‘মেরে ওকে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, সুনীলদা নিয়ে এসে আবার বসিয়ে দিলেন’- বক্তা নয়ের দশকের প্রখ্যাত কবি পিনাকী ঠাকুর। স্থানও সবার খুবই পরিচিত। গড়িয়াহাট আনন্দমেলার পাশের মার্কেটের তিনতলায় ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার কার্যালয়। কী কারণে পিনাকী ঠাকুরের এই ভাগ্য-বিপর্যয় এই নিয়ে আগে পরে বাংলা কবিতার জগতে অনেক আলোচনা হয়েছে, তাই সেসব কথা থাক। যে সময়ের কথা লিখছি, তখনও পিনাকী ঠাকুর আনন্দ পুরস্কার পাননি। নবপর্যায় ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার সহোযোগি সম্পাদক হিসাবে কাজ করছেন। যেটাকা বেতন পান; সামান্য হলেও তা দিয়েই সংসার চলে। দপ্তরে যে ঘোরানো চেয়ারে বসে আছেন পিনাকী ঠাকুর, সেটাও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বাড়ি থেকে পাঠিয়েছেন। একজন কবি-সাহিত্যিক-সম্পাদককে ছাপিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এইরূপটিও প্রবল আকর্ষক। কবি হবেন স্পর্শকাতর। যদিও সুনীলদার এসব ব্যাপারে খুব একটা বিশ্বাস ছিল না, তবুও শ্রীশ্রী ঠাকুরের একটি ঘটনার কথা লিখি- ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ একদিন গঙ্গার ঘাটে বসে আছেন, পাশে হৃদয়।
হঠাৎ ঠাকুর বলে উঠলেন -উঃ! জ্বলে গেল। বিস্মিত হৃদয়, বলল-কী হল আবার?
ঠাকুর বললেন-মাঝনদীতে মাঝিকে মনে হয় কেউ চড় মারল। শ্রীরামকৃষ্ণ মহামানব ছিলেন। তাঁর স্পর্শকাতরতার মাত্রা- কাতরতা তাই ওইরূপ ছিল। আগে স্পর্শকাতরতা-সংবেদনশীলতা-মানবিক হতে হবে, তারপর তো কবিতা; এইভাবনায় আজীবন জারিত ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। নবপর্যায় ‘কৃত্তিবাস’ দিয়ে লেখাটি শুরু করেছিলাম, আবারও সেই পর্যায় এরই একটি কথা বলি। একদিন সকালে হঠাৎ ধনঞ্জয়দার ফোন, ধপঞ্জয়দাও সাহিত্য জগতে বিশেষত একটূ পুরনো মানুষদের কাছে পরিচিত, বিশেষত বই পাড়ায়। অনেক কমবয়সে মেদিনীপুর থেকে ধনঞ্জয় বাবু কলকাতায় সুনীলদার বাড়িতে আসেন দেখাশোনার কাজের জন্য। সুনীলদার কাছে থাকাকালীন ধনঞ্জয়দার বিয়ে-সংসার, কসবায় বাড়ি সবকিছু। সুনীলদার বাড়ির পাশাপাশি ‘কৃত্তিবাস’ দপ্তরের কাজও সামলাতেন ধনঞ্জয়দা। ফোনে ধনঞ্জয়দা বললেন- পিনাকীদার বাড়িতে কি ফ্রিজ আছে? আমি বললাম-না। কেনো বলুন
তো? ধনঞ্জয়দা বললেন-দাদাবাবু(সুনীলদাকে ওই নামেই ডাকতেন) কালরাতে স্বপ্ন দেখেছেন- পিনাকীদাকে ফ্রিজ দিচ্ছেন। তারপর পিনাকীদার বাড়িতে গিয়ে ফ্রিজ কেনা হল। শান্তিনিকেতন থেকে ফেরার সময় সুনীলদা ও স্বাতীদি এলেন পিনাকীদার বাড়ি। সে এক দারুণ হইচই ব্যাপার। তখন ব্যাপারটা এতো তলিয়ে ভাবিনি কিন্তু এখন চিন্তা করি; পিনাকীদাকে একটি ফ্রিজ কিনে দেবার ইচ্ছা হয়েছিল তাঁর। পিনাকী ঠাকুর যাতে এই দেওয়াতে অসন্মান বোধ না করেন। কেউ যাতে কুকথা না বলতে পারে, তাই হয়তো এইরকম করেছিলেন সুনীলদা। আমার ভাবনা হয়তো ভুল হতে পারে। তবে এখন আমরা যে সময়ে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে একজন আর একজনকে কীভাবে টপকে যাবে ভাবেন, তরুণদের প্রতি এতো সহানুভূতি নিয়ে সত্যিকারের আপনজনের মতো পাশে দাঁড়াবার মানুষ কই? একসময় এক সাক্ষাৎকারে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করা হয়েছিল- আপনি নাকি স্বজন-পোষণ করেন? সহাস্য সুনীলের উত্তর ছিল- তাহলে কি দুর্জন পোষণ করা উচিত? ওঁর বাড়ির বিখ্যাত রবিবারের আড্ডার কথা এখন সর্বজনবিদিত। ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার নবপর্যায়ের কবি-লেখকরা তো বটেই বহু প্রখ্যাত মানুষ সামিল হতেন সেই প্রাণবন্ত আড্ডায়। কাউকে যেমন তুমি ছাড়া কথা বলতেন না, তেমনই কারও নামে কোনো সমালোচনা পছন্দ করতেন না কবি। সাহিত্য-সংগীত-কবিতা নিয়ে র্নিভেজাল আড্ডা চলত। সাহিত্য অকাদেমির সভাপতি, আনন্দবাজারের মতো পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সর্বোপরি কৃত্তিবাস সামলেও সবার কথা মন দিয়ে শুনতেন। কেউ কোনও সমস্যায় পড়লে নিজের সবটুকু দিয়ে সাহায্যের চেষ্টা করতেন। স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় ও পরম মমতাময়ী, আমরা তখন বেশকিছু ছেলেমেয়ে নদীয়া জেলায় গঙ্গা ভাঙনে যারা করুণ অবস্থার মধ্যে আছেন কিংবা যাদের পোশাক-পরিচ্ছদের অভাব আছে, তাদের প্রয়োজন মতো পোশাক পৌঁছে দেবার চেষ্টা করতাম। কলকাতা শহরে আমাদের মূল ডেরা ছিল ‘পারিজাত’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ন’তলার ফ্ল্যাট। এরকম হয়েছে যে ভননি দুপুরবেলা আমরা তিন-চারজন মিলে ‘পারিজাত’ গেছি, খেয়েছি। তখন হয়তো দাদা কোনও গুরুত্বপূর্ণ লেখা লিখছেন ওঁর ঘরে কিন্তু কখনও কোনো বিরক্তি দেখিনি ওঁর মধ্যে বরং আমাদের উৎসাহ দিতেন। এসব কথা এর আগে কখনও কোথাও লিখিনি, কারণ
ওঁরা পছন্দ করতেন না যে, এইসব কথা প্রচারিত হোক। তবে এখন মনে হচ্ছে লেখা দরকার। যদি একজনও এই লেখা পড়েন, এই প্রচার সর্বস্ব যুগে; যেখানে কেউ যদি কাউকে একটি পাঁউরুটিও দেন তার ত্রিশটি ছবি দেন। সেখানে এটি রূপকথার মতো শোনাবে। পুজোর সময় আমাদের বেশকিছু টাকা দিলেন সুনীলদা,স্বাতীদি আমাদের কসবায় নিয়ে গেলেন অনেক জামাকাপড় কেনা হল কল্যাণী ব্লাইন্ড স্কুলের জন্য। এসব চলতেই থাকতো। কত যে সামাজিক সংগঠনকে নীরবে সহয়তা করতেন,তা অনেক পরে-পরে জানা যায়। যখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পার্থিব শরীর শায়িত ছিল রবীন্দ্রসদনে সেই জনসমাগম; যাঁদের মধ্যে এমন মানুষও ছিলেন, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলেও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের দ্বারা উপকৃত হয়েছেন। তাঁদের চোখের জল,সেদিন সত্যকে সামনে নিয়ে এসেছিল। প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষদের পাশে দাঁড়াবার জন্য জগন্নাথ লালাকে নিয়ে বনগাঁতে তৈরি করেছিলেন ‘পথের পাঁচালি’। বনগাঁ শহর থেকে সুটিয়ার বর্ডার পর্যন্ত গ্রামগুলিতে পানীয় জলের ব্যবস্থা, স্যানিটেশন; বিশেষত মহিলাদের স্বনির্ভর করার মহান কর্মসূচি নিয়ে কাজ করতো ‘পথের পাঁচালি’। পাশাপাশি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ভেবেছিলেন যে, সেরকম বাধ্যবাধকতা কিছু নেই; কোনও কবি বা লেখক ওখানে গেলেন, থাকলেন-খেলেন-ঘুরে বেড়ালেন নিজের খেয়ালখুশি মতো, কিছু লিখলেন ইচ্ছে হলে। সমস্ত ব্যয়ভার ‘পথের পাঁচালি’ মানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বহন