ছন্দের খোঁজে একটি জীবন

ছন্দোব্রতী রামবহাল তেওয়ারির প্রয়াণ

নিভৃত সাধকের নিভৃত প্রস্থান। শান্তিনিকেতন ই কেবল অনাথ হলো না, অনাথ হলো সমস্ত মাতৃভাষাচর্চার আঙ্গিক ই--

Image preview

যাঁর মাতৃভাষা আদপেই বাংলা নয়, বাল্যকালে যিনি জানতেনই না একবর্ণ বাংলা, অথচ তিনিই হয়ে উঠলেন একদিন বাংলা সাহিত্যের স্বনামধন্য গবেষক ও অধ্যাপক— এমন কথা শুনলে মনে হয় কোনও উপন্যাসের চরিত্রের কথা বলছি বোধহয়! বিশ্বভারতী বাংলা বিভাগের সদ্যপ্রয়াত প্রাক্তন অধ্যাপক রামবহাল তেওয়ারির জীবনটা কিন্তু বাস্তবে এরকমই ছিল। উত্তরপ্রদেশের উত্তর-পূর্বপ্রান্তের দেওরিয়া জেলার বরপারগ্রামের গোমতী মণি ত্রিপাঠীর পুত্র রামবহালের মাতৃভাষা ছিল আসলে ভোজপুরী। তাঁর দাদা কেদার মণি ত্রিপাঠীর ছিল ট্রান্সপোর্টের ছোটখাটো ব্যাবসা। সেইসূত্রে কলকাতা তথা বাংলার সঙ্গে তাঁর গড়ে উঠেছিল একরকমের সংযোগ। বোলপুরে একটা পানের দোকানও দিয়েছিলেন কেদার ত্রিপাঠী। বোলপুরেই কেন? বরপারগ্রামেরই শালিখ তেওয়ারি তখন ব্যাবসা করতেন বোলপুরে। বরপারগ্রামের ‘মণি ত্রিপাঠী’রা অনেকেই পরে পদবি লিখবেন ‘তিওয়ারী’। ভারতবর্ষের গাঁইগোত্রের সামাজিক ইতিহাস সত্যিই খুব বর্ণময়। তো সে যাই হোক, দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া ছোট্ট রামবহালকেই দাদা কেদার দিয়েছিলেন পানের দোকান সামলানোর ভার।

রামবহাল পানের গায়ে চুন-খয়ের লাগান আর চেয়ে চেয়ে দেখেন, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কেমন ইস্কুলে যাচ্ছে! আক্ষেপ জমে তাঁর মনে। কেননা ইস্কুল নামের স্বর্গ থেকে শিশুবয়সেই ঘটে গেছে তাঁর নির্বাসন। এই নির্বাসন মেনে নিতে পারলেন না রামবহাল। সাহসে ভর করে একদিন ‘শিক্ষাসঙ্ঘ’ নামে পাশের একটি বইয়ের দোকানে গিয়ে হাজির হলেন তিনি। বাংলা জানেন না। রামবহাল ইঙ্গিতে-ভঙ্গিতে বোঝালেন তিনি একটি বাংলা প্রাইমার কিনতে চান। ছেলেটির লেখাপড়ার আগ্রহ দেখে খুব খুশি হলেন দোকানের মালিক ভোলানাথ নায়েক। দাদা কেদারকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বালক রামবহালকে তিনি স্থানীয় বাসন্তী বিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিলেন। আর আপার প্রাইমারিতে সেই বালকটিই হলেন জেলার প্রথম স্থানাধিকারী।

পরীক্ষায় এই ভাল ফলের খবর কিন্তু জানতেন না রামবহাল। ব্যবসায় লোকসান করে ততদিনে কেদার ভাই রামবহালকে নিয়ে ফিরে গেছেন স্বগ্রামে। ভোলানাথ চিঠি লিখলেন: তুমি জেলায় প্রথম হয়েছ। অতএব শীঘ্র ফিরে এসে আবার লেখাপড়ায় মন দাও। উত্তরে রামবহাল লিখলেন, তাঁর ফেরার আর কোনও উপায় নেই।Image preview থাকবেন কোথায় বোলপুরে? খাবেন কী? তেমন আর্থিক-সংগতি তো নেই তাঁর পরিবারের! উপায় বের করলেন ভোলানাথই। ‘শিক্ষাসঙ্ঘ’ দোকানটাই হয়ে উঠল তাঁর থাকার জায়গা, পড়বার জায়গা। অন্য একটা জায়গায় বাসনমাজা, জলতোলার মতো কিছু কায়িক কাজের বিনিময়ে দুবেলা দুমুঠো অন্নসংস্থানের ব্যবস্থাও হল তাঁর। বোলপুর হাইস্কুল, বেলুড় বিদ্যামন্দিরে কিছুকাল পড়াশোনা করে রামবহালের জীবনদেবতা আবার তাঁকে ফিরিয়ে আনলেন সেই বোলপুরেই। এবার তিনি ভর্তি হলেন বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগে। অধ্যাপক প্রবোধচন্দ্র সেন, উপেন্দ্রকুমার দাস, পঞ্চানন মণ্ডল, সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ দিকপাল অধ্যাপকদের কাছ থেকে সেখানে রামবহাল পেলেন অনিঃশেষ স্নেহ।

