যুগসন্ধিক্ষণের বিস্মৃত শিল্পী রাজবালা

তিন ভাইবোন—মতিবালা, তিনকড়ি আর রাজবালা। উনিশ শতকের কলকাতায় ‘রূপোগাছি’ নামে পরিচিত রামবাগান এলাকার এক অসহায় বিধবা পুঁটিরানির সন্তান। মায়ের মৃত্যুর পর আশ্রয়ের জন্য ঘুরতে ঘুরতে তিনজনেই যোগ দিল এক সার্কাসের দলে। বাঙালির সার্কাস হিসেবে এ দলটি সেকালে বেশ সুনাম অর্জন করেছিল। নাম ‘দ্য গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস’, এর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালকমতিলাল বসু। তাঁর নাম অনুসারে ‘বোসে’স সার্কাস’ বলেও পরিচিত ছিল দলটি।   

 

কবি মনমোহন বসুর ছেলে মতিলাল বসু। উনিশ শতকের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত এই মানুষটির ধ্যানজ্ঞান ছিল সার্কাস। নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে খেলা দেখাত তাঁর দল। সার্কাসের জন্য মেয়ে খুঁজতে গিয়েই এগারো বছরের রাজবালার সঙ্গে তাঁর আলাপ। সার্কাসে ভারসাম্যের খেলা দেখিয়ে সবাইকে অবাক করে দিত সেই মেয়ে। যেমন সুন্দরী তেমনই খেলায় পারদর্শী। তার প্রতি এক অদ্ভুত আকর্ষণে জড়িয়ে পড়লেন চল্লিশ বছর বয়সী মতিলালসার্কাসের দল তখন উজ্জয়িনীতেসেখানে এক বাঙালি পুরোহিতের সাহায্যে, স্থানীয় মন্দিরে গিয়েবিয়ে করলেন রাজবালাকে। জন্ম নিল একটি কন্যাসন্তান। এই মেয়েই পরবর্তীকালের বিখ্যাত অভিনেত্রী-সঙ্গীতশিল্পী ইন্দুবালা দেবী। জন্ম হয়েছিল অমৃতসরে। নবজাত সন্তান নিয়ে সার্কাসের দলের সঙ্গে এখানে অখানে ঘুরে বেড়ানো এক সমস্যা, তাই স্ত্রী ও কন্যাকে মতিলাল রামবাগানে ২১ নম্বর দয়াল মিত্র লেন-এর একটি বাড়িতে রাখার ব্যবস্থা করলেন। সহৃদয় এক প্রতিবেশীর বাড়ি ছিল ২৪ নম্বরে। 

 

মতিলালের পরিবার কিন্তু তাঁর এই বিবাহ মেনে নেয়নি। ইন্দুবালার জন্মের পরেরাজবালা আর সার্কাসে ফিরতে চাননি। মতিলাল দলের সঙ্গে একাই ঘুরে বেড়াতেন, মাঝে মাঝে কলকাতায় আসতেন। সম্পর্কিত ভাই জীবনকৃষ্ণ ঘোষকে দায়িত্ব দেন তাঁর অনুপস্থিতিতে এই পরিবারের দেখাশোনা করার। এভাবে স্ত্রী-কন্যার ভরণপোষণের একটা ব্যবস্থা হলেও, মানসিক দূরত্ব আটকানো গেল না। দু-তিন বছরের মধ্যেই মতিলালও যেন রাজবালার প্রতি সব আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেন।রাজবালার সুখের সংসার বেশি দিন টিকল না এর পরে শুরু হয় রাজবালার জীবনসংগ্রাম। সেই সময় অভিভাবকের মত স্নেহে তাঁর পাশে থেকেছিলেন জীবনকৃষ্ণ ঘোষ। মতিলালঅবশ্য মেয়েকে স্নেহ করতেন, কলকাতায় এলে দেখাও করতেন। মেয়ের নামে টাকা পাঠানো বন্ধ করেন নি। মেয়ের জন্য তিনি যা দিতেন, রাজবালা তা অস্বীকার করেন নি, তবে ‘মতিবাবু’র পাঠানো টাকার ওপর নির্ভর করেও থাকে নি তাঁর প্রবল আত্মসম্মানবোধ। সন্তান-সহ নিজের প্রতিপালনের জন্য বেছে নিয়েছিলেন উপার্জনের স্বতন্ত্র পন্থা।   