করবেন। আমাদের দুর্ভাগ্য সেই প্রতিষ্টানকে আমরা টিকিয়ে রাখতে পারিনি। অনেকটা আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাইর্টাস ওয়ার্কশপ ধাঁচের এইভাবনা এখন আর গোটা দেশে কোথাও নেই। রবিবারের আড্ডায় কত প্রসঙ্গ যে উঠতো দেশ-বিদেশের, মনে আছে সুনীলদা কথা প্রসঙ্গে একদিন বললেন-‘ জ্যাক ক্যারুয়াক আমাকে বলেছিলেন; উপন্যাস লেখা খুব সহজ জানো সুনীল। ধরো তুমি বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আছো, বাসে উঠলে ব্যাস; উপন্যাস শুরু। আমেরিকা থেকে কয়েকজন সাহেব এসেছেন বিট জেনারেশন নিয়ে ওঁরা একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করছেন।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বইয়ের সংখ্যা সাড়ে তিনশো, শুনে বিস্মিত হয়ে ওঁরা জানতে চায়লেন-‘ কীভাবে সম্ভব? লিখলেন কখন?’ সহাস্য সুনীল উত্তর দিলেন- ‘তাও তো সন্ধেবেলাটা লিখিনি’। এ প্রশ্ন আমাদেরও। এত দায়িত্বপূর্ণ পদ। তার দায়িত্ব। কোনও অবহেলা নেই। কৃত্তিবাস পত্রিকায় এমন একটি লাইনও প্রকাশিত হতো না, যা
সম্পাদক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় দেখেননি। একটু আত্মপ্রচার হয়ে যায় যদিও, তবুও সত্যের খাতিরে লিখি, নব পর্যায় কৃত্তিবাস পত্রিকায় আমিই বোধহয় সবথেকে বেশি গদ্য লিখেছি। তার কারণও অবশ্য ছিল। তখন প্রতিমাসের শেষ শনিবার রওডন স্ট্রিটের ‘শুভম’ নামে যে বাড়িটি আছে সেখানে কৃত্তিবাসের আড্ডা বসতো। দুজন করে কবিতাপাঠ করতেন, একজন গান। নতুন পুরনো মিলে প্রায় সকল কৃত্তিবাসী এই আড্ডাতে উপস্থিত হতেন। কবিতা নিয়ে মুক্ত মনে আলোচনাও চলতো। দিব্যেন্দু পালিত-কল্যাণী পালিত, শরৎকুমার-বিজয়া মুখোপাধ্যায়, নবনীতা দেবসেন, কখনও আবার ঐতিহাসিক রণজিৎ গুহ উপস্থিত হতেন। বেশিরভাগ সময় তরুণ ও তরুণতর কবিরা কবিতা পরতেন। আমার দায়িত্ব ছিল পুরো অনুষ্ঠানটি লিপিবদ্ধ করার, যা কৃত্তিবাস সংবাদ শিরোনাম দিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। একসময় ঠিক করলাম দেশের বাড়িতে আর দিনগুজারন যখন হচ্ছে না, কলকাতা চলে যাই। আমার এক নিকট দাদা ও প্রখ্যাত কবি একটি পাক্ষিক পত্রিকায় কাজ জুটিয়ে দিলেন। বেতন সামান্যই। চাকরি তো জোগাড় হল; কিন্তু থাকব কোথায়। আমার এক বন্ধুর বাবা কাশিয়াবাগান বস্তিতে রাস্তার ধারে একটি খাটিয়া ভাড়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। সারাদিন অফিসে থাকি। সঙ্গে পীঠব্যাগে সমস্ত নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস থাকে। রাতে খাটিয়া। মনে পড়ছে খুব সকালে কোনও একটি কাজে সুনীলদার কাছে গেছি- উনি জানতে চাইলেন এত সকালে শান্তিপুর থেকে এলে? আমি খাটিয়া বৃতান্ত জানালাম সুনীলদা ও স্বাতীদিকে। স্বাতীদি আমাদের প্রত্যেকের কাছে সাক্ষাৎ মাতৃমূর্তি। দুজনেই বললেন- তোকে আর ওখানে থাকতে হবে না। আমাদের চারতলার ফ্ল্যাটটা ফাঁকা আছে। তুমি এসে থাকো। বেশকিছুদিন থেকে ছি, খেয়েছি সেখানে। আমার মতো অকিঞ্চিৎকর ছেলেকে নিজেদের কাছে আশ্রয় দিয়ে, খাদ্য দিয়ে সেদিন রক্ষা করেছিলেন ওঁরা। সেইসব কথা লিখতে গিয়ে এখনো জলে ভরে আসছে চোখ। কবি তো অনেক হয়, এতবড় হৃদয় হয় কজনের?