মাগরিবের ছায়া

(১)


মাগরিবের ছায়া তখন সবেমাত্র ঘর পাততে শুরু করেছে গাঙের পানিতে।ঘরে ফিরে একটু শুয়েছিল ভারতী।কখন যে চোখ লেগে গিয়েছিল, নিজেই ঠিক মতো ঠাওর করে উঠতে পারে নি। সুবে সাদিকে মোয়াজ্জিনের আজানের আগে বিছানা ছাড়ে ভারতী।আশুবাবুর লাইনে প্রাতঃকৃত্য সারবার কোনো ব্যবস্থা নেই।এই কাজে সবথেকে সুবিধে জনক জায়গা হলো জুট মিলের বারোয়ারী পায়খানা।তবে সেখানে একটা চটের আড়ালের জেনানাখানা আছে তাই রক্ষে।তবে বাপের বাড়িতে থাকতে তারামনবানু কে যাতে মাঠেঘাটে যেতে না হয়, তারজন্যে তারামনের বাপ একটা খাটা পায়খানা করেছিল।বাড়ির পুরুষেরা যেতো মাঠেই।কিন্তু আওরতলোকের আর বাইরে যেতে হতো না।
             বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে ভারতী দেখলো রহিমার গায়ে শততালির খিলকাপানা কাঁথাটা র অর্ধেকটা কাঠের পাটাতন দাঁড় করানো ইটের সারির উপর থুপ হয়ে পড়ে আছে। প্রথমটায় একটু রাগ ই মেয়ের উপর তারামণের।রাগত স্বরেই বিড় বিড় করে বলে উঠলো সে, এই ছেঁড়া কাথার কানি যে কি করে জোগার করতে হয় তা আর জানবে কি করে লবাবের বেটি?
        গজগজ করলেও ইটের পাজা থেকে ছেঁড়া কাথাটা তুলে মেয়ের শরীরে যেন মায়ের ওম ই ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো ভারতী।বাপের বাড়ি ছেরামপুরে থাকতে তাও তালেব বে টুকুন শিখেছিলো রোহিমা। এই ভাটপাড়া শহরে একদিকে বামনাইয়া আর আরেকদিকে চটকলের বিহারী শ্রমিক মহল্লায় ভোলা মিঞার মেয়ে শিউপ্রসাদ মাস্টারের ইস্কুলে যাবে-- এটা ভাবতে পারা যায়?
                 নদিয়া জুট মিলের লেবার বস্তির আশে পাশে যতো বিহারী অ্যান্ডা গান্ডা রয়েছে, একটু হাঁটতে চলতে পারার পর থেকেই সেগুলো শিউপ্রসাদের জে এন বিদ্যালয়ে যায়। ভোলা মিঞা বেঁচে থাকতেই বাপের কাছে এলে তার ছেলে হাফিজ আর মেয়ে রোহিমা একটা ছোট চটের থলেতে করে আমপারার ছোট একটা সবুজ মলাটের বই আর বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় নিয়ে হাজির হতো শিউপ্রসাদের ইস্কুলে।
              চূড়নের মেয়ে সরস্বতীর খাটাল পেরিয়ে যেতে হয় জে এন বিদ্যালয়ে।সরস্বতীর মেজ মেয়ে লিলুয়া খুব খাটে গোরুগুলোর পিছনে। গতবছর নবম সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর একলেমশিয়া কাটাতে যমে মানুষে দশা হয়েছিল চূড়নের মেয়ে সরস্বতী, এই পাড়ার উচ্চারণ বৈশিষ্ট্যে সুরসতিয়ার।
               শিউপ্রসাদের ইস্কুলের সামনে একটা খাটিয়ায় বসে কুমোর বাড়ির প্রশান্ত মাস্টার আর তার দূর সম্পর্কের আত্মীয় গঙ্গাপদ পাল।সুরসতিয়ার খাটালের দুধ পয়সা দিয়ে কেনে প্রশান্ত মাস্টার।আর বুকনি দিয়ে নিয়ে যায় গঙ্গাপদ পাল।
