়েই আমার সদ্য দেশভাগের পরের বাংলার যুব সমাজেল এক বেদনাত্তীর্ণ মন মানসিকতার ছবি পাই।এই ছবির ভিতর দিয়েই আমরা খুঁজতে শুরু করি একটা ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সময়কে। আজকের সময়ের প্রেক্ষিতে যদি আমরা সেদিন টাকে বুঝতে চেষ্টা করি, মনেহয় , কোথাও বিলকুল ভুল হয়ে যাবে।আর সেই ভুলের নিরিখেই আমরা অভ্যস্থ হয়ে পড়েছি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ,' আত্মপ্রকাশ' কে কেবলমাত্র প্রথা ভাঙা কয়েকটি যুবকের বেপরোয়া যাপনচিত্রের ছবি হিসেবেই চিত্রিত করতে।
                     সুনীল যখন ' আত্মপ্রকাশে' লিখছেন,' আজ একটা মারামারি হতে পারে।'- আর তারপর বারীনদার ঘরে মারামারি-- এসব অনেকের কাছেই সুনীলদের সেই সময়ের বেপরোয়াপনা এবং ' মানব না এ বন্ধনে, মানব না এ সংশয়ে' র জের বলে ঠাওর হতে পারে। কিন্তু সমকালের সামাজিক সঙ্কট, যে সঙ্কটের ঘূর্ণাবর্ত তৈরিতে সবথেকে বড় অনুঘটক ' দেশভাগ' তাকে বুঝতে না পারলে কিন্তু সময়ের যন্ত্রণাকে অনুভব করা যাবে না।আর ব্যক্তি সুনীলেরা এখানে কিভাবে সমকালীন বাঙালি যুবসমাজের মুখ হয়ে উঠেছেন, সেটাও ঠিক মত বুঝে ওঠা সম্ভবপর নয়।
আসলে এখন বাংলা সাহিত্যে থ্রিলার প্রিয়তা যে জায়গা করে নিচ্ছে, তাতে বারীনদার ঘরে মারামারি , হাতাহাতি, বেশ একটু গা ছমছমে পরিবেশ-- এসব অনেকের ই মনে হতে পারে , সেকালের অ্যাকশনের ধরণ। সমকালীন সামাজিক প্রেক্ষিত যখন যুবকদের দিশাহীন এক আবর্তের দিকে ঠেলে দেয়, তখন লক্ষ্যহীন পদক্ষেপ ভিন্ন উপায় থাকে না অনেকের কাছেই।আর সেই লক্ষ্যহীন পদচারণাই ব্যক্তি জীবনে তৈরি করে এমন কিছু প্রেক্ষিত যাকে ধরে রাখলে জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিসহ। জীবনের এই টানাপোড়েন গুলো একটা ক্রান্তিকালে ব্যক্তি থেকে সমষ্টিকে কিভাবে আচ্ছাদিত করতে পারে সুনীল এই উপন্যাসে একেবারে চিত্রমালার মত করে তাকে তুলে ধরেছেন।
এই উপন্যাসে সুনীল মিছিলের মুখের এক অনবদ্য বর্ণনা দিয়েছেন( পৃ-১১) , সে বর্ণার সঙ্গে কিন্তু কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ,' মিছলের মুখে' র মৌলিক কোন ও ফারাক নেই। সুনীল লিখছেন," শোভাযাত্রার লোকদের ঠিক একরকম দেখতে হয়।ঠিক, তিনটে প্যান্ট পরা লোকের পর দুজন ধুতি, একটি বেঁটে লোক লাইন মেক -আপ করার জন্যে আধা দৌড়োয়, এর পর কয়েকটি বুক প্লেন মেয়ে , দুটি পায়জামা - গেরুয়া পাঞ্জাবী চুলে তেল নেই , পিছনে আবার তিনজন প্যান্ট পরা।....... ওদের নিশ্চিত আশা আছে, অন্তত দশটা দবির মধ্যে জীবনে একটা না একটা পেয়ে যাবেই।" 
অধিকার ঘিরে অধিকার না পাওয়া মানুষের যে হতাশা, যন্ত্রণা আর তা থেকে তৈরি হওয়া বিরক্তি- এই উদ্ধৃতির অংশের ভিতর দিয়ে উঠে আসছে। আজ ও অধিকার না পাওয়া, যোগ্যতার দাম না পাওয়া, হতাশায় ভোগা যব সমাজ সেদিন সুনীলদের সেই মনোভাব, অন্তরের যন্ত্রণা, তা থেকে তৈরি হওয়া বিরক্তি-- এসব কিছুর থেকেই এতটুকু সরে আসে নি। তবে বলবার ধরণ খানিকটা বদলেছে।কারন, রাজনৈতিক মূল্যবোধের নিরিখে , সেদিন আর আজকের মধ্যে আসমান জমিন ফারাক।