এরপর অবশ্য রামবহালকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। বোলপুর হাইস্কুলে সামান্য কিছুদিন পড়ানোর পর ধীরানন্দ রায় তাঁকে শিক্ষক করে নিয়ে এলেন বিশ্বভারতীর শিক্ষাসত্রে। সেসময় বিশ্বভারতীর ‘টেগোর চেয়ার প্রফেসর’ অধ্যাপক প্রবোধচন্দ্র সেন তাঁকে রবীন্দ্রভবনে রিসার্চ ফেলো হিসেবে গ্রহণ করলেন। প্রবোধচন্দ্রের অবদানই তাঁর সারস্বত জীবনে সবচেয়ে বেশি। ছন্দচর্চার ক্ষেত্রে অধ্যাপক রামবহাল তেওয়ারির এই যে ভারতজোড়া খ্যাতি, তার নেপথ্যে রয়েছে ছান্দসিক প্রবোধচন্দ্র সেনেরই সবচেয়ে বড় অবদান। আর অবদান বিশ্বভারতীর। একদিকে বিশ্বের সঙ্গে ভারতের, আর অন্যদিকে ভারতের বিবিধ সংস্কৃতিকে একসূত্রে মেলাবার প্রতিষ্ঠান হল কবির ‘বিশ্বভারতী’। প্রবোধচন্দ্র সেনের একদা সহযোগী অমিয়কুমার সেন তখন পাঠভবনের অধ্যক্ষ। শিক্ষাসত্রের অধ্যক্ষ ধীরানন্দ রায়ের মতো তাঁরও মনে হয়েছিল, ত্রিভাষী রামবহালকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করলে ছাত্র-ছাত্রীদের বাংলা-হিন্দি দুটো বিষয় পড়ানোর কাজ সহজেই নিষ্পন্ন হতে পারে। রামবহাল শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হলেন পাঠভবনে; উত্তরকালে যেখানে তিনি কিছুদিন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

নেপাল রোডের পাশে একটি বেলগাছের নীচে ছিল পাঠভবনে রামবহাল তেওয়ারির তিনবছরের বেদি। তারপর ডাক এল বিদ্যাভবনের বাংলা বিভাগে। যে-বিভাগের তিনি ছাত্র, সেই বিভাগে একদিন অধ্যাপনার সুযোগ পাবেন— এ বোধহয় বরপারগ্রামের সেই বালকের একদিন স্বপ্নেরও অতীত ছিল।

কিন্তু কেন রামবহালের বিশ্বভারতীতে এই ক্রমিক উত্তরণ? রামবহাল নির্বিরোধ নিতান্ত ভালমানুষ এবং শিক্ষকদের একান্ত অনুগত বলে? হিন্দিবলয় থেকে আসা এক ব্রাহ্মণ সন্তান তীব্র জীবন-সংগ্রাম করে ‘বাংলা’-কে আপন করে নিয়েছিলেন বলে এ কি নিতান্ত পারিতোষিক পুরস্কার? এককথায় এর উত্তর ‘না’। এর উত্তর পেতে চাইলে জানতে হবে সেইসময়ের বিশ্বভারতীকে। আর বোঝবার চেষ্টা করতে হবে কীভাবে ‘বিশ্বভারতী’র বিদ্যাভাবনা নিজগুণে আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন তরুণ রামবহাল, সেই দিকটি।

