৫০ পেরিয়েও চিরসবুজ – কলকাতা দূরদর্শন

আগস্ট ১৯৭৫। দু’মাসও হয়নি সারা দেশে সরকারি ভাবে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। কেন্দ্রে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার তখন রাজনৈতিক আক্রমণে বিধ্বস্ত। তীব্র সমালোচনায় বিদ্ধ। তারই মধ্যে ১লা আগস্ট, ১৯৭৫ দেশজুড়ে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় দূরদর্শন পরিষেবার সূচনা করলেন। এর ঠিক আটদিন পর কলকাতায় চালু হল দূরদর্শনের সম্প্রচার। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের যে প্রথম দৃশ্য-শ্রাব্য অনুষ্ঠানটিকে দিয়ে কলকাতা দূরদর্শনের পথ চলা শুরু, টালিগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী রাধা স্টুডিওতে পূর্ণাঙ্গ সেই অনুষ্ঠানটিকে আগে থাকতেই যন্ত্রে ধারণ করে রাখা হয়। উদ্বোধনের দিন কলকাতা দূরদর্শন কেন্দ্রে উপস্থিত ছিলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী বিদ্যাচরণ শুক্ল ও সত্যজিৎ রায়। তখন সারাদিনে মাত্র তিন ঘণ্টা সময়ের জন্য কলকাতা দূরদর্শনে অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হত। এমনকি কলকাতা শহরের পঞ্চাশ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের বাইরে যাঁদের বাস, তাঁদের কাছেও সঠিক ভাবে দূরদর্শনের সঙ্কেত পৌঁছত না। তবু, ৯ই আগস্ট, ১৯৭৫ – কলকাতা দূরদর্শনের প্রথম অনুষ্ঠান। সঞ্চালিকা শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্ত সেদিন বলে উঠেছিলেন, “নমস্কার, কলকাতা টেলিভিশনের অনুষ্ঠান শুরু হল ব্যান্ড এক, চ্যানেল চারে … আপনারা দেখছেন” ইত্যাদি। বেতারজগৎ পত্রিকায় এক সময়ে লেখা হয়েছিল, “জগতে এমন একটি যন্ত্র এসে গিয়েছে, যাতে একইসঙ্গে কথা শোনা যায়, ছবিও দেখা যায়। তার নাম টেলিভিশন। কলকাতায় টেলিভিশন আসতে আর দেরি নেই, এখন থেকে তরকারি কুটতে কুটতে আঙুরবালার গান শোনা যাবে, আবার তাঁকে দেখাও যাবে।” সেই মজাতেই বাঙালী অবশেষে মজেছিল সেদিন। সাড়ম্বরে যাত্রা শুরু হয়েছিল কলকাতা দূরদর্শনের।
 
কলকাতার পাশাপাশি সেই সময় দিল্লি, মুম্বাই, অমৃতসর, লখনউ, মাদ্রাজ ও শ্রীনগরে দূরদর্শন পরিষেবার সম্প্রচার শুরু হয়। সারা পৃথিবীর ইতিহাসে কলকাতা দূরদর্শন ছিল বাংলা ভাষায় গড়ে ওঠা তৃতীয় দূরদর্শন পরিষেবা। এর আগে ১৯৬৪ সালে ঢাকায় ও ১৯৭৪ সালে নাটোরে বাংলাদেশ টিভির সম্প্রচার শুরু হয়। এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রথম বিদেশ সফরে ইন্দিরা গান্ধীর আমন্ত্রণে শেখ মুজিবর রহমান যখন ভারতে আসেন, তখন কলকাতা ময়দানে বঙ্গবন্ধুর নাগরিক সম্বর্ধনা সম্প্রচারের জন্য বাংলাদেশ টিভির একটি বিশেষ আউটডোর ব্রডকাস্টিং ভ্যান বা সংক্ষেপে ওবি-ভ্যানকেও কলকাতা নিয়ে আসা হয়। তখনও অবধি কলকাতায় দূরদর্শন পরিষেবা চালু হয়নি। কলকাতার সাংবাদিকেরা অবাক হয়ে সেদিন সেই ওবি-ভ্যানের কীর্তিকলাপ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এরও প্রায় সাড়ে তিন বছর পর কলকাতা দূরদর্শনের পথ চলা শুরু। তখন বলা হত ‘টেলিভিশন’। আরও কিছুকাল পর ‘দূরদর্শন’ শব্দের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। তারপর কেবলই ইতিহাস গড়ে চলা।
 