                    

সংক্ষিপ্ত দাম্পত্য জীবনের মধ্যেও স্বামীর উৎসাহে সঙ্গীতচর্চা শুরু করেছিলেন রাজবালা শিখেছিলেন ধ্রুপদ অঙ্গের কিছু গান।এবার জীবনযুদ্ধে নেমে হাতিয়ার করলেন সঙ্গীতকেই। রামবাগানের দয়াল মিত্র লেন-এর বাড়িতে ওস্তাদ ডেকে এনে আরও গভীরভাবে গানের তালিম নিতে মন দিলেন রাজবালা। বাদ্যযন্ত্রে সঙ্গত করতে আসতেন সেকালের নামকরা পাখোয়াজ বাদক দুলী ভট্টাচার্য। পরবর্তীকালে যখন সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে তাঁর সুনাম ছড়িয়েছে, বাড়িতেই বসাতেন নিয়মিত গানের আসর। সেই আসরে আসতেন গোবিন্দপ্রসাদ মিশ্র, লছমীপ্রসাদ সিংহ, সাতকড়ি ওস্তাদ প্রমুখ সেকালের নামী সঙ্গীতজ্ঞরা।  

 

কয়েক বছর পর রাজবালা যোগ দিলেন পেশাদাররঙ্গমঞ্চে, অভিনেত্রীহিসেবে। গিরিশচন্দ্র ঘোষ তখন ‘শঙ্করাচার্য’(১৯০৯)নাটক লিখেছেন, প্রথমবার তা মঞ্চস্থ হয়েছিল মিনার্ভা থিয়েটারে। ‘চৈতন্যলীলা’র মত প্রবল উন্মাদনা সৃষ্টি করতে না পারলেও, এ নাটকটিও যথেষ্ট জনপ্রিয়তা ও সমাদর লাভ করেছিল‘বঙ্গবাসী’তে নাটকের সমালোচনায় বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছিল ‘জগন্নাথ’ ও ‘মহামায়া’ চরিত্রের উপস্থাপনা, আর এই মহামায়ার ভূমিকায় নেমেছিলেন রাজবালা। তাঁর অভিনীত দ্বিতীয় মঞ্চসফল নাটক ‘তপোবল’ (১৯১১), এটিও গিরিশচন্দ্রের রচনা--এখানে রাজবালা নেমেছিলেন‘অদৃশ্যন্তী’ চরিত্রেতাঁর অভিনয়-সাফল্যদেখে অন্যান্য দল থেকেও তাঁকে প্রস্তাব দেওয়া হয়, বিভিন্ন নাটকে অভিনয়ের জন্য ডাক পড়ত তাঁর। বিয়ের আগে, এমনকি সার্কাসে যোগ দেবার আগেও রাজবালা রামবাগানের একটি পালাগানের দলে অভিনয় করতেন। ছয় বছর বয়সে হরিদাসীর দলে ‘গঙ্গা আনয়ন পালা’য় ভগীরথের ভূমিকায় নেমেছিলাম। আর সার্কাসে খেলা দেখানোর সুবাদে নিজেকে শিল্পী হিসেবে জনসমক্ষে কীভাবে তুলে ধরতে হয়, সে বিষয়টিও তাঁর অজানা ছিল না। তাই পেশাদার মঞ্চের সঙ্গে মানিয়ে নিতে তাঁর অসুবিধা হয় নি। তবে মূলত সঙ্গীতশিল্পী হিসেবেই তাঁর সুনাম ছিল।     

 

