জীবনবোধে চৈতন্যের উদ্ভাবক শ্রীরামকৃষ্ণ

শ্রীরামকৃষ্ণকে রক্ত মাংসের মানুষ হিশেবে দেখার মধ্যে দিয়ে আমাদের উপলব্ধি জন্ময়; তিনি ছিলেন , মানবজীবনে চৈতন্যের উদ্ভাবক
 
শ্রীরামকৃষ্ণ কে আমরা কেবলমাত্র আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলে দেখতেই ভালোবাসি।ধর্মগুরু হিসেবে তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করবার দিকেই একটা বড় অংশের মানুষের মধ্যে প্রবণতা বেশি দেখতে পাওয়া যায়। আসলে শ্রীরামকৃষ্ণ হলেন খানিকটা অন্ধের হস্তি ধর্ষণের মত বিষয় ।অন্ধ যেমন একটা হাতিকে দেখে দর্শন ইন্দ্রিয়ের দ্বারা খুব একটা কিছু বুঝে উঠতে পারে না ।স্পর্শেন্দ্রিয়ের  দ্বারাই  তাঁকে অনুভব করতে হয়  হাতিকে।আর সেই অনুভূতি থেকে কখনো তাঁর মনে হয়, হাতি মানে শুড়। কখনো তার মনে হয়,  হাতি কেবল ই হাতির পা । অর্থাৎ; মস্ত মস্ত থাম।
             ঠিক সেভাবেই সাধারণ মানুষ শ্রীরামকৃষ্ণের সামগ্রিকতা সবসময় বুঝে উঠতে না পেরে,  কোন ও একটা বিশেষ আঙ্গিক থেকে তাঁকে দেখে, তাঁর সম্বন্ধে মূল্যায়ন করবার চেষ্টা করে ।যাঁরা আধ্যাত্মিকতার নিরিখ তাঁকে দেখে, তাঁরাও যে সবসময় আধ্যাত্মিকতা ঘিরে শ্রীরামকৃষ্ণের যে অসামান্য উদারতা,  কোন ওরকম সংকীর্ণতাকে মনের মধ্যে ঠাঁই না দেওয়া, অনবদ্য মানব প্রেম, যুক্তিবাদের প্রতি অকুন্ঠ ভালোবাসা-- এই জিনিসগুলির চর্চা র ক্ষেত্রে তাঁদের ক্ষেত্র  সব সময় তাঁদৃর  খুব একটা যথোপযুক্ত  হয় না।
 রক্তমাংসের শিয়ামো কৃষ্ণ অপেক্ষা তারা শ্রী রামকৃষ্ণের আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গিকে চর্চা করবার নাম করে তাকে নিজেদের যাপন চিত্রের অঙ্গ না করে কুলুঙ্গিতে ঠাঁই দিতেই বেশি উৎসাহী ফলে একজন অতি অসাধারণ ব্যক্তিত্ব যিনি পরিপূর্ণভাবে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠা একটা বাহান্ন বছর বয়সে সময়কালে করে গেছেন শুধু করে গেছেনই না একটা দৃষ্টান্তমূলক বিষয় মানব সমাজের ক্ষেত্রে জাতি ধর্মবর্ণ দেশ কাল নির্বিশেষে গোটা মানব সমাজের জন্য একটা দৃষ্টান্ত। জিনিস স্থাপন করে গেছেন। সেই দৃষ্টান্তের দিকে নজর দেওয়া তাকে অনুশীলন করা এই সমস্ত দিকগুলি ঘিরে যেন আমরা একটু কম নজরে দিয়ে থাকি।
তাঁকে যদি আমরা কেবলমাত্র আধ্যাত্মিক জগতের একজন ব্যক্তিত্ব হিসেবে না দেখে, সমস্ত রকমের ইতিবাচক মানসিকতার একটা আধার হিসেবে দেখি, তাঁর জীবনের একদম অন্তিম পর্বের কিছু কিছু ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখতে পাবো শ্রীরামকৃষ্ণ নামক ব্যক্তিত্বটির  গোটা জীবনের যে কর্মকাণ্ড, যাকে এক কথায় বলা যায় ; মানব জীবনের চৈতন্যের উদ্বোধন ।সেই লক্ষ্যে সবকিছু  পরিচালিত করবার ক্ষেত্রে, জীবনের অন্তিম পর্ব, যখন তিনি দুরারোগ্য ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত। প্রায় চলৎশক্তি রহিত ।কোন ও শক্ত বা আধা শক্ত খাবার খেতে পারছেন না। একেবারে তরল খাবার ,তাও বহু কষ্ট করে কোন ও দিন খেতে পারছেন,  কোন ওদিন খেতে পারছেন না।
 এইরকম একটা অবস্থার মধ্যেও মানুষের চৈতন্যের উদ্বোধনে কিভাবে নিজের জীবনের প্রতি এতটুকু নজর না দিয়ে, নিজের অসুখকে এতোটুকু প্রাধান্য না দিয়ে ,নিজেকে তিনি নিয়োজিত রাখছেন, তা ভাবলে আমাদের অবাক হতে হয়।