বেছে নেওয়া সংবাদপাঠক ও সংবাদপাঠিকাদের প্রশিক্ষণের জন্য পুণা ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে অধ্যাপক, চলচ্চিত্রকর্মীরা আসেন। বাংলা থেকে প্রশিক্ষক হিসেবে সেই কর্মশালায় অংশ নেন মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদারের মতো মানুষ। পরবর্তীতে পুণা ফিল্ম ইনস্টিটিউটেই দূরদর্শনের জন্য আলাদা করে একটি পাঠ্যক্রম তৈরি হয়। যে পাঠ্যক্রম চালুর প্রথম দিনে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। পুণা ফিল্ম ইনস্টিটিউটের অধিকর্তার পদে তখন রয়েছেন ঋত্বিক ঘটক। যদিও অল্প সময়েই ঋত্বিক সেই প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে আসেন।
 
কলকাতা দূরদর্শনের প্রথম দিককার সেই দিনগুলোয়, ঝরঝরে ইংরেজিতে খবর পড়তেন এন বিশ্বনাথন ও লীনা সেন। বাংলা ভাষায় সংবাদ-উপস্থাপক হিসেবে নজর কাড়েন ছন্দা সেন, তরুণ চক্রবর্তী, দেবরাজ রায় প্রমুখ। এই সময়েই পঙ্কজ সাহার ভাবনায় শুরু হয় ‘সাহিত্য সংস্কৃতি’ অনুষ্ঠানের সম্প্রচার। সেই অনুষ্ঠানেই একে একে অংশ নেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সাহিত্যিক শঙ্কর অথবা কথাকোবিদ শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। শিল্পজগত থেকে এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন চিত্রশিল্পী এম এফ হুসেইন, বিকাশ ভট্টাচার্য, ভাস্কর রামকিংকর বেইজ। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে প্রযোজিত হয় একের পর এক কালজয়ী অনুষ্ঠান। যেগুলির অধিকাংশেরই চিত্রনাট্য অথবা ভাষ্য রচনা করেন কবি ও অধ্যাপক শঙ্খ ঘোষের মতো মানুষ। গুণমানে সবদিক থেকেই সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে কলকাতা দূরদর্শনের সম্প্রচার।
 
আক্ষেপ করেছেন দূরদর্শনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সবাই। পর্যাপ্ত পরিকাঠামো না থাকার কারণে কলকাতা দূরদর্শনে সম্প্রচারিত হওয়া এমন কালজয়ী একেকটি অনুষ্ঠানের অধিকাংশকেই পরবর্তীতে আর সংরক্ষণ করা যায়নি। অথচ এই কলকাতা দূরদর্শনের স্টুডিওতে বসেই সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন শান্তির দূত মাদার তেরেসা। মাদারের মৃত্যুর পর কলকাতা দূরদর্শন তাঁর সমগ্র অন্ত্যেষ্টি অনুষ্ঠানেরও সম্প্রচার করে। সারা পৃথিবীতে সেই অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়। জেলমুক্তির পর দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতি নেলসন ম্যাণ্ডেলা কলকাতা সফরে আসেন। কলকাতা ময়দানে তাঁকে নাগরিক সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। সেই অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতে গিয়ে প্রথমবারের জন্য দূরদর্শন কর্তৃপক্ষ ‘এরিয়ল শট’ নেবার প্রয়োজনে হেলিকপ্টার ব্যবহার করে। এর আগেও, ১৯৭৭। কসমস ক্লাবের হয়ে কলকাতায় প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে এলেন ফুটবল সম্রাট। কলকাতা দূরদর্শনই তখন ইডেন উদ্যান থেকে সরাসরি সেই ঐতিহাসিক ম্যাচ সম্প্রসারণের দায়িত্ব পালন করে। ঘরে বসেই সাদা কালো পর্দায় কালোমানিক ‘পেলে’র ফুটবল-জাদুকরী দেখতে পেয়ে মুগ্ধ হয় শহর কলকাতা।
 
অথচ এমন সময়েই একবার দূরদর্শন কর্তৃপক্ষকে চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায় জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তা বাপু পর্দায় তোমাদের ছবি অত কাঁপে কেন?” আধিকারিক জবাব দিয়েছিলেন, “আজ্ঞে আমাদের ক্যামেরার জন্য ভালো স্ট্যাণ্ড নেই কিনা, তাই।”
 
