ডিহি কলকাতার দিননামা

কেচ্ছার গল্পের গন্ধে কানাই উৎকর্ণ হয়ে বসে। বলে কি রকম কেচ্ছার কিসসা শুনি। বলো একটু।

এই সময় জটাকেশ ছিদামের ঘরে ঢোকে। বলে ছিলাম তোমার উনুনে একটু আগুন হবে নাকি?

ছিদাম উনুনের আজ তখনো ফেলেনি। কাঠের আগুনের আজ ধিকি ধিকি জ্বলছে।

ছিদাম সেদিকে ইঙ্গিত করতে,

একটা কাঠের ছিলকায় আগুন ধরিয়ে নিয়ে জটাকেশ আফিমের একটা কালো দলা একঝলক জ্বালিয়ে নেয়। তারপর সেটা চেটোয় ফেলে  পিষতে থাকে।

অতঃপর ছোট কলকের মধ্যে তামাকের সঙ্গে ঠাসতে ঠাসতে বলে, বড় খাসা জিনিস হে। একেবারে দেব ভোগ্য। বন্দরে এসেছে। চীনে চালান যাবে। সরেশ মালের খবর পেয়ে সেখান থেকেই এট্টুখানি জোগাড় করেছি।

ছিদাম জানে, কোম্পানির লোকজন এখন কাপড় ,লবনের মতো আফিমের কারবারও শুরু করেছে। আগে ডাচরা এই কারবারে প্রায় একচেটিয়া ছিল।

কিন্তু কোম্পানির আমল শুরু হওয়ার পর দ্রুত ব্রিটিশ গোরারা এই কারবার হাত করে নিয়েছে।

দেশি অনেক কারবারি মানুষ চিনে আফিম চালানের ব্যবসায় ব্রিটিশদের সঙ্গে মিলেমিশে ফুলে ফেঁপে ঢোল হয়ে যাচ্ছে।

জটাকেশ  কলকেতে দুটান দেওয়ার পর বলে,

তা কিসের কথা হচ্ছিল?

ছিদাম বলে, আরে ওই কালী প্রসাদি হাঙ্গামার কথা বলছিলাম।

জটাকেশ আফিমের ধোঁয়া বুকের মধ্যে নিয়ে দম ধরে বসে ছিল। এবার লম্বা করে ছোড়া ছেড়ে দেওয়ার পর বলে, আরে সে এক মহা কেলেঙ্কারি কান্ড।

শোভাবাজারের রাজা নব কেষ্টর নাম তো শুনেছ। কলকাতায় দোল দুর্গোৎসবের প্রচলন করেচে কার্যত এই নব কেষ্ট।

লর্ড  ক্লাইভ ওয়ারেন হেস্টিংস এরকম কোম্পানির বড় বড় মাথা নবকেষ্টর বাড়িতে দুর্গাপূজায় ভোজ খেতে , নাচ দেখতে আসে।

এখন এই নব কে স্টোর বাড়ির থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে কলকাতার আরেক বড় মানুষ চুড়ামণি দত্তের বাড়ি। দুজনে প্রতিবেশী হলে কি হবে আকচা আকচির শেষ ছিল না। জমি নিয়ে মামলা মোকদ্দমা সুপ্রিম কোর্ট অব্দি করিয়েছিল। তাতে নব কেষ্টর হার হয়। চূড়ামনি জেতে। এই অব্দি বলে জটাকে একটু দম নিয়ে লম্বা করে কলকাতা টান দেয়। তারপর ফের বলতে শুরু করে।

এখন এই চুড়ামণি দত্তের ছেলে কালীপ্রসাদ এক মোচলমান মাগী আনোরাকে  নিয়ে  বেলেঘাটার দিকে চূড়ামণি দত্তের বাগানবাড়িতে থাকতে শুরু করে।

নিয়ে সমাজে বিস্তর কথাবার্তা হলেও কালীপ্রসাদ কোন কিছুতেই পাত্তা দেয়নি।

এবার চূড়ামণি দত্ত মারা যাওয়ার সময় অন্তর্জলি যাত্রায় যায়। অন্তর্জলী যাত্রার সময়ও চুড়ামণি নবকেস্টর সঙ্গে আকচা আকচি কমায় নি। নব কেষ্ট রাজবাড়ির সামনে দিয়ে চূড়ামনি অন্তর্জলী যাত্রা নিয়ে যায়। সেই যাত্রায় ঢাক ঢোলের সঙ্গে তারস্বরে গান হচ্ছিল ,

জপতপ করিলে কি হয়

 মরিতে জানিতে হয়

যম জিনিতে যায় রে চূড়া

যম জিনিতে যায়।

শোভাবাজারের রাজবাড়ির সামনে  অন্তর্জলী যাত্রার ঢাক ঢোল এত জোরে বেজেছিলো যে স্বয়ং মহারাজ নবকৃষ্ণ বাড়ির ছাদে উঠে আসেন কি হয়েছে দেখতে।