রাজবালা প্রাথমিক ভাবে চেয়েছিলেন, মেয়ে পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখুক। তাই তাঁকে স্কুলে পড়তে পাঠিয়েছিলেন। সেকালের হিসেবে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছিলেন ইন্দুবালা। এরপর মেয়েকেতিনিপাঠিয়েছিলেন পটলডাঙার একটি হাসপাতালে, শিক্ষানবিশ নার্স হিসেবে। তবে এ কাজ ইন্দুবালার ভাল না লাগায় তিনি হাসপাতাল থেকে পালিয়ে আসেন,শেষপর্যন্ত গানকেই জীবিকা হিসেবে বেছে নেন। কয়েক বছর পর ইন্দুবালা নিজেকে সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলে, মা রাজবালা তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন আসরে যেতেন। মেয়ের সঙ্গীতজীবনকে এগিয়ে দিতে, তাঁর জন্য সময় ও সাহচর্য দিতে গিয়ে তিনি নিজে আস্তে আস্তে পেশাদার মঞ্চ থেকে সরে আসেন। প্রায় এগারো বছরপরে আবার ফিরে আসেন মঞ্চে, নিজের হাতে গড়া থিয়েটার দলের সূত্রে—অবশ্য এর মূল উদ্দেশ্য ছিল সমাজসেবা।

 

বিভিন্ন সামাজিক কাজকর্মেও নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন রাজবালা। ১৯২০ সালের বিধ্বংসী বন্যায় যখন বাংলাদেশ বিপর্যস্ত, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ এগিয়ে এসেছিলেন ত্রাণকাজে। সোনাগাছি, রূপোগাছির মত তথাকথিত ‘নিষিদ্ধ’ এলাকার মেয়েরাও স্বেচ্ছায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সেবাব্রতে দল বেঁধে রাস্তায় নেমে তাঁরা ত্রাণ সংগ্রহ করতেন।এই সময়ই অর্থসংগ্রহের জন্য রামবাগানের মেয়েরা গড়ে তোলেন ‘রামবাগান নারী সমিতি’, তার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন রাজবালা দেবী। এই সমিতির পক্ষ থেকে ‘বঙ্গীয় রিলিফ কমিটি’র পুরোধা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল চাল, জামাকাপড়, টাকা-সহ নানা রকম ত্রাণসামগ্রী। আরও অনেক সেবামূলক কাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল এই নারী সমিতি। ১৯২২ সালে উত্তরবঙ্গের বন্যাত্রাণের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে রাজবালার নেতৃত্বে তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন ‘কাঙ্গালিনী থিয়েটার’এই নাটকের দলের প্রথম অভিনয়-প্রয়াস ছিল ‘নরমেধ যজ্ঞ’। রাজবালা নিজে এ নাটকে ‘যযাতি’র ভূমিকায় নামতেন। সমকালীন ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় এই থিয়েটারের সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডের বিশেষ প্রশংসা করা হয়েছিল। কাঙ্গালিনী থিয়েটার ছিল ‘অ্যামেচার’ জাতীয়, কিন্তু এর সাফল্যে উৎসাহিত হয়েইরাজবালা গড়ে তোলেন পেশাদার নাট্যদল ‘দি ফিমেল কালী থিয়েটার’। ইন্দুবালার অভিনয়-জীবনের সূচনা এখান থেকেই।

 

১৯২২ সালে এই দলটির প্রতিষ্ঠা বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি ছিল সম্পূর্ণ মহিলা-অভিনীতনাট্যদল, এবং সেকালের কলকাতায় এর দ্বিতীয় উদাহরণ আর ছিল না। দানীবাবুর ছাত্র যোগীন্দ্রনাথ সরকার রাজবালাকে এই থিয়েটারের কাজে সাহায্য করেছিলেন, এবং অনেক সময় তাঁর নাম পরিচালক হিসেবে বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হত। তবে এর প্রাণকেন্দ্র ছিলেন রাজবালা দেবী, এবং কাজকর্মের দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নিতেন দলের মেয়েরাইএই থিয়েটারের মাধ্যমে কলকাতার পেশাদার রঙ্গমঞ্চে একই সঙ্গে মা ও মেয়ে বহুদিন একটানা অভিনয় করে গেছেন। দু বছরে মোট বারোটি নাটক এই দলের পক্ষ থেকে মঞ্চস্থ হয়। প্রত্যেকটি নাটকেই রাজবালা ও ইন্দুবালা একসঙ্গে অভিনয় করেছেন। দু বছর পর আর্থিক সঙ্গতির অভাবে দলটি উঠে যায়, কিন্তু রাজবালা এর পরেও অন্য দলে আমন্ত্রিত শিল্পী হিসেবে মঞ্চে নেমেছেন-- মডার্ন থিয়েটারের ‘রৈবতক’ নাটকে (১৯২৪), অ্যালফ্রেড হল-এ। এই নাটকে ‘সুলোচনা’র ভূমিকাতেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

