মিষ্টান্ন ভোজনের পর্ব শেষে এবার ফের ঘাটে আসবার পালা।
মারাঠা খালের পাশে রাস্তা ধরে দ্রুত পায়ে হেঁটে ছিদামরা ঘাটের দিকে এগোয়। খালের পাশে জায়গায় জায়গায় ঝোপ জঙ্গল।
কলকল করে জল বয়ে যাওয়ার শব্দ। এদিকে মেলা জায়গা এখনো ফাঁকা। উত্তরের এই দিকটাকে সাহেবরা বলে' ব্ল্যাক টাউন।'
জমিদারি পাওয়ার কিছুদিন পর পরই সাহেবরা এখানকার জমিদারি দেখাশোনার জন্য একজন ব্ল্যাক জমিদার কে নিয়োগ করেছিল। তার নাম গোবিন্দ মিত্তির। গোবিন্দ মিত্তির যতদিন বেঁচে ছিল খুব রবরবা ছিল। বহু লোকের ভিটেয় ঘুঘু চড়িয়েছিল। লোকে বলতো উমিচাদের দাঁড়ি/হুজুরি মলের কড়ি/গোবিন্দ মিত্তিরের ছড়ি।
সুতানুটির এই নগরপিতারা সকলেই সিরাজের সব্বোনাশে
যুক্ত ছিল।ব্ল্যাক জমিদার গোবিন্দমিত্তির ছিল এরকমই একজন। যদিও গোবিন্দরামের জালিয়াতি ধরতে পেরে শেষ পর্যন্ত কোম্পানি তাকে চাকুরী থেকে ছাঁটাই করে।।
ছিদামের সুতানটিবাস বেশ কয়েক বছর হয়ে গেলেও,
এখনো প্রতিদিন নতুন নতুন ভাবে এই শহরটা ছিদামের কাছে ধরা দেয়।
সুতানুটির এই দিকটায় শহরের বসতের একটা গড়ন আছে।
দুবিঘে তিনবিঘে জমি নিয়ে বড় বড় মানুষেরা এক একটা প্রাসাদ হাঁকিয়েছে। নবকেষ্ট রাজবল্লভ, গঙ্গা গোবিন্দ সিংহ এইসব
এসব ঘর বাদ দিলেও লাহা,শীল মল্লিক ,ধরেরাও আলিশান সব প্রাসাদ তৈরী করেছে। এইসব প্রাসাদের মত বাড়ি ঘিরে বাবুরা নিজেরাই বস্তি বসিয়েছে। বস্তির কুঠি ঘর ভাড়া থেকে আয় নেহাৎ মন্দ নয়। তাছাড়া শহরের যে বিপুল শ্রমের বাজার তার আড়ৎ হিসেবেও কার্যত এই বস্তি গুলো কাজ করে। সেই জন্য বড় বড় মানুষের ঘরবাড়ি ঠিক পিছনেই গড়ে উঠেছে বস্তি। আর মহল্লায় মহল্লায় বসানো হয়েছে বাজার।
কোন কোন বাজার শহরের বড় মানুষের নিজেদের মালিকানায়।
অনেক ক্ষেত্রে তাদের নামেই বাজারের নাম। আমার কোথাও মহল্লার নামের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে বাজারের নাম। কোম্পানি নিজেও একাধিক বাজারের মালিক। কিন্তু গোবিন্দপুরের দিকটায় গোরারা নিজেদের থাকার জায়গাটা যেরকম সাফসুতরো রাখে,
ব্ল্যাক টাউনের দিকটা একদমই সেরকম নয়।
জায়গায় জায়গায় জঞ্জালের স্তুপ। খাটা পায়খানার বিষ্ঠায় গঙ্গায় নিয়ে গিয়ে ফেলে দিলেই হলো। সন্ধ্যার পর অন্ধকারে ঢেকে যায় রাস্তা।
সন্ধ্যা হওয়ার মুখে মুখে সকলে নৌকায় পৌঁছাল।
নৌকার পৌঁছানোর পরে খুব দ্রুত নৌকা ছেড়ে দেয় কানাই যুধিষ্ঠিররা। এখনো ভাটা চলছে। যত দ্রুত এগিয়ে যাওয়া যায়। জোয়ারের টান শুরু হলে এগোনো মুশকিল হবে।