দেশভাগ কিভাবে বিভাজনের পাঁচিল তুলতে শুরু করেছিল তার দগদগে ঘা দেখতে পাই সুবিমলের কথায়। সে নুরুলকে উদ্দেশ্য করে বলে, ' এই শালা , লেড়ের লেড়ে পাতি লেড়েটা আজকাল কথায় কথায় সংস্কৃত ঝাড়ছে।এই নুরুল ,তুই শালা মোছলমানের বাচ্চা , তোর অত সংস্কৃত আওড়াবার দরকার কি রে?.....নুরুল বললো , তুই চুপ কর্ শকুনি বামুন! চাল কলা খেয়ে খেয়ে তো রক্তটাও টিকটিকির মত সাদা করেছিস, আবার হিঁদুগিরি ফলানো।"( পৃ-২০) 
এই যে বন্ধুদের তরজা , সেখানে সমসাময়িকতা গ্রাস করেছে,' নেড়ে ' বা ,' হিঁদুগিরি' র মত শব্দ।কিন্তু সেদিন ও এমন দিন ছিল, যেদিন বন্ধুরা এসব কথা অবলীলায় বললেও তাঁদের মনের মধ্যে কোনো ঘৃণা ছিল না।বিদ্বেষ ছিল না। বন্ধুত্বের ছলে নরম গরম কথা বললেও সুবিমল কিন্তু নুরুলকে বলেছিল সংস্কৃত উচ্চারণ ঘিরে,' একদিন দাঁত ভেঙে যাবে বলছি, এখন ও ছাড়।' 
সেদিন এইসব বাক্যের ব্যবহারের পথ মসৃণ করেছিল দেশভাগ।তবু ও সেদিন এসব শব্দের ব্যবহার আজকের মত বিচ্ছেদের পাঁচিল কখনো ই তোলে নি। সুনীলদের প্রথম যৌবনের এই যে পরিবেশ সেটা সুনীল তাঁল জীবদ্দশার শেষ লগ্নেই দেখেছিলেন ভেঙে পড়তে।তাঁর প্রয়াণের পর প্রায় একটা যুগ অতিক্রান্ত।এই সময়কালে ওই ধরণের শব্দগুলি আর বন্ধুদের মধ্যে আড্ডার ছলে বলা কথা হয়ে আর নেই।সেসব কথা এখন মানুষে মানুষে বিভাজনের জন্যে তৈরি রাস্তাকে আরো মসৃণ করবার লক্ষ্যেই ব্যবহৃত হয়ে চলেছে।
অনুবাদের কাজ করে হাত খরচ চালায় সুবিমল।তাঁকে সুনীলের প্রশ্ন,' --কমুনিস্টরা তোকে এখনো কাজ দেয়?' 
সুবিমলের উত্তর,' -- যে টাকা দেবে আমি তারই কাজ করতে রাজী।রাশিয়ার যৌথ খামার আর আমেরিকা গোয়েন্দা গল্প আমার কাছে একই ,অনুবাদ করার কাজ হিসেবে বলছি আর কি!'( পৃ-৩৩, বানান অপরিবর্তিত) 
                          পেশাদারিত্বের যে ছবি সুবিমলের মধ্যে এঁকেছেন সুনীল, এ ছবি যে আগামী দিনে মানুষের আর্থিক সঙ্কট আর সেই সঙ্কট থেকে তৈরি হওয়া আবর্ত, যেখানে টাকা টাই একমাত্র বিষয়, চেতনা, বোধ , আদর্শ-- এসবের বিন্দুমাত্র ঠাঁই নেই-- এর হয়তো আগাম আভাস পেয়েই সুনীলের অমন উচ্চারণ সুবিমলের মুখ দিয়ে।
সুনীলের মনের গহীনে চিরকাল এই বোধ স্থায়ী আসন পেতে রেখেছিল,' যে জায়গায় আমি জন্মেছিলাম, তাও আমাকে ছেড়ে আসতে হয়েছে।' ( পৃ-৪০) তাঁর জন্মভূমি গাঁয়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলা দুর্দান্ত আড়িয়েল খাঁ নদী হারানোর যন্ত্রণা প্রথম জীবনেও সুনীলের যেমন ছিল, ঠিক তেমনটাই থেকে গিয়েছিল জীবনের অন্তিমপর্বে।বাড়ির ঠিক পাশেই যে বাতাবি লেবুর গাছ, বর্ষার জোলো হাওয়া উঠলেই সুনীল নিশ্চয় ই খুঁজতেন বাতাবী ফুলের গন্ধ।
মোহিনী চৌধুরীর লেখা সেই গান,' জেগে আছি একা' র ,' বাতাসে ভাসিছে বাতাবী ফুলের গন্ধ, বনে বনে জাগে ঝিল্লি নূপুর ছন্দ' শেষ দিন পর্যন্ত উদাস করে দিতো সুনীলকে।শ্মশানখোলার বটগাছে বসে তক্ষকের সেই ডাক, সে ডাক কল্লোলিনী কলকাতার চরম ব্যস্ততার মধ্যেও সেকালে যেমন শোনবার প্রত্যাশী ছিলেন সুনীল, জীবনের পরপারে ও তিনি নিশ্চয় ই সেই বাঁশের সাঁকোর উপরে বসে ঘূর্ণির জলে খোলসে আর বাঁশপাতা মাছের খেলা দেখেন।দেখতেই থাকেন।

  • গৌতম রায়
  • ফিরে পড়া