“তবে তো হয়েই গেল,” স্বগতোক্তি করেছিলেন সত্যজিৎ।
 
১৯৭৭। প্রথমবারের জন্য ১৯৪৭এর স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বাম সরকার গঠিত হল। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে জ্যোতি বসু শপথ নেবেন। নির্বাচনী ফলাফলের পর কলকাতা দূরদর্শনেই সম্প্রচারিত হল তাঁর প্রথম সাক্ষাৎকার। খবরের কাগজগুলিও তখন ‘দূরদর্শনে দেওয়া সেই সাক্ষাৎকার’, এমনি ভাবেই সেই সাক্ষাৎকারকে উদ্ধৃত করে নিজেদের খবর সাজাতে বাধ্য হল। এরও অনেক বছর পর এই জ্যোতি বসুই আবারও ইতিহাস সৃষ্টি করবেন। তাঁর হাত ধরেই দেশের প্রথম মোবাইল টেলিফোন ব্যবস্থার উদ্বোধন হবে।
 
৬ই জুন, ১৯৮৩ – কলকাতা দূরদর্শনে প্রথম রঙিন সম্প্রচার শুরু হয়। ৩০শে অক্টোবর ১৯৮৭, সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় তৈরি রঙিন তথ্যচিত্র ‘সুকুমার রায়’ প্রথমবারের জন্য দূরদর্শনের পর্দায় সম্প্রচারিত হয়। ২০শে আগস্ট ১৯৯২, কলকাতা দূরদর্শনের নাম পালটিয়ে ‘ডিডি বাংলা’ রাখা হয়। ১৯৯৬ ও ১৯৯৮তে যথাক্রমে শান্তিনিকেতন ও জলপাইগুড়িতে দূরদর্শন সম্প্রচার কেন্দ্র গড়ে ওঠে।
পঙ্কজ সাহার স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছে ১৯৭৮ সালের ভয়াবহ বন্যার বিবরণ। বয়সের নিরিখে নাবালক কলকাতা দূরদর্শন তখনও তার সামান্য পুঁজি ও পরিকাঠামো নিয়ে জেলায় ছুটে গিয়েছে। দূরদর্শনেরই সম্প্রচারের মাধ্যমে উঠে এসেছে সরকারি কর্মচারীদের চরম গাফিলতির প্রমাণ। বর্ষার সময় বাঁধের জল না ছেড়েই কর্মী-আধিকারিকেরা পিকনিকে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। আর সেই কারণেই হিংলোর বাঁধ ভেঙে ধেয়ে আসে জলস্রোত। আক্রান্ত হন লাখে লাখে মানুষ। দূরদর্শনের সম্প্রচারের কারণেই এর পরবর্তীতে হিংলো বাঁধ প্রকল্পের আধিকারিকদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। শত অসুবিধা সত্ত্বেও নিরপেক্ষ, সৎ সাংবাদিকতার আদর্শে অটুট ছিল কলকাতা দূরদর্শন।
 
সেই থেকে আজ ২০২৪ সাল। স্বর্ণজয়ন্তী পার করে এল কলকাতা দূরদর্শন। এখন তাঁর জৌলুস অনেকাংশেই অস্তমিত বলে মনে হয়। তবুও বাঙালী জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে তার অস্তিত্ব থেকে গিয়েছে। মহালয়ার অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে বাংলা নববর্ষে বৈঠকী আড্ডার আয়োজন – বিভিন্ন উৎসবের সময় অন্যান্য টিভি চ্যানেলগুলিও ঠিক যে কায়দাতে তাদের অনুষ্ঠান সাজায়, অনেককাল আগে থাকতেই কলকাতা দূরদর্শন সেই একই কায়দাতে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে এসেছে। কাজেই, বাংলা বেসরকারি টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও, এখনও অবধি যে গড়পড়তা আঙ্গিক বা প্রচারের ধরণ, আদতে কলকাতা দূরদর্শনের দেখানো পথ ধরেই তাদের বিবর্তন। অথচ বয়সের নিরিখে পঞ্চাশের কোঠায় পা রাখতে রাখতে আজ, কলকাতা দূরদর্শন কি ক্রমশই তার এই হারিয়ে যাওয়া ‘সোনার দিন’ আবারও নতুন জৌলুসে ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হবে? নাকি সার্ভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট তত্ত্বের আলোচনায় বাজারি প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে ক্রমশই কলকাতা দূরদর্শন এগোবে স্বাভাবিক মৃত্যুর অভিমুখেই?
 
প্রশ্ন থেকেই যায় – নস্টালজিয়া থেকে ‘ভাবীকাল’, কোন পথে তাহলে আজ দূরদর্শনের ভবিষ্যৎ?

  • অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়