বাংলাদেশের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েরও মহান মুক্তিযুদ্ধে এক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। শুরুটা হয়েছিল একাত্তরের মার্চেই। একাত্তরের মার্চের উত্তাল দিনগুলোয় ঢাকার মতো চট্টগ্রামও ছিল উত্তাল। বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীর প্রথম বিদ্রোহ এবং প্রাথমিক প্রতিরোধযুদ্ধ চট্টগ্রাম প্রসঙ্গে সাইদ হাসান দারা তার অপারেশন সার্চলাইট গ্রন্থে লিখেছেন, “মার্চ মাসের ১ তারিখ থেকে ঢাকার মতো বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সর্বত্রই স্বাধীনতার দাবিতে ভয়ানক উত্তাল-সাগরের মতো ফুঁসে উঠেছিল। যেকোনো সময়ে, যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।” (সাইদ হাসান দারা, অপারেশন সার্চ লাইট, পৃ. ৫৫)চট্টগ্রাম শহর থেকে অনেক দুরে পাহাড়ি জনপদে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান হলেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ও ফুঁসে ওঠে। ছাত্র শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারী সকলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একাত্তরের মার্চের অসহযোগ আন্দোলনে সামিল হন। ৭ই মার্চের ভাষণের পর থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিরসাংগঠনিক তৎপরতা ছিলঅনেক বেশি । ওই সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নেতৃত্বে ছিলেন ড. শামসুল হক এবং ড. অনুপম সেন। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এই প্রত্যয়কে সাধারণ জনগণের কাছ পৌঁছে দেওয়ার প্রয়াসে, ব্যাখ্যা করার প্রয়াসে ১৭ই মার্চ থেকে লালদিঘীর ময়দানে সপ্তাহব্যাপী এক কর্মসূচি পালন করে। ড. অনুপম সেন উল্লেখ করেছেন, “ প্রায় প্রতিদিন সভা আরম্ভ হওয়ার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম শহরের মুখ্য সড়কগুলোতে ট্রাক র্যালি অনুষ্ঠিত হতো যেখানে অসহযোগের বাণী, স্বাধীনতার বাণী সংবলিত প্ল্যাকার্ড প্রদর্শিত ও দেশাত্মবোধক গান পরিবেশিত হতো। লালদিঘীর সভাতে বিকেল ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে বক্তৃতা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। যদিও লালদিঘীর এই সভাটি ছিল মুখ্যত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি পরিচালিত; এই কর্মকাণ্ডে চট্টগ্রামের তৎকালীন বিশিষ্টজনরা ও সংস্কৃতিকর্মীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিয়েছিলেন।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর ড. এ আর মল্লিক মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৭১ সালে, মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ৮ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. এ আর মল্লিকের সভাপতিত্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়েছিল। ড. আনিসুজ্জামান এর লেখা থেকে জানা যায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগের ক্লাসরুমে উপাচার্য এ আর মল্লিক সভাপতিত্ব করেন। অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, অধ্যাপক আবদুল করিম, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক ফজলী হোসেনসহ অনেকেই বক্তৃতা করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে শিক্ষকরা সরাসরি যুক্ত হলেন। নেতৃত্বে ছিলেন- অধ্যাপক ফজলী হোসেন ও মাহবুব তালুকদার। এছাড়াও অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, আনিসুজ্জামান (বাংলা), অধ্যাপক আবদুল করিম ও রফিউদ্দীন আহমদ, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম চৌধুরী, এখলাস উদ্দীন আহমদ, ড. এম বদরুদ্দোজা, রশিদ চৌধুরী, হুজ্জাতুল ইসলাম লতিফী প্রমুখ। কর্মকর্তাদের মধ্যে মোহাম্মদ খলিলুর রহমান, আবু হেনা মোহাম্মদ মহসীন, সুধীর রঞ্জন সেন প্রমুখ নেতৃত্বে এগিয়ে আসেন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক ও প্রতিরোধ পর্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষকরা তাদের প্রগতিশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে লড়াই সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন। বাংলাদেশের অন্যতম বরেণ্য শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক আবুল ফজলসহ চট্টগ্রামের সর্বস্তরের বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা মিলিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গঠন করেন ‘শিল্পী-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিসেবী প্রতিরোধ সংঘ’। ড. আনিসুজ্জামান তার আমার একাত্তর বইতে লিখেছেন, ‘৮ মার্চ ১৯৭১ বিশিষ্ট লেখক আবুল ফজলের বাসভবন সাহিত্য নিকেতনে একসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ‘শিল্পী সংস্কৃতিসেবী প্রতিরোধ সংঘ’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রাম কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ সভায় উপস্থিত ছিলেন ও বক্তব্য দেন। চাকসু জিএস আবদুর রব এ সংগঠনের পেছনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। সংগঠনটি আত্মপ্রকাশের পরপরইপাকিস্তানি অপশাসনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদী সংগীত ও নাটক পরিবেশন করে। মুক্তিসংগ্রামের উত্তাল দিনে সবার প্রিয় মমতাজ উদ্দীন স্যারের নাটক ছিল ছাত্র জনতার কাছে প্রেরণার উৎস।
