মাঝের একদিন বাদ দিয়ে দ্বিতীয় দিন মনোময়ের কাছে রত্নদীপের ফোন চলে এল সকাল সকালই। মনোময় অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। অচেনা নাম্বার বলে প্রথমে বুঝতে না পারলেও নাম বলায় চিনতে পারলেন। বললেন আধঘন্টা বাদে ফোন করবেন এই নাম্বারে। রত্নদীপ আপত্তি করল না।
প্রায় চল্লিশ মিনিট বাদে হাতের কাজ শেষ করে আর্দালিকে এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে আয়েশ করে রত্নদীপের নাম্বারে ফোন করলেন। নাম্বার সেভ করেই রেখেছিলেন। রত্নদীপ ফোন ধরেই বলল, ‘কী ঠিক করলেন, স্যার ?’
হাসিমুখে মনোময় বললেন, ‘তুমি খুব ভালো করেই জান যে আমি না করতে পারব না, রত্ন’।
উল্টোদিকে রত্নদীপের হাসির আওয়াজ শোনা গেল। বলল, ‘আপনার আপত্তি না থাকলে আমি কনফারেন্স কলে সর্দারকে ধরি ?’
মনোময় আপত্তি করলেন না। ফোনে প্রথমেই সর্দার প্রচণ্ড উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন। বললেন তিনি নাকি জানতেন যে সাহাসাহেব শেষ পর্যন্ত রাজি হবেন। এরপরেই বললেন, ‘রত্নদীপ আপনাকে পুঁথির বাকি অংশ আজকালের মধ্যেই দিয়ে আসবে। আপনি পড়ে নিবেন। পড়া হলে আপনার সাথে কিছু আলোচনা করব আমরা। বাই দ্য ওয়ে, সরাসরি একটা কথা বলেন, আপনি কত শেয়ার চান ?’
এমন সরাসরি প্রস্তাবে মনোময় সামান্য হকচকিয়েই গেলেন। তারপরে বললেন, ‘আপনি গুপ্তধনের শেয়ারের কথা বলছেন, মিঃ সাদ্দাম ?’
সর্দারের আসল নাম যে সাদ্দাম সেটা মনোময় জানতেন। মনোময় যে জানেন সেটাও সর্দার জানেন। এখন উত্তরে বললেন, ‘এক্সাক্টলি তাই’।
আপনি সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’ সিনেমাটি দেখেছেন ?’, মনোময় একটি অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসলেন ‘।
হুমম, মনে হয় দেখেছিলাম ‘। ক্যান ?’
আমার সেই সিনেমায় নকল ডঃ হাজরার ‘শেয়ার চাই, না চাই না ?’ সংলাপটি মনে পড়ে গেল’, মনোময় হেসে ফেললেন ‘।
কনটেক্সট আমি ধরতে পারি নাই ‘। এনিওয়ে, আমি আবার নকল টকল নই। এক্কেবারে সাচ্চা সর্দার’।
মনোময় সিরিয়াস হয়ে গিয়ে বললেন, ‘আপনি বোধহয় জানেন না আমাদের দপ্তরের অধীনে বেহালায় একটি মিউজিয়ম রয়েছে। গুপ্তধন পাওয়া গেলে সেটি গভর্নমেন্ট আর্কাইভে জমা পড়বে। কিছু অংশ থাকবে মিউজিয়মে’, মনোময় গুপ্তধনের শেয়ারের বিষয়ে সরাসরি উত্তর দিলেন না। তবে যা বোঝার বোঝা গেল।
‘অর্থাৎ আপনি কেবল কৌতুহলের বশে বা বলা ভালো নিজের মাথা খেলানোর জন্য আমার প্রস্তাবে রাজি হয়েছেন ?’, সর্দার প্রশ্নটা করলেও অবাক যে হননি বোঝা গেল।
‘সেরকমটাই ধরে নিন’, মনোময়ের কন্ঠে দৃঢ়তা।
‘সাহাসাহেব, আপনি শেয়ার নেবেন না সেটা পিওরলি আপনার ডিসিশন। তবে গুপ্তধনের ঠিকানা কোথায় হবে সেটা আমরা বুঝে নেব। আপনি আপনার কাজ শুরু করে দিন’।
‘আমার একটা প্রশ্ন আছে’, মনোময় কথা এগিয়ে নিতে চাইলেন।
‘বলেন’।
‘পুঁথিটি আড়াইশো বছর আগে লেখা। কবে লেখা হয়েছিল তার সাল নিশ্চয়ই রত্নদীপ ইতোমধ্যে আপনাকে বলেছে ?’