 মানুষের মঙ্গল চিন্তা ,সে মঙ্গল চিন্তার পরিমন্ডলে  যে কেবলমাত্র তাঁর ভক্তরাই আছেন, তা নয়। যাঁরা তার পূত সান্নিধ্য লাভ করেন নি, বা যাঁরা তাঁকে পছন্দ করেন না,  তাঁর আধ্যাত্মিক চেতনাকে নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করেন-- এই সমস্ত মানুষদের জন্যেও  তাঁর মঙ্গল কামনা । তাঁদের সকলের যাতে ভালো হয় , সবাই যাতে একটা সুন্দর জীবন যাপন করতে পারেন-  সবাই যাতে একটা সৎ জীবন যাপন করতে পারেন,  তার জন্য  শ্রীরামকৃষ্ণের চেষ্টা ত্রুটি ছিল না।
মানুষের চৈতন্য উদ্বোধনে তাঁর জীবনের অন্তিম পর্বের সেই দিনটি ১৮৮৬  সালের পয়লা জানুয়ারি ,যেদিন তিনি সকলের উদ্দেশে একটি কথাই বলেছিলেন ;তোমাদের চৈতন্য হোক। সেটি কেবলমাত্র তাঁর ওই নির্দিষ্ট দিনে বলা একটি আপ্ত  বাক্য ছিল না। তাঁর গোটা জীবন ধরে যে মানব সাধনা ,সেই সাধনার মূল লক্ষ্যই ছিল ; মানব জীবনে চৈতন্যের উদ্বোধন ঘটানো ।
এখানে পাঠক লক্ষ্য করবেন ,শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি কেবলমাত্র ভক্তি গদগদ চিত্তে আধ্যাত্মিক চেতনা শব্দটি  ব্যবহার করা হলো না ।ব্যবহার করা হলো মানব চেতনা। এই মানব চেতনা কিন্তু সার্বিকভাবে এই মানুষে  আছে সেই মানুষ --সেই লক্ষ্যেই শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর গোটা জীবনটাকে পরিচালিত করেছিলেন।
 আবার সেই মানব সাধনার লক্ষ্যে বাউল তত্ত্বের যে গুজ্য  সাধনা, সে পথেও কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ কখনো হাঁটেন নি। মানুষ রতনের সন্ধানে তিনি দেহ সুখকে কখনো কামনা করেননি বা তার চর্চা করেন নি।
শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনব্যাপী যে শিক্ষা ,তাকে কখনো কোন  ওনির্দিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বেড়াজালে বেঁধে ফেলাটা ঠিক হবে না। ধর্মকে যদি আমরা নিছক প্রাতিষ্ঠানিক বেড়াজালে আবদ্ধ না করে ,ধারণ করে থাকা একটা বোধ হিসেবে ভাববার চেষ্টা করি ,তাহলে হয়তো শ্রীরামকৃষ্ণের শিক্ষার মর্মার্থ কিছুটা হলেও অনুভব করতে পারব।
ঈশ্বর লাভ কে তিনি জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য বলে নির্দেশ করে গিয়েছেন ।কিন্তু সেই ঈশ্বর লাভের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে, শর্টকাট কিছু পথ আছে ।যেমন;  যোগের বিভিন্ন ধরনের পথ ।বিশেষ করে হটযোগ-- এগুলি সম্পর্কে যেসব কাহিনী প্রচলিত রয়েছে,  যেমন ,হটযোগী তিনি ভরা নদীর উপর দিয়ে নাকি হেঁটে যেতে পারেন ।এমন  নানা ধরনের  কাহিনী এইসব যোগীদের সম্পর্কে প্রচলিত রয়েছে। সেসব কাহিনীতে অতিপ্রাকৃত বিষয়গুলি সব থেকে বেশি প্রাধান্য পায়। 
সেই অতিপ্রাকৃত বিষয়ের ধারপাশ দিয়ে কিন্তু একটি বারের জন্যে ও শ্রীরামকৃষ্ণ কখনো হাঁটেননি। তাঁর খুব স্পষ্ট কথা ছিল; যে সাধু ওষুধ দেয়। তাবিজ কবজ দেয় ।সাই বোর্ড লাগায়, অর্থাৎ; সাইনবোর্ড এতে চলে সেই সাধুকে কখনো বিশ্বাস করিস নে আজকের ভারতের সামাজিক প্রেক্ষিতে একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব যদি এই ধরনের কথা বলতেন তাহলে না জানি তাকে কি ধরনের রাজনৈতিক হেনস্তার স্বীকার করতে হতো উনিশ শতকের মধ্যভাগে দাঁড়িয়ে জীবন ভিক্ষার যে শিক্ষা সিনেমা কৃষ্ণ দিয়ে গেছেন সে শিক্ষা কেবলমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের নিগড়ে নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলবার তাগিদে পরিচালিত করবার শিক্ষা নয় সে শিক্ষা হল মানবজীবনের চৈতন্যের উদ্বোধন ঘটানোর লক্ষ্যে সামগ্রিকভাবে পথ চলবার একটা শিক্ষা।
ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব মানেই জাগতিক জীবনের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়গুলির সঙ্গে তাঁদের একটা সরাসরি সম্পর্ক থাকবে ,সম্পৃক্ততা থাকবে-- এই বোধের সঙ্গে কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন দর্শন কখনো যায় না ।প্রথম জীবনে রানী রাসমণি বা তাঁর জামাই মথুরবাবুর যে পৃষ্ঠপোষকতা তিনি পেয়েছিলেন ,তাতে তিনি চাইলে জাগতিক ভোগ সুখের একটা বড় রকমের ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে নিজের জীবনটা কাটাতে পারতেন। তাঁর নিজের কথাতেই, বস্তুগত বিষয়গুলি যদি জীবনের সবথেকে বড় নিত্যতা হতো ,তাহলে তো আমি কামারপুকুর সোনা দিয়ে মুড়ে দিতে পারতাম।
                জীবনের নিত্যতা যে সত্যে স্থিত থেকে জীবনকে পরিচালিত করবার অনন্ত পরিক্রমা --এই বোধের উন্মেষ ঘটানোটাই শ্রীরামকৃষ্ণের গোটা জীবনের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল। স্বামী বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ মিশনের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠার আগেও যেভাবে সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবাদর্শকে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন  এবং পরবর্তীতে সেই কাজ রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠার পর ,মিশনের উদ্দেশ্য হিসেবে নির্দিষ্ট করেছিলেন, তার মূলে কিন্তু ছিল, স্বামীজীর শ্রীরামকৃষ্ণের কাছ থেকে পাওয়া জীবনবোধ।
                ' শিবজ্ঞানে জীব সেবা'-- এই যে বোধের উন্মিলন বিবেকানন্দ কেবলমাত্র বাঙালির কাছে নয়, কেবলমাত্র ভারতবাসীর কাছে নয়, গোটা বিশ্বের মানবজাতির সামনে করে গিয়েছেন --তার মূল শিক্ষায় কিন্তু তিনি পেয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের কাছ থেকে। শ্রীরামকৃষ্ণ কে কিন্তু জীবন দেবতা হিসেবে স্বামীজি স্থির করে নিয়েছিলেন তাঁকে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে। স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন,  গুরুকে দিনে দেখবি,  রাত্রে দেখবি, সব ভাবে দেখবি। তবে তাঁকে বিশ্বাস করবি। 
এ কথাটি কে একেবারে বাস্তব প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে উপলব্ধি করে, যুক্তিবাদী বিবেকানন্দ, শ্রীরামকৃষ্ণ গত প্রাণ হয়েছিলেন। সেই বোধের প্রতি সম্মান জানানো, সেই বোধকে মর্যাদা দেওয়া ই কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণকে অন্তরে অধিষ্ঠিত করবার মূল তাৎপর্য ।এই তাৎপর্যের ভেতর দিয়েই আমরা সর্বধর্মসমন্বয়ের এক অসামান্য দর্শনকে আজকের এই বিশ শতকে, নানা ধরনের রাজনৈতিক  -সামাজিক- আর্থিক এবং ধর্মীয় বিবাদবিসংবাদের মধ্যেও আত্ম উপলব্ধির মূল সুর হিসেবে যদি উপস্থাপিত করি ,তবে জীবনের ছন্দ, জীবনের তাৎপর্য ,সর্বোপরি বেঁচে থাকবার ইতিবাচক দিককে আমরা অন্যভাবে উপলব্ধি করতে পারব।

  • শ্যামলী ভট্টাচার্য