"কুসুমে কুসুমে চরণচিহ্ন"

একাডেমি অফ ফাইন আর্টসে একটা প্রদর্শনী --
 
আয়োজক পেট্রিকর(Petrichor,ইংরেজি শব্দ)অর্থাৎ ; বৃষ্টির পরের মাটি ইত্যাদির সোঁদা মিষ্টি গন্ধ।
প্রদর্শনীর শিরোনাম "আমার রবীন্দ্রনাথ"

 
একুশে শ্রাবণ সন্ধ্যায় উদ্বোধন হলো।
ক্যাটালগের শুরুতে  শান্তিনিকেতন কলা ভবনের প্রাক্তন অবেক্ষক সুশোভন অধিকারী রবীন্দ্রনাথের শিল্পচর্চার "মিশ্র-মাধ্যম" বা মিক্সড মিডিয়া(mixed media) প্রসঙ্গটি নিয়ে আলোচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ভারতে তো বটেই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও প্রথমদিকের শিল্পী যাঁরা নির্দ্বিধায় মিশ্র মাধ্যমে ছবি এঁকেছেন। আর ও বড় প্রেক্ষাপটে দেখলে রবীন্দ্রনাথের বাকি কর্মকাণ্ডের মধ্যেও আজ যাকে বলে ইন্টারডিসিপ্লিনারি(inter-disciplinary) সেই পদ্ধতি ও উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়। আমরা এও দেখতে পারি যে ,প্রতিষ্ঠান , যথা-- স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তার বাইরের অপ্রতিষ্ঠিত মানুষের বিচ্ছেদ রবীন্দ্রনাথকে ভাবিয়েছিল এবং তিনি সাহিত্য থেকে বিশ্বভারতী সর্বত্র যা কিছু স্থবির প্রতিষ্ঠিত তার বিরুদ্ধে বৈচিত্রময় প্রাণশক্তির পক্ষে সোচ্চার ছিলেন।
আমাদের শিক্ষিত লোকে যে হাতে পায়ে নিতান্ত অকর্মণ্য অন্যদিকে যে খেটে খাওয়া লোকের শ্রমের উপর গোটা সমাজ প্রতিষ্ঠিত তার ভাগে শিক্ষা নেই এই বাস্তবকে রবীন্দ্রনাথ প্রথম জোরালোভাবে বর্ণনা করেন। শিক্ষা ও শ্রমের দূরত্ব ঘোচানোর চেষ্টা তাঁর জীবনের এক প্রধান কর্ম। সেদিক দিয়ে আলোচ্য প্রদর্শনীটি  সার্থক। এখানে কলাভবন বা কলকাতার শিল্প বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত শিল্পীর সঙ্গে স্বশিক্ষিত শিল্পী আছেন। পেশাদার শিল্পীরও নানা ধরন।তাঁরা আছেন আবার আছেন ডাক্তারির মতো পেশায় নিযুক্ত শিল্পী। প্রদর্শিত ছবি আর মূর্তি ভাস্কর্যের মধ্যেও বৈচিত্র ।মাধ্যমগত, বিষয়গত ও মানগত। এক একজন শিল্পীর চাহিদা, শিল্পবোধ, কাজের সঙ্গে সম্পর্ক এক এক রকম। এক একজন রবীন্দ্রনাথকে এক এক রকম ভাবে অনুভব করেন।কাজে তা প্রস্ফুটিত। কোন গান বা নৃত্যনাট্য নিয়ে কারুর কাজ।কেউ অন্য কোন দিক নিয়ে ভেবেছেন। 
নিতাই সামন্ত আর সমর রায়ের পপুলার(pop), জনপ্রিয় ঘরোয়া ইমেজারি(imagery) বা চেহারা যেমন সস্তা ক্যালেন্ডারের ছবি, প্রিন্ট, সিনেমার পোস্টারের রেফারেন্স (স্মৃতি-উদাহরণ)মনে আসতে পারে।
আরেকরকম ভাষ্যে তথাকথিত উত্তরাধুনিক পদ্ধতিতে ছবি করেছেন সন্দীপ সরকার। তাঁর চিত্রাঙ্গদা সংক্রান্ত ছবিতে অবলীলায় বাক্য আসে।আসে আজকে দেশে বিদেশে চলা প্রাইড(PRIDE) ,লিঙ্গ-সাম্য আন্দোলন।আরেকটি ছোট কাজে বিসর্জন নাটক নিয়ে রূপায়নে নিয়ে আসছেন দেবনাগরী লিপিতে লেখা "জয় কালী কলকাত্তাওয়ালী"। "বিসর্জন" নাটক আর মা কালীর দ্বন্দ্ব নিয়ে খুব বেশি কেউ আলোচনা করেন না।দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস বাংলা ভাষা বিশেষত রামপ্রসাদ সংক্রান্ত আলোচনায় প্রাসঙ্গিক তাত্ত্বিক মতামত রেখেছিলেন।সম্ভবত চিত্তরঞ্জনের সে লেখা বর্তমানে ছাপা নেই।সন্দীপ তাঁর ছবিতে একটি পাঠ নির্মাণ করেছেন। কাজগুলো মিশ্র মাধ্যম। 
               চিত্রাঙ্গদা নিয়ে চন্দন কর্মকারের একটি ছবি আছে।চন্দন জল রঙে কাজ করেছেন কাগজে ও কাপড়ে।"ভারত শিল্প" বা "বেঙ্গল স্কুল" নামগুলোর সঙ্গে সাধারণ শিল্প রসিক মহলে যে স্টাইল পরিচিত চন্দনের ছবিতে তার ছাপ আছে।
 