‘জ্বি, বলেছে’।
‘আড়াইশো বছর আগের লেখা ধরে আপনি গুপ্তধন পাওয়ার কথা ভাবছেন ?’
‘জ্বি, ভাবছি’।
‘রাজা প্রতাপাদিত্য মারা গিয়েছেন তারও দেড়শো বছর আগে। এই চারশো বছরে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। কত শাসকের পরিবর্তন হয়েছে। মোঘল গিয়েছে, বাংলার নবাব গিয়েছে, গিয়েছে ইংরেজ শাসনও। যদি গুপ্তধন কিছু থেকেও থাকত আজ সত্যিই কি সেসব অবশিষ্ট আছে ? আপনার কি সত্যিই মনে হয় গুপ্তধন পাওয়া যাবে ?’।
সর্দারের দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে মনোময় আবার বললেন, ‘আমরা না হয় মাথা ঘামিয়ে গুপ্তধনের ঠিকানা বের করলাম, কিন্তু দেখা গেল সেসব অনেক আগেই অন্য কেউ নিয়ে গিয়েছে। আমরা সেই জায়গায় গিয়ে দেখলাম সব ভোঁ ভাঁ। কিছুই আর পড়ে নেই। তাহলে ?’
‘গুপ্তধন আছে সাহেব’, এবার সর্দারের ছোট সাড়া পাওয়া গেল।
‘এই কনফিডেন্সটা আপনি কোথা থেকে পাচ্ছেন ?’
সামান্য থমকে থেকে সর্দার বললেন, ‘আপনারে বলা লাগে। আসলে আমাদের পরিচিত একজন প্রমোটার একটি পুরাতন বাড়ি ভাঙ্গতে গিয়ে কিছু ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে। বাড়ি ভাঙ্গার পরে ভিত খোঁড়ার সময়ে তার দুজন মাটি কাটার লোক উন্ডেড হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন মারা গিয়েছে’।
মনোময় দুঃখের স্বরে বললেন, ‘স্যাড। কিন্তু গুপ্তধনের সাথে কী সম্পর্ক এর ?’
‘যে মারা গিয়েছে তার প্যান্টের মধ্যে থাকা মানিব্যাগে দুটো কয়েন পাওয়া গিয়েছে, যাতে সুলতান দাউদের নাম লেখা আছে’।
‘দাউদ ? মানে, বাংলার যে আফগান সুলতানকে আকবরের নির্দেশে মানসিংহ হারিয়েছিল ?’, এবার মনোময় নড়ে চড়ে বসলেন।
‘হাঁ, সেই দাউদ, যার খাজানা নিয়ে এসেছিলেন রাজা প্রতাপের আব্বা আর চাচা যশোরে’।
মনোময়ের মনে সব সংশয় উধাও হয়ে গিয়েছে। উৎসাহের সাথে বললেন, ‘উন্ডেডদের মধ্যে যে বেঁচে রয়েছে সে কিছু বলছে না ?’
‘আলবৎ বলেছে। সেখানে একটা ছোট লোটায় নাকি এরকম কয়েক আরো কয়েকটা ছিল। কিন্তু সেই লোটাটি হারায়ে গেছে’।
‘হারিয়ে গিয়েছে ?’, মনোময় বেশ অবাক হলেন।
‘মানে অন্য কেউ সেটি হাপিশ করেছে। আমরা তাকে খুঁজছি’।
মনোময় কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘তাহলে তো ঝামেলা মিটেই গেল। যে লোকেশনে ঐ দাউদের মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে সেখানেই ছিল গুপ্তধন। আমাদের আর নতুন করে খোঁজার দরকারই নেই তাহলে’।
‘এমন আসান নয় ব্যাপারটা সাহাসাহেব’, সর্দার গম্ভীর হয়েই বললেন।
‘কেন ?’
