দুঃখজয়ী কবি

দুঃখকে কেবল জয় নয়।দুঃখকে অতিক্রম করে জীবনকে সুস্থিত করা- এই বোধ ই শামসুর রাহমানের সৃষ্টির সুর
 
যদি বরেন্দ্র মন্ডলের মত অধ্যাপক বাংলা কবিতায় সুখের অনুভূতি আর দুঃখের অনুভূতি, এ নিয়ে একটা ক্ষেত্র সমীক্ষা চালান, তবে মনে হয়, সুখের অনুভূতির কবিতার সংখ্যা, বাংলা কবিতায় কমতির দিকেই থাকবে। দুঃখের অনুভূতি সূচক কবিতা,  সংখ্যার নিরিখে পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে , বাঙালি কি দুঃখবিলাসী ?না, দুঃখ স্বাভাবিক। দুঃখ কে কি বাঙালি নিজের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় টানা বৈশিষ্ট্যের মধ্যে দিয়ে, নানা ধরনের আবেগের চাপানতরের ভেতর দিয়ে ,আবার কখনো বা একটা আপোষকামী চিন্তার চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করবার তাগিদ থেকে ,রবীন্দ্রনাথের ভাষায়;  মম দুঃখের সাধনকে ,সেরা সাধন হিসেবেই সর্বাগ্রে ঠাঁই দিয়ে এসেছে।
 এভাবেই কি  বাঙালি দুঃখের সাধনাকে, তার নিজস্ব অস্তিত্বের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে ফেলেছে ?বাঙালির জীবনে প্রেম আর দুঃখ-- বঙ্কিম থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ হয়ে, সমরেশ ,শামসুর, সুনীল ,শক্তি , নবনীতা, মল্লিকা প্রমুখদের প্রত্যেকের সৃষ্টিতে কোন ও না কোন ও ভাবে ছায়াপথ করেছে। তাই যখন আমরা দেখি শামসুর রাহমান লিখছেন;" কবিকে দিও না দুঃখ, দুঃখ  দিলে সে -ও জলে স্থলে /হাওয়ায় হাওয়ায়/ নীলিমায় গেঁথে দেবে দুখেঃর  অক্ষর ।"  আমাদের তখন মনে হয়,  শামসুর রহমান যে বলেছিলেন ; কবি তার নিজের নিঃসঙ্গতাকে কাফনের মত মুড়ে রেখে দিয়েছে আপাদমস্তক।
কবির  নিঃসঙ্গতা , সেটা কি কেবল কবির ই? কবি যশপ্রার্থীদের মধ্যে সবাইকে কবি বলে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নে জীবনানন্দের কিছু একান্ত নিজস্ব বক্তব্য ছিল। তবু এখানে বলতে হয়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর 'অরণ্যের দিনরাত্রি 'উপন্যাসে যে কজন পুরুষ চরিত্র এবং মূলত যে তিনটি নারী চরিত্র ,তাদের একটা আবর্তন তৈরি করলেন, সেই চরিত্রগুলোর মধ্যেও কি একটা কবিসত্তা ছিল না ?সেই চরিত্রগুলো কি কোন  ও একটা জায়গায় দুঃখ পেয়ে, হাওয়ায় হাওয়ায় নীলিমায় গেঁথে দেননি দুঃখের অক্ষরকে? 
               আসলে দুঃখ ভুলতে চাওয়া এটা মানব মনুষত্বের একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ দিক। আমরা আজ শামসুর রাহমান প্রয়াণের (১৭ ই আগস্ট, ২০০৬) দিনটিকে স্মরণ করে, তাঁর কেবলমাত্র একটি কবিতার মধ্যে দিয়েই ,তাঁর দুঃখ সত্তা ,যেটি সামগ্রিকভাবে মানুষের দুঃখ সত্তার সঙ্গে একটা সম্পৃক্ততার আভাস  দিচ্ছে, সেইটির  সুলুক সন্ধান করতে গিয়ে ,  সুখী মানুষ, তারও দুঃখ বোধ ,দুঃখের সত্ত্বা, আর দুঃখী মানুষের দুঃখের সত্ত্বার কোথায় যেন একটা মেলবন্ধনের আভাস কি পাচ্ছিনা?