নৌকায় এগোতে থাকে। এবার সন্ধ্যা নামবে।
জটাকেশ বললে, তোমরা তো কালীঘাটের দিকে যাচ্ছ। আমি ওদিকে কেওট কৈবর্তদের পাড়ায় একটু যাব। রাতটা ওখানেই কাটাবো।
জটাকেশের কথায় ছিদাম অবাক হয় না। কারণ
জটাকেশের হুটহাট বিভিন্ন জায়গায় চলে যাওয়ার কথা ছিদাম জানে।
ছিদাম কানাইদের বলে, তোমরা একটু বাঁ দিক ধরে চলো। আমি পোস্তার ঘাটে নেমে যাব।
সুতানুটির জনপদ দ্রুত পেছনে ফেলে নৌকা গোবিন্দপুর এর দিকে এগোতে থাকে। পোস্তাঘাট আসতে ছিদাম নেমে যায়। নামবার আগে বলে কাল ফেরবার সময় একবার শোভাবাজারের গদিঘর ঘুরে যেও। যদি ফিরতি মালামাল কিছু নেওয়ার থাকে তুলে দেব।
ছিদাম যখন নামছে জটাকেশ নৌকার গলুই এর উপর এসে দাঁড়ায়। একটা দাঁড়কাক কোথা থেকে সন্ধ্যার অন্ধকার ছিড়ে উড়ে এসে জটাকেশের কাঁধে বসে।
দাঁড় কাকটি পরিণত বয়সের। চঞ্চু রীতিমতো দৃঢ়। ল্যাজ অর্ধগোলাকার। বাজিকরদের অনেকের কাঁধে বাজপাখী বসে থাকতে দেখা যায়। প্রায় একই রকমের ভঙ্গিমা নিয়ে পুরুষ দাঁড় কাকটি জটাকেশের কাঁধে এসে বসে। জটাকেশ তাকে বলে, তুইও যাবি নাকি? চ তাহলে।
কাকটি গম্ভীর স্বরে বলে, কঅঅঅ......
ছিদামের কানে অনেকটা 'হ' এর মতো শোনায়।
পোস্তা থেকে নৌকা ছেড়ে দেয়।
বড় বাজারের সারি সারি পাকা বাড়ি নৌকা থেকে চোখে পড়ে।
ডিহি কলকাতা সুতানটি এবং গোবিন্দপুর এর মধ্যে বড়বাজার এলাকাটাতে সব থেকে বেশি পাকা বাড়ি এখনো।
বহু নৌকা এক এক করে ঘাটে নোঙর করে দিচ্ছে। অনেকে অবশ্য এগিয়ে চলেছে। মালবাহী বিভিন্ন মাপের নৌকা অনেকেই বেতর অব্দি যাবে। কেউ কেউ টালি নালার মুখে নোঙ্গর করে
সকালবেলা আদি গঙ্গার খাল ধরে তারদা বন্দর হয়ে আরো পূবমুখে এগিয়ে যাবে।
চাঁদপাল ঘাট আসতে বৌরানীর খাল চোখে পড়ে। গোবিন্দপুর আর ডিহি কলকাতার সীমান্ত বলা যেতে পারে এই খালকে।
লালদিঘির পাশ দিয়ে এই খাল চাঁদনি ,জাননগরকে ডান দিকে রেখে সোজা এগিয়ে গেছে।
মিশেছে বিদ্যাধরীর এক শাখা নদীর সঙ্গে। ডিহি কলকাতার সঙ্গে বেলেঘাটার আর পূবের জলার যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ এই বৌরানীর খাল।
ছিদামদের নৌকাটাকে একটু মাঝ নদীতে সরিয়ে নিয়ে যেতে যেতে, যুধিষ্ঠির বললো, আমি একবার বাবার সঙ্গে বড় বাজারে কিছু মাল নামিয়ে এই খাল ধরে বেলেঘাটা বিদ্যাধরী হয়ে মাতলা হয়ে একেবারে খুলনা অব্দি চলে গিয়েছিলাম।
(চলবে)