তালের বড়া

তাল ঘিরে বে-তাল, তা সে তালে থাকুক বা না থাকুক, বাঙালির জীবনে কখন ও না কখন ও ঘটে যাওয়া বা আগামীতে ঘটতে যাওয়া একটা জব্বর ঘটনা--
 
 
গরমকাল মানেই আম, কাঁঠাল, জাম, তালের মাস।জামরুলের জোলো স্বাদ আর জামের কষ্টে স্বাদ মিলে মিশে মুখ রঙিন হয়ে যাওয়ার সেকালে এসব মরশুমি ফলের সঙ্গে ঠাকুর - দেবতার সম্পর্ক ঘিরে আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে , ছোট- বড় , কারোর কি তেমন একটা মাথা ব্যথা ছিল না।তখন সেকেলে একান্নবর্তী পরিবার রমরমিয়ে না থালেও একেবারে একেবারে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির যুগ তখন ও শুরু হয় নি।বাড়িতে বাবা, কাকা , জ্যাঠা , কাকী, জ্যেঠিরা ছিলেন।ঠাকুর্দা- ঠাকুমাদের শীতল ছায়া ছিল।মাসীর বাড়ি, পিসীর বাড়ি, মামার বাড়ি যাতায়াত - এগুলো ছিল সব স্বাভাবিক ব্যাপার।
সময়ের ,ঋতুর অনেক বৈশিষ্ট্য আমরা আমাদের রোজকার দিনযাপনের সঙ্গে তখন আপন করে নিতাম। সেসব আপন করবার ভঙ্গিমার সঙ্গে লোকধর্মের একটা যোগাযোগ অনেক সময়েই ছিল।যেমন , কাসুন্দি তৈরির ব্যাপার টা বাঙালদের মধ্যেই বেশি প্রচলিত ছিল।ঘঁটিরা এই কাসুন্দি তৈরিতে খুব একটা থাকতেন না।কিন্তু ঘঁটি- বাঙাল নির্বিশেষে কাসুন্দি ছিল সকলের প্রিয়।তখন হোটেল, রেস্টুরেন্ট - এসবের চল মধ্যবিত্ত বাঙালির মধ্যে ছিল নাই বলাযেতে পারে।বাঙালি তখন কাসুন্দি খেতে নালচে শাকের সঙ্গে।খেত সেদ্দ, পোড়া, মাখা-- হরেক কিসিমের বাঙালি হেঁসেলের ঠাকুমা- দিদিমা, দাদা- পরদাদার আমলের আদবকায়দায় আবিস্কৃত রান্না বান্নার সঙ্গে।কাসুন্দিকে তখন ' মাস্টার্ড' বলা আম বাঙালি শেখে নি।
কাসুন্দি তৈরির তরিপদে অনেক ব্যাপার ছিল।কিন্তু ছিল না কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের অনুসঙ্গ।বেশ কিছু আদবকায়দা ছিল।ছিল জেলা বিশেষে নিয়মের রকমের ।তাতে স্বাদের ও বেশ কিছুটা হেরফের হতো।কিন্তু সব মিলিয়ে যেটা ছিল, সেটা হল; পরিচ্ছন্নতা ঘিরে অত্যন্ত সজাগ নজরদারি। সেকালে খাবার সংরক্ষণে প্রিজার্ভেঠিভ থাকলেও বাঙালি ঘরের মা, খালাম্মাদের মধ্যে কোনো বাইরের রাসায়নিক দিয়ে খাবার অনেকদিন ভালো রাখার রেওয়াজ ছিল না।খাবার ভালো রাখবার ক্ষেত্রে আচার, বড়ি, কাসুন্দি-- সব কিছুই তাঁরা নিয়মিত রোদে দিতেন।
সেই রোদে দেওয়ার রেওয়াজটাও ছিল অন্যরকমের।কাঁচের বয়ামে বা মাটির পাত্রে সেকালে থাকত এইসব জিনিষপত্র।ধোয়া পুরনো কাপড় দিয়ে সেসব পাত্রের মুখ এঁটে সেগুলো রোদে দেওয়া হতো।
বাড়ির দামাল ছেলেরা ছাদে গিয়ে চুপি চুপি সেসব একটু আধটু চুরি যে করতো না কখনো- এমনটা ভাববার কোনো কারন নেই।চুরি করে ধরাও পড়তো বেশির ভাগ সময়েই।কারন, হয় আচারের তেল বা রস কোনো না কোনো কিছু দিয়ে চুরির চিহ্ন রেখে যেতো অপেশাদার চোর!