‘প্রতাপের আব্বা নৌকা বোঝাই করে খাজানা এনেছিল। সেকি আর একটা লোটায় শেষ হয়ে যাবে ?’
‘আহা তা কেন, দীর্ঘ রাজ্যশাসনে খরচ হয়ে গেছিল’, মনোময় যুক্তি দিলেন।
‘না, সাহাসাহেব। খাজানা আরো আছে। নানা লোকের মধ্যে ছড়িয়ে গিয়েছে নানান স্থানে। আপনি খুঁজে বের করুন সেসব লোকেশন। আমি ফুল সাপোর্ট দেব পিছন থেকে। সামনে আসব না। কারণটা আপনি ভালোই জানেন’, বলেই সর্দার হা হা করে হেসে উঠলেন।
‘আচ্ছা বেশ। তাই হবে’, মনোময় রাজি হলেন।
‘আর একটা বাতচিৎ আছে। আপনি যে দৌড়ঝাঁপ করবেন তার তো কিছু খরচাপাতি আছে’।
‘আমি ভালোই বেতন পাই মিঃ সাদ্দাম’।
‘আহ্, আমার ও নামটা মুখেও নেবেন না কাইন্ডলি’।
‘সে না হয় হল। তবে আমাকে তো ঘুস দেওয়া যায় না, সর্দারজি’।
‘সর্দারজি’ বলতে ভারতে যে পাঞ্জাবীদের সম্বোধন করা হয় সেকথা বাংলাদেশে বড় হওয়া সর্দার জানেন কিনা মনোময় বুঝতে পারলেন না। তবে সম্বোধনটা নিজের কানেই কেমন যেন লাগল।
সর্দার আর কথা না বাড়িয়ে ‘বেস্ট উইশেস’ জানিয়ে ফোনলাইন কাটার পরে রত্নদীপ বিকেলের দিকে মনোময়ের অফিসে এসে পুঁথির বাকি অংশ দিয়ে যাবে বলল। রত্নদীপের ফোন শেষ হতেই মনোময় একটি নাম্বারে ফোন লাগালেন। নাম্বারটি গতকালই সজলের থেকে নিয়েছেন। আগে একবার কথাও বলে রেখেছেন।
***
ঘন্টা চারেক বাদে রত্নদীপ যখন চাঁদনি চকে মনোময়ের অফিসে এল তখন তার মুখচোখ শান্ত নয় একেবারেই। মনোময় বসতে বলার পরে কেবল ‘আপনি ঠিক করলেন না এটা’ বলে নিজের ফোনে কাউকে ধরে ফোনটা মনোময়ের হাতে দিতেই মনোময় উল্টোদিক থেকে গম্ভীর গলায় শুনতে পেলেন, ‘সর্দার বলছি’।
মনোময় কিছু বলে ওঠার আগেই সর্দার আবার বললেন, ‘আমাদের কিছু উসুল রয়েছে সাহাসাহেব। ইমানদারির সাথে ইমানদারি করি। আর বেইমানের সাথে...’।
সকালের ফোনের পরেই মনোময় নিত্যর সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। নিত্য কলকাতা পুলিশে ডিএসপি পদমর্যাদায় থাকায় তাকে দিয়ে রত্নদীপ আর সর্দারের ফোনের লোকেশন ট্র্যাক করিয়ে একটা ছোট পুলিশের রেড করিয়েছিলেন। সর্দার যে ইন্টারপোলের লিস্টেড ক্রিমিনাল সেকথা জানিয়েছিলেন। পুলিশ অবশ্য সর্দারকে পায় নি।
মনোময়কে চুপ থাকতে দেখে সর্দার আবার বললেন, ‘আপনি আমাকে আন্ডার এস্টিমেট করে ফেললেন সাহেব। ভাবলেন কিকরে টাওয়ার লোকেশন করে আমাকে পেয়ে যাবেন ? রত্নদীপের সাথে কথা বলে আমি অন্য যায়গায় গিয়ে অন্যের ফোনে আপনার সাথে কথা বলেছি। বেকার সময় নষ্ট করলেন’।
মনোময় এবারও কিছু বললেন না। মনে মনে সর্দারের ইন্টেলিজেন্সকে সম্মান করলেন। সর্দার আবার বললেন, ‘আমি আপনাকে আর একটা সুযোগ দিতে চাই’।
‘সুযোগ ?’, এবারে অবাক হলেন মনোময় সর্দারের শব্দচয়নে। সুযোগ আবার কী কথা !
