বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের তান্ত্রিকদের বিচিত্র কাহিনী : কয়েকটি কথা

সৌরীন্দ্রমোহন তান্ত্রিকের অলৌকিক শক্তি প্রসঙ্গে ‘শুকদেও স্বামী’র গল্প শুনিয়েছেন। যোগীর যোগবলের এই কাহিনিতে শুকদেওয়ের সঙ্গে  গল্পকথকের বাসকালীন অভিজ্ঞতার কথা উঠে এসেছে। গল্পকথক স্বচক্ষে দেখেছেন যে সাধু কোথাও না গিয়েও টাট্‌কা ফল, মিষ্টি যোগাড় করেন বা হেঁটে নদী পার হন। তাঁকে একই সময়ে প্রয়াগে স্নান করতে দেখা যায়, আবার সুদূর বাংলার ঘরেও তিনি কথকের সঙ্গে থাকেন। এই ক্ষমতাবান সাধু কীসের সন্ধানে ও প্রত্যাশায় একলা চলার জীবনকে অঙ্গীকার করেছেন তা ভেবে কথক বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে যান। ‘তন্ত্রশক্তি’ গল্পে রাজশাহীতে জমিদারী সংক্রান্ত মামলায় ব্রজেন্দ্রচন্দ্র শীল ডিস্ট্রিক্ট ও সেশন্স জজ ছিলেন। তাঁর প্রদত্ত রায় হাইকোর্টে বহাল থাকে। বিচারের দিন সকালে তাঁর লনে পাতা তক্তায় পাঁচটা মড়ার মাথা আর হাড় দেখেন। এই ঘটনা রায়দানের সময় তাঁর বিবেচনায় সহায়তা করেছে। এই ‘সত্যদর্শন’-এর পিছনে তন্ত্রশাস্ত্রের ক্রিয়াকলাপের কথা গল্পে ব্যক্ত হয়েছে। বিজয়ীপক্ষের উকিলের থেকে জানা যায় যে মক্কেলরা সুবিচারের জন্যে তান্ত্রিককে দিয়ে যাগযজ্ঞ করেছিল।

সিদ্ধপুরুষ’ গল্পে ভারতের সাধুসন্তের অলৌকিক মহিমা প্রকাশ পেয়েছে। ব্রিটিশ আমলে ইঞ্জিনিয়ার দুর্গাচরণ চক্রবর্তীর উপরহরিদ্বার-কনখল স্টেট রেলওয়ে নির্মাণের দায়িত্ব পড়ে। একদিন তিনি পরীক্ষার কাজের শেষে নদীর ওপাড়ে হিমালয়ে সাধুর দেখা পেতে চান। সাধুর দেখা পান। সাধু তাঁকে গৃহীর দায়িত্ব পালন করতে বলেন। গায়ত্রীর অর্থ বুঝিয়ে দিয়ে ধ্যানে ইষ্টদেবকে দেখিয়ে দেন। সাধু ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন যে কুম্ভমেলায় আবার তাঁদের দেখা হবে। গল্পে কুম্ভমেলার একটি সুন্দর রেখাচিত্র উপস্থাপিত হয়েছে। কুম্ভমেলায় নাগা সন্ন্যাসীদের বস্ত্রহীনতার উপর ব্রিটিশ সরকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও পরে রাসবিহারী শেঠের উদ্যোগে তা উঠে যায়। নাগা সন্ন্যাসী এবং সন্ন্যাসিনীরা চলার পথে যে কথা বলতে বলতে চলেছেন তার মধ্যে ভারতবর্ষের গুহ্যসাধনা ধারার ইঙ্গিত রয়েছে – “যে-অঙ্গ তোমরা বস্ত্রাবরণে আচ্ছাদিত করে রাখো, যে-অঙ্গকে তোমরা জানো শুধু সম্ভোগের যন্ত্রস্বরূপ... সেভাবে আমরা সে-অঙ্গ দেখি না। পুরুষাঙ্গ আমরা দেখি নেতি ধৌতির জন্য পিচকারী স্বরূপ... স্ত্রী-অঙ্গ লজ্জার বস্তু নয় – স্ত্রী-অঙ্গ হলো মানুষের মাতৃস্থানীয়া ব্রহ্মযোনি... পূজার শ্রদ্ধার সামগ্রী!” কুম্ভমেলায় দেখা হওয়ার পরে সাধু যা বলেছিলেন তা উদ্ধারযোগ্য – “আমাদের দেশের তন্ত্রমন্ত্র আজ কতকগুলো স্বার্থান্বেষী। অনাচারীর হাতে পড়ে বুজরুকিতে দাঁড়িয়েছে। দেশের যাঁরা সুসস্তান, তাদের কর্তব্য এ-শাস্ত্রের নিগূঢ় মৰ্ম্ম বুঝে চলা... তা চলতে পারলে ভারতের এবং জাতির দুঃখের অবসান হবে।... বিশ্বাস হলো তো তন্ত্রের শক্তিতে? আমি তোমাকে এখানে এনেছি এবং এক বছর পূর্ব্বে বলেছিলুম, আবার দেখা হবে এবং দেখা হবে প্রয়াগে। এ-কথা বলেছিলুম, তার কারণ তান্ত্রিকের চোখে ভবিষ্যৎ অদৃশ্য থাকে না।” ‘ভবিষ্যৎ কথা’ গল্পে রায়সাহেব দুর্গাচরণ চক্রবর্তীর দক্ষিণ ভারতের ভিনেডেলি জেলায় যে ইন্ডিয়ান অয়াকাডেমি অফ সায়েন্স আছে, তার সভাপতি ছিলেন ডক্টর রামস্বামী ডি-এস-সি। এই সমিতির মুখপত্র সেল্ফ কালচার-এ ভেঙ্কটরত্নম নামে এক ভদ্রলোক এক সাধুর অলৌকিক শক্তির যে-বিবরণ দিয়েছেন, তা প্রণিধানযোগ্য।

রায়সাহেব দুর্গাচরণ চক্রবর্তীর পরলোকতত্ত্ব বা অলৌকিক বিষয়ে অনুরাগ ও শ্রদ্ধা রয়েছে। তার জীবনের একটা অদ্ভুত কাহিনি ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে ঘটেছিল। তিনি মতিহারীতে গ্রামের খাল সংস্কারের কাজ করেন। একদিন এক সাধুর কথামতো গ্রামের জলের ব্যবস্থার উদ্যোগ নেন। দুর্গাচরণের চোদ্দ দিনের মধ্যে চাকরির পদোন্নতি সম্ভব বলে সাদু জানান। কিন্তু সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরে সাধুর সঙ্গে দেখে হলে তিনি পদোন্নতি হয়নি বলে জানান। পরে জানতে পারেন যে সাধুর ভবিষ্যত বাণীর সময়কালেই কাল হলেও খবর তাঁর কাছে দেরিতে পৌঁছেছে – ‘ভবিষ্যৎ কথা’ গল্পে তাই রয়েছে। ‘পিল্লি’ সিংহল দ্বীপের কাহিনি। তন্ত্রমন্ত্র করা মাদুলির ধারণের ফলে অশুভ-অমঙ্গল দূরীভূত হয়। সিংহলের পিল্লি সাধনার প্রসঙ্গে কথক চব্বিশ পরগণার গ্রামের কাহিনি বলেছেন। পিল্লি হল নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে শত্রুর প্রাণনাশের করে ভূত নিয়োগ। শত্রুর প্রাণনাশ নির্দিষ্ট সময়ে করা সম্ভবপর না হলে তা নিয়োগকারীর উপর বর্তায়। এই গল্প তার ব্যতিক্রম নয়। ‘তান্ত্রিক সুরেন্দ্রনাথ’ গল্পে তন্ত্রাদি বাণ মারা, নল চালা, ভূত তাড়ানোয় গুণী ওস্তাদ ওঝার কথা পাই। এ বাড়ি, ও বাড়ি চাল-ডাল চেয়ে নেওয়া কঙ্কালসার বৃদ্ধার ভূত কেন ঘাড়ে চেপেছে? তার উত্তরে জানা যায় – “লুচি খাব, ঘি-দুধ খাব সেই লোভ!” কাহিনির কারুণ্য পাঠকের মনকে স্পর্শ করে।

 

(চলবে)

  • সুমিত বড়ুয়া
  • পর্ব তিন