সেই সময় চূড়ামনি দত্ত নাকি শুয়ে শুয়েই নবকৃষ্ণের দিকে হাত নেড়েছিলো।

সে যাই হোক চূড়ামুনি দত্ত তো অন্তর্জলী যাত্রায় প্রাণ ত্যাগ কল্লে। কিন্তু এইবার নবকৃষ্ণ সুযোগ বুঝে আসরে নামলে।

কলকাতার সমস্ত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের রাজা নব কৃষ্ণ বলে দিলো,যবন মেয়ে মানুষের সঙ্গে ঘর করে কালীপ্রসাদ জাতিচ্যুত হয়েছে। কলকাতার কোন ব্রাহ্মণ যেন কালীপ্রসাদের পিতৃদায় উদ্ধারের কাজে না যায়।

এবার তো কালী প্রসাদ পড়লো মহা মুশকিলে।

ব্রাহ্মণ না এলে তো পিতৃ দায় উদ্ধার সম্ভব না। কালীপ্রসাদ কলকাতার অনেক মুরুব্বী কে ধরলো। কিন্তু নব কেষ্টর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে কেউ সাহস পেল না।

শেষ পর্যন্ত বরিষার সাবর্ণ চৌধুরীদের পরিবারের  কর্তা

সন্তোষ রায়চৌধুরী বড়িশা থেকে ব্রাহ্মণ নিয়ে এসে কালীপ্রসাদের পিতৃদায় উদ্ধার করলেন। এই সাবর্ণরা শোভাবাজার এর রাজ বাড়িকে খুব একটা পাত্তা দেয় না। কারণ ওরা বনেদি জমিদার। কোম্পানি প্রথমে এদের কাছ থেকেই ডিহি কলকাতা সুতানুটি গোবিন্দপুরের ইজারা নিয়েছিল।

শ্রাদ্ধাদি শেষে কৃতজ্ঞ কালীপ্রসাদ ব্রাহ্মণ বিদায়ের জন্য সন্তোষ রায়চৌধুরীকে নগদ ২৫ হাজার টাকা দেয়। সঙ্গে আসা সব ব্রাহ্মণদের প্রাপ্য বিদায়ী  সন্তোষ নিজে মিটিয়ে দিয়ে এই ২৫ হাজার টাকা পুরোটাই কালীঘাটের মন্দির সংস্কারের জন্য কাজে লাগান। সেই টাকাতে মন্দির সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে মন্দির সংস্কারের কাজ শেষ হতে আরো কয়েক বছর লাগবে।

জটাকেশের আখ্যান শেষ হতে ছিদাম বলে, এবার তাহলে বুঝতে পারলে কালীঘাট মন্দিরের সংস্কারের সঙ্গে হাঙ্গামার যোগ কোথায়?

কানাই মন দিয়ে পুরো আখ্যানটা শুনছিল। এবার উঠে পরে বলে

ভাইটি এবার তো যাওয়ার উদ্যোগ করতে হয়। নৌকা ছাড়তে হবে। আচ্ছা আদি গঙ্গায় জলের অবস্থা এখন কেমন? এদিকটায় অনেকদিন আসিনি।

শুনছিলাম খালেরও নাকি সংস্কার হয়েছে।

ছিদাম বলে, সে তো এক এলাহি কারবার হয়েছে। টলি বলে এক ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে পুরো আদি গঙ্গার খাল সংস্কার করেছে। সোঁদরবন থেকে এখন তারদা বন্দর হয়ে বিদ্যাধরী হয়ে সোজাসুজি ওই খাল ধরে

বড় জাহাজ নৌকার সব কলকাতায় ঢুকছে। লোকো মুখে আদি গঙ্গার এখন নামই হয়ে গেছে সাহেবের নামে" টলির নালা।"আদি গঙ্গার খাত দিয়ে এখন যা নৌকা জাহাজ আসে তার সব ট্যাক্সো এখন ওই টলি সাহেবের প্রাপ্য। আর কোম্পানি টলি সাহেবকে বাজার বসানোর জন্য একটা জায়গা দিয়েছে।

সেখানে নতুন গঞ্জ গড়ে উঠেছে।

তার নাম   হয়ে গিয়েছে টালিগঞ্জ। মানে কিনা টলি সাহেবের গঞ্জ।

কানাই বলে, বাপরে। কলকাতায় নতুন নতুন কত কি ঘটছে।

জটাকেশ এবার উঠে দাঁড়ায়।

তার বাহুর উপর দাঁড় কাকের একটা উল্কি কানাইয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিছু একটা জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও কানাই চুপ করে যায়।

  • সুমিত চৌধুরী
  • পর্ব ৩