‘আপনি একেবারে নাদান আছেন সাহেব। আপনার তিন বছরের ফুটফুটে মেয়ে কোন স্কুলে পড়ে আমরা জানি। কখন কিভাবে স্কুলে যায় আসে সেটাও জানি। আপনার ওয়াইফ...’
‘দাঁড়ান দাঁড়ান, আপনি কাকে কী বলছেন ?’, মনোময় এবারে রেগে গেলেন।
সর্দার থামলেন না। বলে চললেন, ‘এত্তো বড় একটা শহরে কত কত এক্সিডেন্ট লেগেই থাকে। আপনি সরকারি অফিসার হতে পারেন কিন্তু এমন কোনো ডিএম বা এসপি নন যে আপনার সাথে বা আপনার পরিবারের সাথে সবসময় সিকিউরিটি থাকবে। এইরকম ভুল আপনি ফিউচারে আর করবেন না, সাহেব। আমার দলের লোকেরা ভালো নয়। আপনার ক্ষতি হয়ে যেতে পারে’।
মনোময় ঘামতে শুরু করেছিলেন। মেয়ে স্বাতীর কথা মনে পড়ে গেল। সুজাতার কথাও। একরত্তি মেয়েটার হাত ধরে ডানলপের মোড়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে জনবহুল রাস্তায় একটা দ্রুতগামী টাটা সুমো......। ওহ, আর ভাবতে পারলেন না। মাথায় হাত দিয়ে ঝুঁকে বসলেন।
‘আমি সবাইকে বারণ করে দিয়েছি। এবারে আপনার কেউ ক্ষতি করবে না। কিন্তু নেক্সট টাইম, প্লিজ কোনো বোকামি করবেন না। আপনি ইন্টেলিজেন্ট মানুষ। বুদ্ধি খাটান। ব্রেন ওয়ার্ক করুন, পেপার ওয়ার্ক করুন। কিন্তু আপনাকে বুঝতে হবে, একটা ইন্টারনেশনাল অর্গানাইজেশনের কাছে আপনাকে ফিনিশ করে দেওয়া কোনো ব্যাপারই নয়।’
মনোময়ের কানে ফোনটা ধরা থাকলেও কিছুই তিনি ঠিক শুনছিলেন না। সর্দার বলেই চললেন, ‘রত্নদীপ আপনাকে পুঁথির বাকি অংশটা দিয়ে আসবে আজ। আমাদের কথা যেমন ছিল তেমনই থাকবে। কাজ শুরু করুন’।
কখন যে সর্দারের কথা শেষ হয়ে গিয়েছে মনোময়ের খেয়ালই নেই। রত্নদীপের ফোনটা কানে ধরেই বসে ছিলেন। হুশ ফিরল রত্নদীপের ডাকে। সামনে তাকিয়ে দেখলেন রত্নদীপ তাঁরই দিকে তাকিয়ে বসে রয়েছে। ফোনটা ফেরত দিয়ে উঠে টয়লেটে গিয়ে চোখেমুখে জল দিয়ে ফিরলেন। বেল টিপে আর্দালিকে দুকাপ চা আনতে বলে হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘দাও’।
রত্নদীপ সঙ্গে করে আনা পাণ্ডুলিপির অংশটি এগিয়ে দিল মনোময়ের দিকে।
***
মিনিট দশেক বাদে খানিকটা ধাতস্থ হয়ে মনোময় রত্নদীপকে প্রশ্ন করলেন, ‘সুলতান দাউদের মুদ্রা কোথায় মাটি খুঁড়তে গিয়ে পাওয়া গিয়েছে ?’
‘চিতপুর’।
‘আর হরিদাসের পুঁথি ?’
‘হুগলি’।
‘অর্থাৎ দুটো দুই লোকেশনে। তোমার প্রাথমিক ব্যাখ্যা কী ?’
‘সাহাদা, চিতপুর অঞ্চলে প্রতাপাদিত্যের একটি দুর্গ ছিল শুনেছেন মনে হয়’।
রত্নদীপের সম্বোধনে ‘স্যার’ থেকে ‘সাহাদা’-য় পরিবর্তনটা মনোময় খেয়াল করলেন। পরিবর্তনটা যে সর্দারের হুমকির পরেই হয়েছে সেটাও বুঝলেন। মনে মনে ভাবলেন যে এই ছেলেটির কোনো বেসিক স্ট্যান্ডার্ড নেই। পড়াশোনা আছে। তবে ক্রিমিনালদের সাথে মেলামেশা। কাজকর্মও আঁকাবাঁকা পথ ধরে। এর আচরণেও কোনো কনসিস্ট্যান্সি নেই। এই দাদা বলছে, এই স্যার। দরকার হলে তুই তোকারিও বোধ হয় করতে পারে। এই প্রথমবার মনোময়ের এদের সাথে কাজ করতে রাজি হওয়ার জন্য নিজের মনে গ্লানি বোধ হল কিছুটা। কিন্তু পরক্ষণেই এতো বড় একটি ঐতিহাসিক পর্বের অজানা আবিষ্কারের নেশা সেই গ্লানিকে সরিয়ে দিল মন থেকে। বড় কাজ করতে গেলে এসব ব্যক্তিগত ইমোশনকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার দরকার নেই। তবে নিজের পরিবারকে বিপদে ফেলার থেকে বিরত থাকতে হবে।
‘শুনেছি রত্ন। ডিটেইলস পড়া হয় নি এই বিষয়ে’, মনোময় উত্তর দিলেন।
‘একজন বৌদ্ধ পরিব্রাজকের নাম পাওয়া যায়। কবিরাম। তাঁর লেখার একটি শ্লোক আমি পেয়েছিলাম। বলি ?’
‘হ্যাঁ বল’
রত্নদীপ নিজের মোবাইলে ছবি তুলে রেখেছিল কোনো বই থেকে। গ্যালারি ঘেটে পড়ল,
‘প্রতাপাদিত্যভূপস্য যশোরভূমিপস্য চ।
গঙ্গাবাসস্থলো রাজন্ ইদানীং বর্ত্ততে নৃপ।।
কবিরাম যশোরে গিয়েছিলেন রাজা প্রতাপের সাথে দেখা করতে। গিয়ে শোনেন যে ইদানীং প্রতাপ গঙ্গার তীরে বাস করছেন। এই গঙ্গার তীর, অর্থাৎ চিতপুর এবং সালকিয়ায় প্রতাপের দুটি দুর্গ ছিল। চিতপুরের দুর্গ সম্পর্কে আরো কিছু খবর আছে’।
মনোময় বেশ প্লিজড হয়েছেন। বললেন, ‘তুমি যে বেসিক পড়াশোনা ছেড়ে দেওনি দেখে ভালো লাগল। বল বাকি খবরটি’।
‘চিতপুর-বাগবাজার অঞ্চলে ছিল দুর্গটি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও সেটি কিছুকাল ব্যবহার করেছিল’।
‘চিতপুর আর বাগবাজার কি এক হল নাকি ?’