 
              মিশ্র মাধ্যমে করা নীল কালো আর সাদা, লালটু বোসের "চাঁদ উঠেছিল গগনে" সিরিজ স্বল্প আকার আর তাদের টানাপোড়েনে নৈশবর্ণনার মধ্যে রহস্যময়তা সৃষ্টি করে। টিউকল আর চাঁদ নিয়ে ছবিটি আমার বিশেষভাবে ভালো লাগলো।শিল্প ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে যোগেন চৌধুরীর "চাঁদনী রাতে বাঘ" আর গণেশ পাইনের শৈলীর কথা দর্শকের মনে আসতে পারে। 
               আত্মদীপ ভট্টাচার্য ক্যানভাসে এক্রিলিক দিয়ে এঁকেছেন।তাঁর কাজ আলঙ্কাকারিক। মানুষ না এঁকেও মানবিক বেদনা মূল্যবোধ মঙ্গল কামনা তাঁর জ্যামিতিক ও সহজ আকার ও বর্ণবিন্যাসে ফুটে ওঠে।
        আপাত বিপরীত অথচ সহমর্মী ব্যঞ্জনা পেলাম সৌভিক শীলের তেল প্যাস্টেলে করা কাজ গুলিতে। দু তিনটে রঙের প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথের সাদায় করা মার্বেল বা সিমেন্টের মূর্তির নৈর্ব্যক্তিকতা দৃশ্যত আকর্ষণীয়। 
            জিৎ গাঙ্গুলী ছবির এলাকা বিন্যাস বা স্পেস ডিলিং(space dealing) নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। এক্রিলিকে করা ক্যানভাস আর নিজে তৈরি করা কাগজে। কাগজের টুকরো ত্রিভুজাকৃতি কাঠের ফ্রেমে নির্মাণ করে ছবির চারকোনা অভ্যাসকে নাড়িয়ে দেওয়ার ফরমাল বা আঙ্গিক গত কর্মটি সে ছবির বিষয়ের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু ও তৎপরবর্তী কালেই রবীন্দ্র পাঠক বা রবীন্দ্রভক্ত মহল ও তার প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থা শিল্পীর বিষয়। মুন্সিয়ানার সঙ্গে চারকোনা ক্যানভাসের কাজটিতে ব্যবহার হয়েছে গোল্ডেন রেশিও(golden ratio)। রবীন্দ্র মূর্তি আর রবীন্দ্রনাথের মৃতদেহ এই দুই প্রসঙ্গে ইতিহাসের সাক্ষ্য দ্বন্দ্বময়।শ্রদ্ধা ও অধিগ্রহণ এর উন্মাদনা জিতের আপাত শান্ত রচনার মধ্যে ক্রেন অথবা কাপড় জড়ানো বাঁধা মৃতদেহের উপাদানে অস্বস্তির অনুরণন তৈরি করতে সক্ষম। 
              স্বাতী মুখার্জি ধাতু আর ফাইবার গ্লাস দিয়ে ভাস্কর্য করেছেন।এক একটি কাজ একেকটি রবীন্দ্র বাক্য বা গানের অনুসঙ্গে।এক একটি কাজ পরিপূর্ণ মনোযোগ ও নিবিড় ব্যক্তিগত অনুভূতির পরিচায়ক।পথকে কোথাও অন্তহীন বিমূর্ত রূপায়নে ধাতব পাতে পুষ্প সদৃশ্য বিন্যাসে ধরা কোথাও সোনার হরিণ পিতলের আলংকারিক আকারে পরিস্ফুট। সেখানে বিমূর্তায়ন করছে সর্পিল প্যাঁচ এর মধ্যে। নিজেদের ভেতর থেকেই যেন বেরিয়ে আসছে আমাদের বাইরের আকর্ষণের চাহিদা যাচঞা বা বাঞ্ছা। স্বাতীর কাজে শিশুদের উপস্থিতি ভালো লাগলো। রবীন্দ্রনাথকে শিশুরা সত্য সত্যই নিজেদের লোক বলে বিশ্বাস করে সে নানা সময় দেখেছি। স্বাতী রবীন্দ্রনাথের "আমার সকল রসের ধারা" গানটিকে ঠাকুমা দিদিমার মনে নাতি-নাতনী পুতনির প্রতি উথলে ওঠা স্নেহ রসের মূর্তিতে রূপায়িত করেছেন আবার রঙিন ফাইবার দিয়ে সৃষ্টি করেছেন রাস্তা গাড়ির চাকার সঙ্গে কুকুরছানাদের জীবন মরণ খেলার আবহাওয়া।
         সবশেষে বলব , প্রভাত বাগদির কাজের কথা।ভালো শিল্পী অনেক সময় দেখা যায় ছোট্ট পরিসরে স্বল্প আয়াসের পরিচয়ে রসসৃষ্টি করেন।পাথর আর ধাতুর যুগল উদ্ভিদের বীজ অথবা ডিমের মতো নিটোল হয়ে উঠতে যে অধ্যবসায় আর অভিজ্ঞতা লাগে তা প্রভাতের কাজে  বাঙ্ময়। ছোট ছোট ধাতুর মূর্তি গড়েছেন শিল্পী।রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যর বিভিন্ন চরিত্র নিয়ে। পাতগুলিতে মোমের প্রাথমিক গড়নের পেলবতা অর্থাৎ শিল্পীর স্পর্শ রয়ে গেছে। আকার প্রকারে চরিত্রর বেশভূষার ছলে রবীন্দ্র নৃত্য ও মনিপুরী নৃত্যর ছায়া। 
 
সব মিলিয়ে প্রদর্শনীটির বর্ণিকাভঙ্গ বা স্পেকট্রাম(spectrum)থেকে আজকের পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীদের দৃশ্যকল্পনার কয়েকটি দিক দেখতে পাওয়া গেল। তাঁদের কাঙ্ক্ষিত দর্শকও এই আশেপাশের মানুষ আর অবশ্যই দূরের রসিকজনও নিশ্চিত।
তাই পেট্রিকর নামটি সার্থক। কোন বিচ্ছিন্ন সাংস্কৃতিক ভাবভঙ্গী বা স্টেটাস(status)পিয়াস নয়,উল্লম্ব উচ্চাশার আভরণ নয়, প্রদর্শনীর মূল সুর সহজিয়া,উপভোগ্য অথচ গভীর অনুভূতিপ্রবণ।

  • তওফিক রিয়াজ
  • পেট্রিকর(Petrichor)এর প্রদর্শনী