               এককালে গবুগুন্ডার এক নম্বর শাগরেদ ছিল গঙ্গাপদ। '৭২ সালের ভোটে জিতে গবুগুন্ডা এখন ত্রিলোকেশ ভট্টাচার্য, মাননীয় বিধায়ক।আর এই ত্রিলোকেশ ই জমি জমা গুলো সব ভকুপিসীর দয়ায় তোলবার জন্যে গঙ্গাপদ কে জুতেছিল বি এল আর ও অপিসের সঙ্গে।আর যায় কোথায়? একদিকে গবুগুন্ডা আর একদিকে আমাদের কোচবিহারী বোলচালের বিটিছাওয়া এম এল এ নীরাপদ মাস্টার।
                      এইসবের দৌলতেই গঙঙইয়াদার জন্যে চূড়নের এতো মায়া।নাতনী লিলুয়া গোরুর জাবনা দেওয়ার ম্যাছলা বইতে বইতে কোমর বেঁকিয়ে ফেললেও গঙঙইয়াদাকে বিনি পয়সায় দুধ খাওয়াতে চূড়ন আর সোরসোতিয়া কারো র ই গরজ কারো থেকে কম নয়।গঙ্গাপদ ফাল বলেছে কি না বি এল আর ও থেকে এই খাটালের জমির আসল পড়চা সুরসতী সাউয়ের নামে নিকলিয়ে দেবে। তারপর দলিল? সে তো বৈকুন্ঠবাবুর কাজ।আর দলিল একবার হয়ে গেলে মুসবালতির ব্যাপার? আরে মুসবালটি তে তো সুরসতিয়ার দামাদ ই নিজে কাজ করে।
                          আশুবাবুর লাইন থেকে বেরিয়েই চরণ ঘোড়িওয়ালার ভাঙা বাড়িটা প্রথমেই চোখে পড়ে ভারতীর। ঘরের টুকটাক কাজ সেরে নদিয়া মিলের কুলি লাইনের দিকে পা বাড়াতেই আসমানের ফরসা হয়ে আসার আভাস টের পায় ভারতী।ফজরের আজানের সুর মিলিয়ে গেলেও জুট মিলের শিব মন্দিরের মাইকে তখনো ' জয় জগদীশ হরে' বেজে যাচ্ছে।
           চরণঘড়িওয়ালার বাড়ির দিকে চোখ যেতেই চমকে উঠে তারামণ বিড়বিড় করতে লাগলো;
বিসমিল্লাহির রাহমানির রহিম
আল্লাহুস সামাদ/ লাম ইয়ালিদ অলাম ইউলাদ.....
ক্কুল হুয়ায়াল্লাহু আহাদ
লাম ইয়ালিদ ওয়ালাম ইউলাদ
ওয়ালাম ইয়াকুললাহু কুফুওয়ান আহাদ।
              বার বার সুরা ইখলাস পড়েও যেন ভয় কাটছে না তারামণের।সামনের ঘরটাতেই ফ্যানের সঙ্গে একটা বড়ো চাদর জড়িয়ে ঝুলছে চরণ।চাঁদসির ডাক্তারের ডিসপেনসারির পাশেই তো ঘড়ির দোকান ছিল চরণের।কাজের বাড়ি যাতায়াতের পথে তারামণ দেখতো একটা ছোট্ট লাল আলোর নীচে একটা চোখে ঠুলির মতো একটা কি এঁটে ঘড়ি সারিয়ে চলেছে চরণ।রাস্তা দিয়ে কে যাচ্ছে, কে আসছে- কোনো দিকে নজর নেই।লক্ষ্য কেবল ঘড়ির কলকব্জার দিকে।
                          তারামণের পা যেন আর এগোচ্ছে না।সুরা ইখলাস আদায় করবার পরেও কেমন যেন মাটিতে পুঁতে গিয়েছে ভারতীর পা। একটু শক্তি সঞ্চয় করে নফল মালাত দুই রাকাত আদায় করলো সে মনে মনেই।তারামণের অজান্তেই তার মুখটা ছিল পশ্চিমে প্রশারিত।তাই তার পরেও ভয় কাটাতে সুরা ফালাক আদায় করেও ভারতীর পা নড়লো না একফালং ও। আয়াত পড়তে পড়তেই তারামণ দেখছে যে , সামনেই দড়িতে ঝোলানো লাশটা কেবল বেপরোয়া হাওয়ার দৌলতে দুলেই চলেছে, চলছেই দুলে।