কবিকে দুঃখ না দেওয়ার যে ব্যঞ্জনার কথা শামসুর রাহমান বলছেন ,তার মধ্যে কি সামগ্রিকভাবে কবিদের জীবন ব্যাপৃত রয়েছে? নাকি, শুধুই শামসুরের ব্যক্তিজীবনের দুঃখের একটা অন্তর্নিহিত বার্তা এখানে ধ্বনিত -প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ?কবি যে দুঃখ পেলে ,সেই দুঃখকে তার অন্তরের ভালোবাসা দিয়ে জারিত করে ,খোদাই করে দিতে পারেন সময়ের বুকে--শামসুর সে কথা কেবল এই কবিতাটি নয় ।বারবার যেন তাঁর প্রায় সমস্ত  কবিতার ভেতর দিয়ে বলে গিয়েছেন। 
প্রায় সমস্ত কবিতার ভেতর দিয়ে তাঁর এই যে বলে যাওয়া ,সেখানে দুঃখের অক্ষরের ভেতর দিয়ে সুখের আখর রচনা-- এটা যেন ছিল তাঁর জীবনের জয়গান গাইবার একটা বিশেষ রকমের ধারা ।এই ধারা অনুসরণের জন্য আজকের প্রজন্মের অনেক কবি, তাঁরা শামসুরকে এই বলে অভিযুক্ত করে যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি প্রত্যক্ষভাবে কোন ও ভূমিকা নাকি পালন করেননি। 
আসলে বোধের জায়গাগুলো যেন কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। যেকোনো ইতিহাসের ঘনঘটায় প্রত্যেকটা মানুষের একটা ইতিবাচক বা একটা নেতিবাচক ভূমিকা থাকে। প্রত্যক্ষ সংগ্রামের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত হন ,তাঁরা প্রত্যেকেই যে যুদ্ধের কালে কলম ফেলে নিয়ে দিয়ে বন্দুক ধরেন ,তা তো নয়। কলম ও যে  একটা বন্দুক বলা যেতে পারে ।কলম হল ধাতু নির্মিত বন্দুক।ধাতুর তৈরি বন্দুকের থেকেও আরো অনেক অনেক বেশি শক্তিশালী একটি বন্দুক হল কলম। 
সেই বন্দুক দিয়েই তো শামসুর রাহমান মুক্তিযুদ্ধের কালে এক দুপুরে তৈরি করেছিলেন সেই অমগ অমর দুই যমজ কবিতা।' তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা' আর,' স্বাধীনতা তুমি রবি ঠাকুরের অজর কবিতা অবিনাশী গান'।
 শামসুরের গোটা জীবনের সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা যদি আমরা না ও করি, তাহলে কি এই যমজ কবিতা দুটিকে ,পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধের কালে লেখা ,নীলিমায় গেঁথে দেওয়া ,হাওয়ার মাঝে এক দুঃখের অক্ষর বলা যেতে পারে না ? 
               যারা আজকের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যুদ্ধ মানে শব্দ সৈনিকের ভূমিকাটিকে ভুলিয়ে দিতে চায়,  তারাই মনে করে শামসুর যুদ্ধক্ষেত্রে তো বন্দুক হাতে  নামেননি। সুতরাং তিনি  মুক্তিযোদ্ধা নন। 
                তখনই মনে হয় এই যে,' কবিকে দিও না দুঃখ' শীর্ষক কবিতায় শামসুর লিখছেন ;" দালানের চূড়ায় চূড়ায়, দিগন্তের অন্তরালে/ কেমন বেড়ায় ভেসে, চাঁদের নিকট যায় ,নক্ষত্র ছিটোয়  যত্রতত্র /খোলামকুচির মত ।তাকে দুঃখ দিও না, চৌকাঠ থেকে দূরে/ দিয়ো না ফিরিয়ে।"
 চৌকাঠ থেকে ফিরিয়ে না দেওয়ার যে কাকুতি, তার ভেতর থেকে কি ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে না একটা মরু বিজয়ের কেতন ওড়াবার শব্দ?  অপাপবিদ্ধ সুর প্রতিধ্বনিত হচ্ছে না মানুষের জয়গানের? এক কালজয়ী চেতনার ইঙ্গিত কি পাওয়া যাচ্ছে না?