জন্মসূত্রে ভোজপুরী আর হিন্দি জবান নিয়েই তো জন্মেছেন রামবহাল! ‘বাংলা’ ভাষা-সাহিত্য হল তাঁর সানুরাগ শ্রমলব্ধ অর্জন। রামবহাল দেখলেন, বিশ্বভারতীর বিদ্যাভবন সেই জায়গা, যেখানে শুধু বাংলা বা হিন্দি নয়; ওডিয়া, অসমীয়া ইত্যাদি ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় ভাষাশিক্ষারও সেখানে রয়েছে অবারিত সুযোগ। আশির দশকের গোড়ার কথা। রামবহাল তখন ওডিয়া বিভাগের একটি সেমিনারে ওডিয়া ছন্দ নিয়ে বক্তৃতা করার সুযোগ পেলেন। তখন ওডিয়া বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ছিলেন খগেশ্বর মহাপাত্র। সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন মনস্বী উপাচার্য অম্লান দত্ত আর শিক্ষাগুরু প্রবোধচন্দ্র সেন। ততদিনে প্রবোধচন্দ্র সেনের সুযোগ্য ছাত্র হিসেবে ছন্দের বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক ব্যাখ্যায় পারঙ্গম হয়ে উঠেছেন রামবহাল নিজেও। ওডিয়াভাষীদের কাছে মনে হল, ঠিক এমন করে তো কেউ ওডিয়া ছন্দের আলোচনা আগে করেননি! তাঁদের অনুরোধে-উপরোধে রামবহালকে লিখে ফেলতে হল ওডিয়া ছন্দের উপর আস্ত একখানা বই। শিক্ষাগুরু প্রবোধচন্দ্র সেন খুশি হয়ে সেদিন বলেছিলেন, রামবহাল আজ বিশ্বভারতীর আদর্শই একভাবে সাধন করলেন। মনুষ্য সভ্যতায় অর্জিত দেশের এবং বিদেশের নানাবিদ্যার আদান-প্রদানই বিশ্বভারতীর লক্ষ্য। ভোজপুরী রামবহাল বাংলা-বিদ্যায় কৃতবিদ্য হয়ে এখন ওডিয়া ছন্দ নিয়ে লিখে ফেললেন গবেষণা-প্রবন্ধ! এইরকম বিদ্যোৎসাহেই পরে রামবহাল লিখবেন ‘রবীন্দ্রনাথ ও পূর্বাঞ্চলীয় চার ভাষার ছন্দ’ নামে আরেক গবেষণাগ্রন্থ। এখন যে নানারকম সাহিত্যের তুলনামূলক, কিংবা আন্তর্বিদ্যামূলক চর্চা নিয়ে বিদ্যায়তন এত সরগরম থাকে; রামবহাল তেওয়ারির মতো সাহিত্য-ব্যক্তিত্বেরাই একরকমভাবে শ্রমিকের মতো তার ভিত গড়ে তুলেছিলেন। বিদেশি তত্ত্ব নিয়ে তাঁদের তেমন উৎসাহ ছিল না। কিন্তু তুলনামূলক সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে একরকম দেশীধারার তাঁরাই হলেন পথিকৃৎ। ছন্দচর্চা মানে তো এক অর্থে দেশচর্চাও বটে! কেননা, বিভিন্ন ভাষার ছন্দের ভিতর দিয়েই ব্যক্ত হয় সেইসব ভাষার মেজাজ; যা সেইসব ভাষাভাষীর সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে থাকে। ‘ভার্নাকুলার’ ভাষাচর্চাও একহিসেবে তাই দেশচর্চা।

ছান্দসিক প্রবোধচন্দ্র সেনের তত্ত্বাবধানে ‘আধুনিক হিন্দি ও বাংলা ছন্দ’ নিয়ে তুলনাত্মক একটি গবেষণা করে বিশ্বভারতী থেকে পিএইচ.ডি উপাধি পান রামবহাল। সেই গবেষণাপত্রের পরীক্ষক ছিলেন যথাক্রমে ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় আর হাজারীপ্রসাদ দ্বিবেদী। সুনীতিকুমার এসেছেন শান্তিনিকেতনে। তরুণ রামবহালকে কাছে পেয়ে আপ্লুত সুনীতিকুমার বলেন, ‘আপনার কাছে আমার আর একটা দাবি আছে। আপনি ভোজপুরী সাহিত্যের একটা ইতিহাস লিখে ফেলুন।’ আচার্য-আদেশ শিরোধার্য করে— মাতৃভাষা যাঁর ভোজপুরী আর অর্জিত ভাষা বাংলা; সেই রামবহাল বাংলায় লিখে ফেললেন ‘ভোজপুরী সাহিত্যের ইতিহাস’। তাঁর এইসব আন্তর্ভাষিক লেখালেখিতে একদিকে অবাঙালি ভুবনে প্রসারিত হল বাংলা, সঞ্চারিত হলেন রবীন্দ্রনাথ, আর অন্যদিকে বাঙালির জানা হয়ে গেল হিন্দি, ভোজপুরী, ওডিয়া, অসমীয়া ইত্যাদি ভাষা-সাহিত্যের নানারহস্য। একদিকে বাঙালিকে তিনি জানান ‘রবীন্দ্রনাথ ও হিন্দিসাহিত্য’-এর খবরাখবর। অন্যদিকে হিন্দি ‘আজ’ পাক্ষিকে এগারো বছর ধরে (১৯৭০-১৯৮১) ডাকহরকরার মতো ছড়িয়ে দেন ‘শান্তিনিকেতনের চিঠি’। গভীর এক শান্তিনিকেতন-সংবেদন ছাড়া কেউ কি এইসব স্বেচ্ছাবৃত দায়িত্ব এমনি এমনি নিজকাঁধে তুলে নেন নীরবে?

সজ্জন রামবহাল তেওয়ারি পরিচিতদের নমস্কার করে সবসময় বলতেন, ‘স্বস্তি। স্বস্তি।’ এই ভারতীয় স্বস্তিমন্ত্র তথা শান্তিবচনের গভীর এক দার্শনিক তাৎপর্য আছে। শান্তির মূলে আছে ‘শম’ ভাব। শমতা আসে কিসে? জগৎজোড়া এক ছন্দোময়তায়। ছন্দরিক্ততাই হল অশান্তি। ক্যাওস। সাহিত্যে ও জীবনে ছন্দের খোঁজে একটা জীবন উৎসর্গ করে গত ২৬ অগস্ট প্রয়াণের সমে এসে পৌঁছলেন অধ্যাপক রামবহাল তেওয়ারি।

  • মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়