দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে দক্ষিণ এশিয়াতে সব থেকে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক কার্যক্রম হল, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সৃষ্টি।এই ঘটনা নয়া সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মানুষের এক মহা সংগ্রাম
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জেরেই ব্রিটিশ ভারত থেকে তার শাসন গোটাতে কার্যত বাধ্য হয়েছিল। তবে ভারত থেকে পাততাড়ি গোটানোর আগে, তারা, ভারতকে প্রায় ২০০ বছর শাসন করবার ক্ষেত্রে যে বিভাজন নীতি কে সামনে রেখে সবথেকে বেশি সাফল্য অর্জন করেছিল, সেই সাফল্যের ধারাকে অব্যাহত রাখতেই এই দেশকে দ্বিখণ্ডিত করে ,ভারত এবং পাকিস্তানের জন্ম দেয়।
জন্ম লগ্ন থেকেই নানা ধরনের সংকটের আবর্তে পড়তে হয়েছিল পাকিস্তানকে। ক্ষমতা হস্তান্তরের কালে ভারতের যে পরিমাণ অর্থ পাকিস্তানকে দেওয়ার কথা ছিল , তা নিয়ে ভারতের সেই সময়ের দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক নেতারা ,যাঁদের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক শক্তির সম্পর্ক একটু বেশিই ছিল, তাঁরা প্রবল আপত্তি তুলেছিলেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের কালে পাকিস্তানকে দেয় অর্থ ঘিরে যে চুক্তি হয়েছিল ,তাকে মান্যতা দেওয়ার পক্ষে সব সময় আন্তরিক ছিলেন পন্ডিত নেহরু। এই বিষয়ে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল মহাত্মা গান্ধীর ও।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় ,কংগ্রেসের ভিতর দক্ষিণপন্থী ,সম্প্রদায়িক শক্তি ,যাঁদের সেই সময় জাতীয় সরকারের উপরে প্রভাব ছিল অত্যন্ত বেশি রকমের , আর সরাসরি হিন্দু সম্প্রদায়িক শক্তির যে সমস্ত প্রতিভু প্রত্যক্ষ ভাবে জাতীয় সরকারের অংশীদার ছিলেন, যেমন; শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, তাঁরা কোন ও অবস্থাতেই পাকিস্তানকে তাদের প্রাপ্য অর্থ দেওয়ার ব্যাপারে রাজি ছিলেন না ।
এ নিয়ে কংগ্রেসের মধ্যেকার প্রগতিশীল অংশের সঙ্গে গোটা ভারতের সেই সময় দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে একটা প্রবল মতান্তার ,মনান্তর তৈরি হয়েছিল। সামগ্রিকভাবে এই যে পাকিস্তানকে দেয় অর্থ ঘিরে পরিস্থিতি, সেই সময়ে ভারতে এমন একটা পর্যায়ে চলে গেছিল যা বিভাগ উত্তর কালে ,সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের কাজটি, স্বাধীন ভারতে করবার ক্ষেত্রে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তিকে নতুন করে সঙ্গবদ্ধ করেছিল।
পাকিস্তানকে তার প্রাপ্য টাকা বুঝিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে মহাত্মা গান্ধী যেভাবে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন ,সেটি হয়তো তাঁকে হত্যা করবার ক্ষেত্রে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তিকে একটা বড় রকমের ক্যাটালিস্টের ভূমিকা হিসেবে উপকরণ করে তুলেছিল।গান্ধীজী হত্যায় এই বিষয়টি হিন্দু সাম্প্রদায়িক ,মৌলবাদী শক্তির কাছে একটা সরাসরি কারন ছিল। ভারতের সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বেরা, পাকিস্তান সম্পর্কে যে মানসিকতা নিয়ে চলুক না কেন, পন্ডিত নেহরু কিন্তু কখনোই তেমন মানসিকতা নিয়ে চলেন নি কোনো দিন।
আবার পাকিস্তানের প্রতি কখনো দুর্বলতা, সেটাও তিনি দেখান নি তবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ,সেখানকার মানুষদের উপরে যে ধরনের অর্থনৈতিক শোষণ পশ্চিম পাকিস্তান চালাচ্ছে ,সেসব ঘটনা সম্পর্কে নীরব ভূমিকা পালন করে যাওয়া এটাও পন্ডিত নেহরুর রাজনৈতিক চরিত্রে ছিল না।