সেসব বয়াম কিন্তু বাতিল হয়ে যেত।বের করে দেওয়া হতো খেয়ে ফেলবার জন্যে।সারা বছরের সংরক্ষণের কুলুঙ্গিতে সেসব আচারের ডিবের ঠাঁই হতো না আর।
কেন হতো না? 
ভাবতাম তখন খুব।এঁটো বা সগরির যে কনসেপশানের ভিতরে আজ থেকে পঞ্চাশ,ষাট বছর আগে আমরা বড় হয়েছি, তাঁদের কাছে এই এঁটো ব্যপারটাই ছিল বাড়ির বেপরোয়া ছেলেদের আঁচার চুরির জন্যে বা সুফলেও বলা যেতে পারে, আমাদের সময়ে- অসময়ে এই একটু বেশি বেশি করেই সেসব লোভনীয় খাবার খেতে পারার আসল কারন।
                           আসলে এঁটো এই ব্যাপার টাকে তখন নিছক শুচিবাই বলে মনে করতাম। কিন্তু কিছু খাবার থেকে এক খামচা তুলে নিয়ে, সেটা খাওয়া শেষ করে আবার আরেক খামচা তোলা-- এর সঙ্গে সেকেলে মানুষদের শুচিবায়ুগ্রস্থতার যতটা সম্পর্ক ই থাকুক না কেন, তর সঙ্গে যে হাইজিন আর ওই জিনিষটার ঠিক ঠাক মত করে প্রিজার্ভেশন , অর্থাৎ; সময় - অসময়ের জন্যে রেখে দেওয়ার যে ব্যাপার টা-- তার যে একটা অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক ছিল-- এটা বুঝে ওঠবার মত ক্ষমতা সে বয়সে হয় নি
ফলে বাড়ির ঠাকুমা, পিসীমাদের শুচিবাই ঘিরে খানিকটা অহেতুক রেগে যেতাম ।তবে মনে মনে অমন শুচিবাইয়ের দৌলতে অসময়ে , সময়ের থেকেও বেশি ওই লোভনীয় খাবার দাবাড় খেতে পেতাম-- এই ব্যাপারটাকেও ঠিক অস্বীকার করতে পারতাম না।করবো ই বা কি করে? জিভের নোলা তো আর এতটুকু কম ছিল না! 
দেখেছেন, কেমন ধান ভানতে শিবের গীত গাইতে শুরু করেছি? বলছিলাম তালের বড়ার কথা।আর কোথায় চলে এসেছি আঁচার, বড়ি, কাসুন্দিতে। বয়স হলে একটু বোধহয় বকবক করাটা অভ্যেসে পরিণত হয়।তাইই না? কারনে, অকারনে বকতেই থাকে বয়ষ্ক মানুষজনেরা। তাল তমালে বনরাজি লীলা-- সেসব প্রাচীন বাক্যি তে আমার বিদ্যের বহর তৈরি হয়েছে বঙ্কিমচন্দ্রের দৌলতে।কপালকুন্ডলার দৌলতে আমরা একটু আধটু পড়েছি মহাকবিসকালিদাস ঘিরে অ আ ক খ।মানে বুঝতেই পারছেন , পড়বার বহর টা অনেকটা সেই গোলপার্কে রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচারের স্কুল অব ল্যাঙ্গুয়েজের প্রি বিগিনার্স কোর্সের মত আর কী! প্রি বিগিনার্স পেরিয়ে যেমন অনেক মফসসলীর ই আর বিগিনার্সের সিঁড়িতে পৌঁছনো শেষ অবধি সম্ভবপর হয় না।ব্যাপার টা অনেকটা তেমন নয় তো?
একবার শান্তিনিকেতনে , অনেক অনেক বছর আগে সেবাপল্লী থেকে একটু ঝড়ো বিকেলে হাঁটা দিয়েছি ফর্টি ফাইভের দিকে।তখন ফর্টি ফাইভ বললেই সেই এলাকাকে একডাকে সেকালের মানুষ জনেরা চিনত। ফর্টি ফাইভের গালভরা নাম অ্যনড্রুজ পল্লী , পোষাকী ভাবে হয়েছে কি না মনে নেই।কিন্তু লোকের মুখে তখন ও ফর্টি ফাইভ ই।
সেই ফর্টি ফাইভে যে রামকিঙ্কর, আমাদের কিঙ্করদা থাকতেন, তা আজকে শুভ বসুর মত দু চারজন হাতে গোনা মানুষ ই মনে রেখেছেন।ফর্টি ফাইভ থেকেই যে শেষবার শ্মশানের উদ্দেশে কিঙ্করদার শরীর টা বেরিয়েছিল-- সে কথাই বা আজ আর কার মনে আছে? 
কিঙ্করদা কখনো তো অনুরাগী বাহিনী তৈরিতে এতটুকু সময় খরচ করেন নি।আলগা অনুরাগ, আলগা পীড়িত কেউ দেখাতে এলে প্রায় রে রে করে ছুটে যেতেন তিনি।নিজের প্রতিভা ঘিরে অর্থ উপার্জন- এটা বোধহয় স্বপ্নেও তিনি ভাবতে পারতেন না।তাই শঙ্খ চৌধুরীর প্রজন্ম প্রাকৃতিক নিয়মেই না থাকার ফলে প্রকাশ দাসের মত দুজন চারজন হাতে গোনা মানুষজন ছাড়া কিঙ্করদাকে বোধহয় তেমন ভাবে কারোর ই আর মনে রাখার দরকার নেই।তাই বাইরের পর্যটক সে পাড়ায় গেলে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রসাদ দেখে।যে প্রাসাদ থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে 'গোরা সর্বাধিকারী' নামক নামটিকে।দেখে প্রতীচীর নতুন বাড়ি।দেখে ,' পাঁচিল কাকু' র তোলা জেলখানার পাঁচিলে উঁকি দিয়ে একটু আধটু এসব নতুন তৈরি পাড়া দেখা যায় কি না।না ন- কেউ ই প্রায় নেই সে পাড়াতে , যাঁরা আজ বলতে পারে, শেষবার এই ফর্টি ফাইভে কোথায় শায়িত হয়েছিল রামকিঙ্করের মৃতদেহ।
সেবাপল্লী থেকে সেবার ফর্টি ফাইভের দিকে হাঁটা দেওয়ার পর , এখন যেখানে পৌষালী হোটেল, সবেমাত্র সেখানটায় পৌঁছেছি, মাষ্টরমশাইয়ের ( নন্দলাল বসু)বাড়ির একটু আগে।মুষলধারে বৃষ্টি নামলো।একটা মাটির বাড়ির সঙ্গে প্রায় সিঁটিয়ে থেকে বৃষ্টি বাঁচাতে লাগলাম। আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে, গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের এই ভ্রুকুটি তখনো দেখাই দেয় নি।সে বৃষ্টির তেজ এখন বড় একটা দেখাই যায় না।
অমন বৃষ্টির মধ্যে মাটির বাড়ির গায়ে গা লাগিয়ে জলের হাত থেকে মাথা বাঁচাবার ব্যর্থ চেষ্টার মাঝেই হঠাৎ সামনর তাল গাছ থেকে একটা পাকা তাল পঢ়লো ঢুপ করে।একটু , মানে এক দ বিগতের জন্যে বেঁচে গেল আমার মাথাটা।এক চুল এদিক ওদিক হলো তালে কিলোনো মাথাটা আমার যে কি অবস্থা প্রাপ্ত হতো, সেটা ভাবতে এই বুড়ো বয়সেও প্রায় ই শিউরে উঠি।আর মাথার সামনে অমন একটা পাকা তাল সজোরে ভুঁইতে পড়বার কারনেই বুঝি বা আমি জম্মের তালকানা! সোজা আর কখন  ও ই হয়ে উঠতে পারলাম এখন ও পর্যন্ত!

  • শ্যামলী ভট্টাচার্য