                      চারণের আত্মহত্যার দুঃসহতা কি মফস্বল লাগোয়া গাঁয়ের মেয়ে তারামণের কাছে নোতুন কিছু? তারার গাঁ ছেরামপুরের বড়বটতলায় বটের শক্ত ঝুড়ির সঙ্গে বেঁধে আত্মহত্যার ঘটনা তো ছোটবেলায় আকছাড় দেখেছে সে। সকালে ঘুম থেকে উঠে মাঠ সারতে গিয়ে মাঠসঙ্গীদের কাছে খবর পেয়ে দৌড়তে দৌড়তে বড়বটতলার কাছে কতো গেছে তারা বন্ধুদের সঙ্গে।গাঁয়ের লোক জড়ো হয়ে পুলিশ আসা ইস্কক দাঁড়িয়ে দেখেছে।নানা মুনির নানা মত শুনেছে।কখনো কখনো লাশ নামানো পর্যন্ত থেকেছে। আবার একটু টেটিয়া পুলিশ হলে বাচ্চাদের হটিয়ে দিয়েছে।তখন হয়েছে বাড়ি ফিরে আসতে।
                      কই তখন তো দোয়া দরুদ পড়বার কথা একবারের জন্যে ও তারামনের মনে হয় নি? তখন ছোট ছিল বলে কি ভুত প্রেত জিন পরী ইবলিশের ভয় ছিল না তার? দাদী আম্মা তো কতো বারণ করতো; সাঁঝ বেলা বড়ো বটের নীচ দিই যাস নিকো রে ছেমড়ি।
দাদী আম্মার নিষেধের থেকে তখন অনেক বেশি করে মনে হতো , বড় বটকেই তৌষণদের বাড়িতে বুড়ো বট বলে কেন?
                   তৌষণের আম্মু ছিল তারামণের বাপের ফুফাতো বোন।তাই সে বাড়িতে ছিল তারামণের অবাধ গতি ।বয়সে একটু বড়ো তৌষণের খবরদারি সামলেই চাচীআম্মার পুকুরে সাঁতার কাটা, মাছ ধরা, চালতে পাড়া-- বড়ো বটের নিবিড় সান্নিধ্যে তো আস্টেপিস্টে বাঁধা ছিল তারামনের শৈশব থেকে প্রথম কৈশোরের দিনগুলি।সেই এককালের ডাকসাইটে পাড়া জ্বালানো তারামন, আজ ভোলা মিঞার এন্তেকালের পর ভাটপাড়ার এককালে মেড়ো এখন বাঙালি শিরোমণি হয়ে ওঠা বামুনঠাকুর দের বাড়ি র বাসনমাজার ঝি ভারতী , কেন হঠাৎ এতো ভয় পেল চারণের আত্মহত্যার ঘটনায়?
                     মফস্বলী শহর ভাটপাড়ার ঠিক গা ঘেসে শ্রীরামপুর গ্রাম টি নয়।শহরের দিকে ঝুকতে থাকা আধা শহর রথতলা, খুবলাল সাউয়ের বাজার, কাটাডাঙা , হরিচরণ তরফদার ইস্কুল লাগোয়া এলাকা, এমন কি কাঠপোলের পূব পাড়ের আমবাগান, সমরেশ বসুর শ্বশুরবাড়ির পাড়া-- এইসব জায়গাগুলোর তখন ' ভাটপাড়া' শহরের ভিতর গা এলিয়ে দেওয়ার ভয়ানক তাড়া।ওইসব জায়গাগুলো তখন আর পঞ্চায়েতের ভিতরে থাকতে চায়, মিউনিসিপ্যালিটির এলাকার ভিতরে ঢুকে পড়ে 'বাঙাল' নাম ঘোচাতে চায়।অতো দূর দূর থেকে ' ঘটি কুলোশিরোমণি' আমাদের ' মাল ঠাকুর' আর তাদের নাতিপুতিদের তখনো কৌতুকে করুণাতে এইসব এলাকার মানুষজনেরা দেখে।তবে সেই দেখার ভিতর দিয়ে তাদের শেখার সুযোগ তখনো পায় নি এইসব বাঙালদের পোলাপানেরা।তাই ভাটপাড়ার একদা মেড়ো, হালের বশিষ্ঠ গোত্রের হাড়ের ফুটো গরবে ফেটে পড়া শ্রীধর ঠাকুর, মন্মথ ঠাকুর, জীবক ঠাকুরেরা ' মাল ঠাকুরে' র মুখোশের আড়ালে তখনো এইসব না শহর , না গাঁ এলাকার মানুষদের কাছে ' ভগবানে' র ডাইরেক্ট এজেন্ট বলেই কলাটা , মুলোটা পেয়ে থাকে।( ক্রমশঃ)

  • গৌতম রায়