শামসুর কিন্তু দুঃখ বিলাসী ছিলেন না। দুঃখ তাঁর জীবনে নানা সময়ে নানাভাবে এসেছে। ব্যক্তি জীবনের দুঃখ,  দেশের দুর্দশা জনিত দুঃখ , মানুষের দুর্দশা জনিত দুঃখ --এ সমস্ত কিছুই তাঁকে ছিন্ন ভিন্ন  করেছে বারবার ।কিন্তু সেই বিদীর্ণতায় তিনি আকীর্ণ হয়ে পড়েননি। দুঃখের বিভিন্নতায় অবগাহন করতে করতে শামসুর রাহমান কখনো এক ধরনের দুঃখ প্রেমী মানসিক সত্তায় নিজের আনন্দময় স্বত্বাটিকে রূপান্তরিত করেননি। 
শামসুরের সমস্ত চেতনার মূল সুর হিসেবে কিন্তু সব সময় ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়েছে,  জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ--  আনন্দযজ্ঞ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখে, দুঃখকে কেন্দ্র করে এক ধরনের মানসিক তৃপ্তির মধ্যে বাস করা --এ ধরনের কোন ও  মানসিক বৈকল্য শামসুর রাহমানের মধ্যে  কখনো এতোটুকু জেগে ওঠেনি। দুঃখের রাত্রি গভীর হলে রুদ্রজ্জ্বল দিন উঁকি দেবেই --এই বোধ থেকে তিনি তাঁর  গোটা জীবনে কখনো বিচ্যুত হননি। কখনো সরে আসেননি।
যে কবিতাটি কে ঘিরে প্রয়াণ দিবসে শামসুরের স্মৃতি দর্পণ করতে আমরা চেষ্টা করছি, সেই কবিতাটি তাঁর ,'আমি অনাহারি'  কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ।'রৌদ্র করোটিতে' কাব্যগ্রন্থেও তিনি দুঃখ বিষয়ক কবিতা লিখেছিলেন।
 কেউ কেউ বলে থাকেন ,শামসুরের আমি কেন্দ্রিক বা ব্যক্তি কেন্দ্রিক আবরণের একটা অন্যতম বড় বৈশিষ্ট্য হলো এই দুঃখ ।কিন্তু দুঃখকে কখনো শামসুর, বুদ্ধদেবের মত একটা দার্শনিক পরিব্যক্তির মধ্যে রেখে দিতে চাননি। আবার সোপেনহাওয়ার যেভাবে দুঃখকে ঘিরে একটা ভিন্নধর্মী দার্শনিক ব্যঞ্জনা তৈরি করেছিলেন ,সে রকম কোন ও স্বপ্ন বাস্তবতার মধ্যে দুঃখকে আবর্তিত করে, শামসুর কোন ও ধরনের তৃপ্তি পেতে চেয়েছিলেন --এটা যেমন শামসুরের গোটা সৃষ্টিকে অনুধাবন করলে এতোটুকু মনে হয় না। আবার আমরা যাঁরা ,তাঁকে একটু কাছ থেকে দেখবার পরমতম সৌভাগ্যের অধিকারী, তাঁদের কাছেও মনে হয় না,  কখনো এই ধরনের ভাবনা কবিকে তাড়িত করত।
শামসুরকে যতটুকুনি দেখবার সুযোগ পেয়েছি, তার থেকে এটা সব সময় মনে হয়েছে ,কখনো কোনো রকম অধিবাস্তবের দুয়ার খুলবার জন্য তিনি ব্যগ্র  থাকতেন না। তাই হয়তো দুঃখবোধের চেতনার উদ্ভাসনে ও শামসুর কখনো নিজের কাছে নিজে বলেননি;'  কেন রে এই দুয়ার টুকু পার হতে সংসয়' । চারপাশকে দেখবার এক অসামান্য চোখ ছিল মানুষটির ।তিনি নিজে যদিও বলতেন, গ্লুকোমা আক্রান্ত তাঁর অবস্থা কি কবি মিলটনের মত হয়ে যাবে ? 
হয়তো তাঁর চোখের জ্যোতির বাইরের আবরণ ক্ষীণ থেকে ক্ষীনতর হয়ে আসছিল শারীরিক অসুস্থতার জন্য ।আর সেই ক্ষীনতাটাই তাঁকে ক্রমশ দিচ্ছিল ,এক অন্তরের জ্যোতি। আর সেই অন্তরের জ্যোতির বলেই তিনি হয়ে উঠেছেন, দুঃখকে অতিক্রম করবার এক অসামান্য মানব প্রকৃতিবেত্তা

  • সম্পাদকীয়