‘চিতপুর আর বাগবাজার আসলেই পাশাপাশি। এক কিলোমিটারের মধ্যে দূরত্ব। চিতপুরে পাতালেশ্বরী মন্দিরের কাছেই ছিল সেই দুর্গটি। ফোর্ট উইলিয়ম তৈরির আগে কোম্পানি এই দুর্গটি ব্যবহার করত। কোম্পানির ডকুমেন্টে পলাশীর যুদ্ধের আগের বছরে বাগবাজারের এই অঞ্চলটি, বলতে পারেন এই দুর্গটি মেরামতের জন্য ২৫,৭০১ টাকা খরচ করার কথা আছে। সেদিনের বিচারে পঁচিশ হাজার টাকা কম নয়’।
‘তুমি তো বেশ ভালো হোম-ওয়ার্ক করেছ রত্ন’।
সামান্য হেসে রত্নদীপ বলল, ‘সিরাজ নবাব হয়ে এই খরচ করার অনুমতি বন্ধ করে দেন। ইংরেজরা সে আদেশ না শুনলে সিরাজ আক্রমণ করেন। ১৭৫৬ সালের ১৬ জুন নবাবের চার হাজার সৈন্য বাগবাজার আক্রমণ করে। চিতপুর দুর্গ থেকেই ইংরেজরা যুদ্ধ করেছিল’।
‘ইন্টারেস্টিং ! তুমি বলছ এই চিতপুর দুর্গেই প্রতাপের রক্ষিত মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে ?’
‘একটা দুর্গ মানে তাকে কেন্দ্র করে কিছু মানুষের বাস থাকে। প্রতাপবংশীয় কারোর কাছে দাউদের মুদ্রার কিছু অংশ ছিল, যা তিনি বাড়ির নিচে লুকিয়ে রেখেছিলেন। পরবর্তী বংশধরেরা সেসব ভুলে যায়। এখন বাড়ি প্রমোটিং করতে গিয়ে মাটি খুঁড়তে এসে পাওয়া গিয়েছে’।
‘ইয়েস’, মনোময় কনভিন্সড হয়েছেন।
‘কিন্তু এখানে প্রতাপের গুপ্তধনের সামান্য অংশই থাকার কথা। আসল গুপ্তধন থাকবে অন্যত্র’।
‘কেন একথা বলছ বুঝিয়ে বল’।
‘দাদা, প্রতাপের পরাজয়ের পরে কলকাতা অঞ্চলটি প্রতাপের কাকার ছেলে কচু রায় এবং লক্ষ্মীকান্ত মজুমদারের মধ্যে ভাগাভাগি হয়েছিল। কচু রায় বেহালা-শরশুনা অঞ্চলে এবং লক্ষ্মীকান্ত বা সাবর্ণ চৌধুরীরা বড়িশা অঞ্চলে থাকতেন। লালদিঘির কাছে ছিল কাছারি বাড়ি। চিতপুর অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ কেউই থাকতেন না। ফলে প্রতাপের গুপ্তধনের প্রধান অংশ চিতপুরে থাকার কথা নয়’।
‘বুঝেছি রত্ন। গুড অবজারভেশন। তোমার কথাই ঠিক। এবারে আমাকে পড়াশোনা করতে হবে। এবারে অন্য একটা প্রশ্ন’।
‘হ্যাঁ বলুন’, রত্নদীপ আগ্রহী হল।
‘শ্যামরায়মঙ্গল লিখেছিলেন লক্ষ্মীকান্ত মজুমদারের বংশধর। বললে সেই পুঁথিটি পেয়েছ হুগলিতে। তুমি বোধহয় হুগলি জেলা বোঝাতে চেয়েছ ?’
‘ঠিক’
‘হুগলির গোঘাট এবং উত্তরপাড়া, এই দুই অঞ্চলে এঁদের বসবাস ছিল। যদি আমার অনুমান ভুল না হয়ে থাকে তোমরা এটি পেয়েছে উত্তরপাড়ায়। ঠিক বললাম ?’
‘এক্সাক্টলি’, হাসল রত্নদীপ। বলল, ‘এই জন্যই তো আপনার কাছে আসা’।
‘অর্থাৎ আমাকে উত্তরপাড়া দিয়ে শুরু করতে হবে দেখছি। আমাদের ডিপার্টমেন্টে হগলির শ্রীরামপুর সাবডিভিশনে রয়েছে চৈতালি। এনিওয়ে, আমি দেখে নিচ্ছি। তুমি কি আর একবার চা খাবে ?’
রত্নদীপ রাজি হওয়ার মনোময় বেল দিয়ে চায়ের কথা বলে মনে মনে পরবর্তী একশন প্ল্যান ভাবতে লাগলেন।