'৪৭ এর বিভাজনের পর, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে সংকটটা প্রথম ঘনীভূত হল, তা ছিল অর্থনৈতিক। পশ্চিম পাকিস্তান একদিকে ভারতের কাছ থেকে পাওয়া টাকা ,সেটা সবটাই ব্যবহৃত করতে থাকলো পাকিস্তানের পশ্চিম অংশে। কোন ও অবস্থাতেই পূর্ব পাকিস্তানের আর্থ-সামাজিক সংস্কারের ক্ষেত্রে একটা পয়সা দিতেও তারা রাজি ছিল না ।
অপরপক্ষে জিন্নাহর মৃত্যুর অব্যবহিত পরে 'জিন্না ফান্ড' তৈরির লক্ষ্যে যেভাবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি সমাজের উপর মুসলিম লীগ জুলুম চালাতে শুরু করল। সে ঘটনাই কিন্তু আজকের বাংলাদেশের উদ্ভবের একটা আর্থ-সামাজিক এবং অবশ্যই রাজনৈতিক পটভূমিকা তৈরি করে দিল। গরিব চাষীদের উপর মুসলিম লীগ তথা পশ্চিম পাকিস্তানের যে চাঁদার জুলুমবাজি ,এটা সদ্য সৃষ্ট হওয়া পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ যাঁদেরকে একসময় ,একযোগে মুসলিম লীগ এবং হিন্দু মহাসভা ,তাঁদের তাঁদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ,পাকিস্তান কায়েমের লক্ষ্যে পরিচালিত করেছিল, তাঁদের মধ্যে একটা বড় রকমের বিক্ষুব্ধ মানসিকতাকে তৈরি হতে সাহায্য করলো।
এই পটভূমিকা সার্বিকভাবে রাষ্ট্র ভাষাকে কেন্দ্র করে যে ক্ষোভ বিক্ষোভ পূর্ব পাকিস্তানের তৈরি হতে শুরু করেছিল, যা আছড়ে পড়ল '৫২ র একুশে ফেব্রুয়ারি ,সেই গোটা কার্যক্রমের একটা রাজনৈতিক পটভূমিকা তৈরি করে ।ভাষা আন্দোলন-- কেবলমাত্র মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য বাঙালি আন্দোলন করেছিল ,এটা ভাবলে ভুল হবে ।সেই আন্দোলনের মধ্যে একটা বড় রকমের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ছিল ।সেই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের প্রথম এবং প্রধান বিষয়টিই ছিল ,পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শোষণ।
পাট ছিল সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতির একটা বিশেষ উল্লেখযোগ্য স্তম্ভ। এই পাটকে কেন্দ্র করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান যে অর্থ উপার্জন করত সেই টাকা, পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে চলে যেত তাদের ভূখণ্ডে ।বস্তুত বাঙালির রক্ত ঘাম দিয়ে তারা তৈরি করছে তখন ইসলামাবাদ ।
এই সমস্ত প্রক্রিয়া কিন্তু রাষ্ট্রভাষাকে কেন্দ্র করে ,হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে ,তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি সমাজ কে ,পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল ।ভাষা আন্দোলনের রাজনৈতিক দিকটা, ওপার বাংলায় যথেষ্ট আলোচিত হলেও এপার বাংলায় ভাষা আন্দোলনের বিষয় আলোচনার ক্ষেত্রে, কেবলমাত্র ভাষা কেন্দ্রিকতাকেই প্রধান করে দেখা হয়।
ইতিহাসগতভাবে এটা কিন্তু ঠিক নয়। ভাষাকে কেন্দ্র করে মানুষের রাজনৈতিক ক্ষোভ ,বিশেষ করে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ, সেটির পরিস্ফুটন কিন্তু ঘটেছিল এই মহান ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। আর এই ভাষা আন্দোলন কিন্তু যে মুসলিম জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে, মুসলিম লীগ ,পাকিস্তান কায়েমের আন্দোলন শুরু করেছিল এবং শেষ পর্যন্ত কায়েম করতে পেরেছিল, যা ছিল হিন্দু জাতীয়তার একটা পাল্টা --এই ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাকে, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তায় রূপান্তরিত করল ভাষা আন্দোলন।