উত্তাল মার্চের প্রাথমিক প্রতিরোধপর্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ড. এ আর মল্লিক প্রথম থেকেই ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন। তাঁর লেখা আমার জীবনকথা ও বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম বইতে তিনি সবিস্তারে উল্লেখ করেছেন। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ তারিখে তিনি চট্টগ্রাম শহরে ছাত্র শিক্ষক জনতার মিছিলে নেতৃত্ব দেন এবং সভাপতিত্ব করেন। ওই সভাতেই তিনি সদর্পে বলেছিলেন, ‘ আজ থেকে আমি আর উপাচার্য নই। দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত একজন মুক্তি সংগ্রামী হিসেবে আমি নিজেকে মনে করব।” উপাচার্য ড. এ আর মল্লিক এভাবেই নিজেকে প্রতিরোধযুদ্ধে শামিল করেছিলেন। যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে এক শক্ত অবস্থানে নিয়ে নেন। ড. আনিসুজ্জামানের লেখাতেও তাঁর প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হয়। ২৮ শে মার্চের দিকে উপাচার্য ড. এ আর মল্লিক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আশ্রয়গ্রহণকারী বাঙালি সৈনিক যারা চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট থেকে চলে এসেছিল তাঁদের খাবার দাবারের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ড. গোলাম কিবরিয়া ভূঁইয়া মুক্তিযুদ্ধ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন মার্চের শেষের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি তহবিলে টাকা ছিল না। এই অবস্থায় ড. মল্লিক নিজের গাড়ি বিক্রি করে ৬ হাজার টাকা পান এবং এই টাকা সাধারণ তহবিলে দিয়ে দেন। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম চৌধুরীও কিছু অর্থ প্রদান করেন। কিন্তু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস জনশূন্য হতে শুরু করে ২৯ মার্চের পর থেকে। এই সময়ের পর থেকে পাকিস্তানি সেনারা শহরের বিভিন্ন জায়গা দখল করে ফেলে। পাকিস্তানি সেনাদের ভারি অস্ত্রের কাছে বাঙালিরা প্রাথমিক পর্যায়ে টিকে থাকতে পারে নি। তারপরেও চট্টগ্রাম শহরের নানা জায়গায় খণ্ড যুদ্ধ হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও পাকিস্তানি সেনারা প্রবেশ করে এবং কনসেনট্রেশান ক্যাম্প বানিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দখল করে রাখে।
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী শিক্ষকরা উপাচার্য ড. এ আর মল্লিক, ড. আনিসুজ্জামানের নেতৃত্বে রামগড় হয়ে ভারতে চলে যান। ১৯৭১ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ২০ জন শিক্ষক ভারতে আশ্রয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এসব শিক্ষকের অনেকেই এপ্রিল থেকে মে মাসের মধ্যে কলকাতায় পৌঁছে গিয়েছিলেন এবং মুজিবনগর সরকারকে তাঁরা নানাভাবে সহযোগিতা করেন।
দীর্ঘ নয় মাস ব্যাপী আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ১৬ জন শহীদ হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরের চেইনম্যান বীরপ্রতীক মোহাম্মদ হোসেন, দর্শন বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক অবনী মোহন দত্ত, চাকসুর সাধারণ সম্পাদক ইতিহাস বিভাগের ছাত্র আবদুর রব, উপ-সহকারী প্রকৌশলী প্রভাস কুমার বড়ুয়া, বাংলা বিভাগের ছাত্র মনিরুল ইসলাম খোকা, মোহাম্মদ হোসেন ও মোস্তফা কামাল, অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র নাজিম উদ্দিন খান ও আবদুল মান্নান, ইতিহাস বিভাগের ছাত্র ফরহাদ উদ-দৌলা, বাণিজ্য অনুষদের ছাত্র খন্দকার এহসানুল হক আনসারি, ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আশুতোষ চক্রবর্তী, সমাজতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র ইফতেখার উদ্দিন মাহমুদ, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আবুল মনসুর, গণিত বিভাগের ছাত্র ভুবন এবং আলাওল হলের প্রহরী ছৈয়দ আহমদ এদের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এই আত্মত্যাগ স্মরণীয় করে রাখার প্রয়াসে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও শহীদের স্মৃতি রক্ষার লক্ষ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দুটি স্মৃতিস্তম্ভ ও একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। তৎকালীন চাকসুর সাধারণ সম্পাদক ইতিহাস বিভাগের ছাত্র শহীদ আবদুর রব স্মরণে একটি ছাত্র হলের নামকরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক অবদান বিশাল ও অসীম গর্বের যা ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।