 

চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন রাজবালা।১৯৩৫ সালে প্রযোজক বজরঙ্গলাল খেমকার অনুরোধে ‘রাতকানা’ নামে একটি দ্বিভাষিক ছবিতে তিনি অভিনয় করেন(হিন্দিতে ‘রাত আন্ধি’)ততদিনে ইন্দুবালা রীতিমত প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীতশিল্পী। তাই এ ছবিতে রাজবালার পরিচিতি ছিল ‘ইন্দুবালার মা’ হিসেবে। কাগজেও লেখা হয়, “কালো বউ-এর ভূমিকায় ইন্দুবালার মা ভাল।” ছবিটি সাফল্য পেলেও রাজবালা এর পর আর অভিনয়ে আগ্রহী হন নি। প্রকাশ্যে সঙ্গীত পরিবেশনও ছেড়ে দেন আস্তে আস্তে। পূর্বসূরি বিনোদিনী দাসীর মত শেষ বয়সে নিজেকে সরিয়ে নেন অন্তরালে। মেয়ের অভিভাবিকা হিসেবেই তাঁর সঙ্গে ছিলেন আমৃত্যু। বিরাশি বছর বয়সে একমাত্র কন্যা ইন্দুবালাকে একা ফেলে রেখে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন রাজবালা। তারিখটা ছিল বাংলা ১৩৭৫ সনের ২৭ ভাদ্র। শ্মশানযাত্রা থেকে ফিরে, পরের দিন ইন্দুবালা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে মায়ের স্মৃতিতর্পণ করেছিলেন স্বরচিত একটি কবিতার মাধ্যমে—“আকাশে তখন নক্ষত্রেরা/ নিস্তব্ধ শিশির লগ্নে/ আঁখিতে অশ্রুর স্রোত বয়/ বিষণ্ণ পথটি এসে/ শেষ হয় নিদ্রিত শ্মশানে।... তুলে ধরি তাপপ্রসূঅগ্নিশিখা/ জননীর মুখে।”

 

অল্পবয়সেই পালাগানের দলে অভিনয় করতে করতে দ্য গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসের বিস্ময় বালিকা হয়ে উঠেছিলেন যে রাজবালা, সুখী দাম্পত্যের স্বপ্ন ভেঙে যাবার পরেও যিনি নিজের পথ নিজে তৈরি করে নিয়েছেন মঞ্চাভিনেত্রী ও গায়িকা হিসেবে, তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এভাবেই অনাড়ম্বরে শেষ হয়েছিল একটি যুগসন্ধির ইতিহাসআজ তাঁর অবদানের কথা প্রায় বিস্মৃতউনিশ শতকের যাত্রাপালা আর গিরিশ-যুগের মঞ্চনাটকের শেষ দিককার প্রতিনিধি তিনি, আবার বিশ শতকের ত্রিশের দশক থেকে নতুন পথে বাঁক নিতে থাকা নাটক-সঙ্গীত-চলচ্চিত্র জগতেরও সাক্ষী। গভীর যত্ন ও আত্মত্যাগে তিনিই তৈরি করে দিয়েছিলেন কন্যা ইন্দুবালাকে, পরবর্তী প্রজন্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পী-অভিনেত্রীকে তাঁর হাত থেকেই গ্রহণ করেছিল বাঙালির সংস্কৃতি-জগৎ।

 

তথ্যসূত্রঃ  ইন্দুবালার স্মৃতিকথা, ‘ইন্দুবালা’- ডঃ বাঁধন সেনগুপ্ত 

 

  • পৃথা কুণ্ডু