একটা জাতির সম্মুখ বিকাশে ধর্মের কোন রাষ্ট্রীয় ভূমিকা থাকতে পারে না । ধর্ম হল, ব্যক্তিমানুষের যাপন চিত্রের একটি অংশ ।এই ধর্মকে কোন ও মানুষ তার যাপন চিত্রে অত্যাধিক গুরুত্ব দিতে পারে ।আবার কোন ও মানুষ তার যাপন চিত্রে ধর্মকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে পারে। এটা যাঁর যাঁর ব্যক্তিগত যাপনচিত্র জনিত বিষয় ।এর সঙ্গে রাষ্ট্রের কখনো কোন ও রকম ভূমিকা থাকতে পারে না ।
মুক্তিযুদ্ধের অর্জন যে ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, তার সুতিকাগার ছিল কিন্তু '৫২ র মহান ভাষা আন্দোলন। আর এই বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারাটাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছয়ের দশকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যে সমস্ত আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে সঙ্গবদ্ধ করেছিলেন , যেমন ; ছয় দফার আন্দোলন ,'৬৯ এর অভ্যুত্থান বা পাকিস্তান ,বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে যে ধরনের রাজনৈতিক পটভূমিকা তৈরি করেছিল বাঙালিকে পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে জাগরিত করবার ক্ষেত্রে-- এই গোটা কর্মকাণ্ডের মূল সুর ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ।
সেই বাঙালি জাতীয়তাবাদকে বাঙালির স্বাধিকারের প্রশ্নে রূপান্তরিত করা, সেই কাজটিই কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তাজউদ্দিন, মনসুর আলী ,কামরুজ্জামান সহ লক্ষ লক্ষ বাঙালি সংগঠিত করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ কেবলমাত্র বাংলাদেশকে স্বাধীন করবার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়নি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ উত্তর, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিকে নতুন করে উপনিবেশিকতার শিকল পড়ানোর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তান যেভাবে তার নিজের দেশেরই তৎকালীন অংশ পূর্ব পাকিস্তানের উপরে ছায়া উপনিবেশ কায়েম করেছিল, তার চরিত্রের সঙ্গে ব্রিটিশ উপনিবেশিকতার ছিল আশ্চর্য রকমের সাদৃশ্য ।
ব্রিটিশের যে বিভাজন নীতি, যার দ্বারা ,তারা ২০০ বছর ভারত শাসন করেছে এবং সেই নীতিকে অবলম্বন করে তারা ক্ষমতা হস্তান্তরকালে ভারতকে বিভক্ত করেছে ।পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকেরা ব্রিটিশের সেই বিভাজন নীতি কে অবলম্বন করেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি তাদের নীতি প্রস্তুত করেছিল ।সেই বিভাজনের পরিকল্পনায় ইসলামীকরণ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ।
যখন তারা দেখছে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাকে, তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে , তখন আবারো ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং পবিত্র ইসলামকে নিজের মতো ব্যাখ্যা করে, এক ধরনের শরীয়ত নির্ভর সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা, যেখানে উদার মানসিকতা সম্পন্ন মুসলমানও ঠাঁই পাবেন না, ধর্মান্ধতাই হবে নাগরিকদের চিন্তা চেতনার একমাত্র হাতিয়ার ,এটাই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের লক্ষ্য ।
গণতন্ত্রকে পদদলিত করবার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি সমাজকে ইসলামীকরণ করার দিকে পশ্চিম পাকিস্তানের যে ঝোঁক, হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালি কে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল ।আর সেই বিক্ষোভের যন্ত্রণার, বেদনার ফলশ্রুতি কিন্তু ছিল একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ।