এক বই পাগল রাজনীতিক

 
হস্ক্রত সৈয়দ মুজতবা আলীর আপ্তবাক্য ,বই কিনলে কেউ দেউলিয়া হয় না-- কেই বই থাকলে কেউ মন খারাপে ভেঙে পড়ে না-- করে নিয়েছিলেন বুদ্ধদেববাবু
 
 
একজন আপাদমস্তক রাজনীতির মানুষ কিন্তু কেবল বাংলা কবিতাই নয়, দেশ বিদেশের নানা ভাষার সাহিত্যের হাল হকিকৎতের সবটুকু খবর রাখেন-- নেহরুর সাংস্কৃতিক  ঘরানার এই শেষ ব্যক্তিত্বটি চলে যাওয়ার পর কেবল এটাই মনে হচ্ছে; গোধুলি গগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা।
তিনি থাকলে তীব্র আপত্তি করতেন , বিরক্ত হতেন নেহরু কেন্দ্রিক বিভাসার সঙ্গে তাঁকে তুলনা করা হচ্ছে দেখে।কিন্তু তিনিই ,' জেন্টল কলোসাসে' র লেখক হীরেনবাবুকে এতটা সম্মান , মর্যাদা দিয়েছিলেন, যেটা হয়ত হীরেনবাবুর দল তাঁকে কখনো দেয় নি।
তাইই হয়ত তাঁর চলে যাওয়াটা ,তাঁর অতি আপনজনের চলে যাওয়ার সেই বাইশে শ্রাবণের ঠিক পরের দিন, তেইশে শ্রাবণ ই হলো। আমাদের অন্তরাত্মা তাই বলছে, হায় একী সমাপন , অমৃতপাত্র ভাঙিলি , করিলি মৃত্যুরে সমর্পণ-- 
রাজনীতিক মানুষ, তাঁরা  রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে এতটাই আকীর্ণ হয়ে পড়েন যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অন্য পরিমন্ডলের সঙ্গে খানিকটা বাধ্য হয়েই তাঁদের সংযোগটা ক্ষীণ করে ফেলতে হয়। তার বিপরীত ও হতে পারে।অন্য পরিমন্ডলকে অত্যাধিক গুরুত্ব দিতে গিয়ে রাজনীতির পরিমণ্ডলটা হয়ে ওঠে খানিকটা গুরুত্বহীন। 
আসলে একটা মানুষ একইসঙ্গে দুটি বিপরীতমুখী পরিমণ্ডলের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পৃক্ত থাকা-- এটা খুব কঠিন বিষয় ।এই বিষয়ের মধ্যে দিয়ে যাঁরা নিজেদের যাপনচিত্রকে পরিচালিত না করেন ,তাঁদের পক্ষে এটা বুঝে ওঠাটাও বেশ কঠিন হয়ে ওঠে। সাধারণভাবে আমাদের মনে হতেই পারে ,একজন মানুষ, যিনি রাজনীতি করছেন, রাজনীতি সূত্রেই প্রশাসনের সঙ্গে তাঁর একটা সম্পর্ক রয়েছে। এমনকি প্রশাসনের শীর্ষ পদে তিনি আসীন রয়েছেন। সেই ব্যক্তিটির পক্ষে সাহিত্য সংস্কৃতির পরিমণ্ডল ,তার সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সম্পৃক্ত থাকা কিভাবে সম্ভব? 
বুদ্ধদেববাবুর অত্যন্ত পছন্দের মানুষ ছিলেন তাঁর দলেরই প্রয়াত এক বিশিষ্ট্য নেতা অমিতাভ বসু। পছন্দের মানুষ কেবল যে রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে থেকেই হয় ,তেমনটা বোধহয় সব সময় সঠিক নয় ।রাজনৈতিক আঙ্গিকের পছন্দ বুদ্ধদেব বাবুর কাছে অনেকখানি বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতো,  সংশ্লিষ্ট মানুষটির সাহিত্য সংস্কৃতি জনিত পছন্দ অপছন্দের নিরিখে ।অনেকেই যেমন বলেন , পরিপূর্ণ রাজনীতির অঙ্গনে না এসে বুদ্ধদেব বাবু যদি অধ্যাপনার জগতে যেতেন বা সম্পূর্ণ সময়ের লেখক হতেন, হয়তো বা ভালো হতো। তেমন কথাই যাঁরা অমিতাভ  বাবুর মত মানুষকে কাছ থেকে দেখেছিলেন, বসু সম্পর্কে সেই রকম ধারণা তাঁদের মধ্যেও আছে।
বুদ্ধদেব বাবুর অন্যতম প্রিয় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ছিলেন অমিতাভ বসুর অন্তরঙ্গ বন্ধু । এই অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বের পরিমণ্ডল ই  একদিন শক্তির সেই কালজয়ী  কবিতা হৃদয়পুর লেখবার প্রেক্ষিত তৈরি করেছিল। হৃদয়পুর কবিতাটি লেখবার সময় অমিতাভও, যাঁকে শক্তি তাঁর ডাকনাম 'সোমনাথ' বলে ডাকতেন, তিনি ছিলেন গোটা কর্মকাণ্ডের সাক্ষী। অথচ শক্তির কর্মকাণ্ড বলতে যে প্রেক্ষিতের কথা তাঁর সঙ্গে যাঁরা সম্পৃক্ত থাকতেন, তাঁদের মনে ভেসে উঠবে, সেই প্রেক্ষিত  থেকে অমিতাভ বসু ছিলেন শতহাত  দূরে ।
অমিতাভ বসুর  সঙ্গে বুদ্ধদেবের যে মন, মেধা, মানসিকতা অন্তরঙ্গতা, সেটা যে কেবলমাত্র একসঙ্গে যুব আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া থেকে তৈরি হয়েছিল এমনটা কিন্তু নয়। সুনীল, শক্তি,  শামসুর-- এই যে বুদ্ধদেব বাবুর একান্ত বন্ধু অংশ ,তার বাইরে অমিতাভ বসু, রণজিৎ সিংহ, এঁরাও ছিলেন তাঁর একান্ত ভাবে কাছের বন্ধু।
 তিনি যখন মুখ্যমন্ত্রী বা তারও আগে উপমুখ্যমন্ত্রী বা তথ্য সংস্কৃতি সহ স্বরাষ্ট্র দপ্তরের মন্ত্রী, অর্থাৎ ; প্রশাসনের একজন অন্যতম প্রধান ব্যস্ততম মানুষ,  সেই সময়ও অমিতাব বসু সপ্তাহের বেশ কয়েকটা দিন সকাল বেলা চলে যেতেন তার বন্ধু বুদ্ধর বাড়িতে। সেখানে প্রয়োজনে তাঁদের রাজনীতির বিষয় নিয়ে কথা হতো ।প্রশাসন নিয়ে হয়তো কথা হতো। কিন্তু সে সব কথাকে ছাপিয়ে বেশি প্রাধান্য পেত কিন্তু তাঁদের কারুর না কারুর সম্প্রতি পড়া কোন ও বই। বইয়ের বিষয়বস্তু বা সম্প্রতি পড়া কোন ও ভালো কবিতা।  কোন ও ভালো ছোট গল্প বা উপন্যাস কিংবা' দেশ 'পত্রিকার সহ কোন ও সাময়িক পত্রে প্রকাশিত ভালো প্রবন্ধ ,গল্প, কবিতা উঠে আসত।উঠে আসত  থিয়েটারের বিষয়।
 মনে পড়ে যাচ্ছে কল্যাণী  নাট্যচর্চা কেন্দ্রের পরিবেশিত আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাস অবলম্বনে' খোয়াবনামা' নাটকটি দেখবার পর, অমিতাব বসু সেই নাটক দেখবার প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন বন্ধু-বুদ্ধকে। আর বুদ্ধবাবু সেই প্রতিক্রিয়ার জেরে চলে যাচ্ছেন ,ইলিয়াসের উপন্যাসের নানান খুঁটিনাটিতে ।খানিকটা আক্ষেপ জানাচ্ছেন, সেভাবে ইলিয়াসের সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গতা তৈরি না হতে পারায়। বলছেন;  যে সময়টায় দীর্ঘকালীন সময় কলকাতার বুকে ইলিয়াস থাকলেন, সেই সময়টা  তিনি প্রায় জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন দুরারোগ্য ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে। সেই কারণে তাঁর সঙ্গে যে সাহিত্য- সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে আড্ডা দিতে দিতে একটা বন্ধুত্বের পরিবেশ তৈরি হওয়া, সেটা হওয়া সম্ভবপর হয়নি ।
            সেই প্রেক্ষিতেই ইলিয়াসের সাহিত্য সংস্কৃতির দুনিয়ায় সর্বত্রব্যাপী আগ্রহ ,এমনকি কমলা ঝড়িয়ার কীর্তন ঘিরে আগ্রহ ,তারও অনবদ্য বিবরণ দিতে দিতে মনে হয়েছিল;  আপাদমস্ত বস্তুবাদী একজন মানুষ বুদ্ধবাবু, ভাববাদের সঙ্গে যার এতোটুকু সম্পর্ক নেই,  সেই মানুষটিও হিতেশরঞ্জন সান্যালের কীর্তনের ইতিহাসের মধ্যেই শুধু বাংলা কীর্তন কে নিয়ে চর্চা আবদ্ধ রাখেননি। একালের প্রজন্ম হয়তো নামই শোনেনি ,উত্তরা দেবী, তাঁর রেকর্ডের কথা পর্যন্ত অনাবিল ভাবে বলে গিয়েছিলেন বুদ্ধবাবু।
অমিতাভু বসু তাঁর প্রথম জীবনের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ,' কুলায় ও কালপুরুষ 'গ্রন্থের কথা বললেন ।এই গ্রন্থটির নাম উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বদলে গেল বুদ্ধ বাবুর গাম্ভীর্যের আবরণ ।বলে উঠলেন ; বড়দা ( এই নামে অমিতাভবাবু বেশি পরিচিত ছিলেন) মনে আছে ,যুব আন্দোলনের সময়কালে,  কোন ও একটা ফ্রাকশন মিটিংয়ে সুধীন দত্তকে উদ্ধৃত করে আপনি  একটা পরিস্থিতি বুঝোতে গিয়ে, উচ্চারণ করেছিলেন ; চুলোয় চোদ্দপুরুষ ।
             এ কথা যখন বুদ্ধ বাবুর মুখ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে,  তখন মনে হয়নি কোন ও তুখর রাজনীতিবিদ একথা বলছেন ।মনে হয়েছিল, একেবারে বাগবাজার -শ্যামবাজার অঞ্চলে ,রকে বসে, চায়ের ভাঁড়া হাতে নিয়ে, উত্তর কলকাতার এক তরুণ মেধাবী ,তাঁর তীক্ষ্ণ অথচ রসাত্মক বাক্যবানে অন্তরঙ্গ বন্ধুকে খুনসুটির জালে আবদ্ধ করে ফেলছেন।
                         পরিচিত বাংলা প্রবাদ,' যে রাধে সে চুল ও বাঁধে 'এটা যেন বুদ্ধদেব বাবু সম্বন্ধে প্রায় ধ্রুব সত্য হয়ে আছে ।রাজনীতির পরিমণ্ডলের হাজার জটিলতা এবং ব্যস্ততা,  তারপর সেই পরিমণ্ডলটি যখন প্রশাসনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত হয় এবং প্রশাসনের একটা গুরু দায়িত্ব দীর্ঘদিন বহন করতে হয়,  তার সম্পূর্ণ নেতৃত্ব দিতে হয়।রাজ্য প্রশাসনের এইরকম একটা অবস্থার মধ্যেও, প্রশাসন এবং রাজনীতি দুটোকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে একটা মানুষ মেধা এবং মনন চর্চার ধারাবাহিকতাকে কিভাবে অক্ষুন্য রাখতে পারেন-- সেটা যাঁরা  বুদ্ধদেব বাবুকে কাছ থেকে না দেখেছেন ,তাঁরা ছাড়া অন্য কেউ বিশ্বাস করতে পারবেন না।
সি ও পি ডি পেশেন্ট ।এমন রোগীকে সংক্রমণ এড়ানোর বিষয়টিকে ডাক্তারবাবুরা সবসময় সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন ।এমনকি সংক্রমণ এড়ানোর জন্য এইরকম রোগীর ঘরে ফ্যান চালানোটাকেও অনেক সময় চিকিৎসকরা অনুমোদন দেন না ।তাঁদের মতে, ফ্যানের হাওয়াও বহু ক্ষেত্রে বাইরে থেকে সংক্রমণ নিয়ে আসে ।
তাই এইরকম রোগীর ঘরে এত টুকু ধুলো- ময়লা থাকা অনুমোদন করতে পারেন না ডাক্তার বাবুরা। বই, বিশেষ করে পুরনো বই, যার ভাঁজে বাজে ধুলো জমবার  সম্ভাবনা সব থেকে বেশি থাকে। আর সেই ধুলো থেকে তৈরি হয় মারাত্মক সংক্রমণ ।যা এরকম  রোগীদের পক্ষে অত্যন্ত রোগের প্রকোপ বাড়িয়ে দেয়।
 সে সমস্ত কিছু নিয়ে ডাক্তারবাবুরা, বুদ্ধদেব বাবুকে দীর্ঘদিন বলা সত্ত্বেও,  এই প্রশ্নে আপস করবার ক্ষেত্রে এতটুকু সম্মতি তাঁর ছিল না। আসলে মনে হয়, জীবনের শেষ দুটো ,তিনটে বছরের, অসুস্থতা ।বার বার চিকিৎসকদের সাহায্য নেওয়া। হাসপাতালে যাওয়া। বিশেষ করে দৃষ্টিশক্তি একেবারেই ক্ষীণ  থেকে ক্ষীণতর হয়ে যাওয়া-- এই সমস্ত কিছুর মধ্যেও বইগুলির সাহচর্যের মধ্যে তিনি আছেন -- এটা ছিল তাঁর বেঁচে থাকার একটা বিশেষ রকমের মন্ত্রশক্তি।
 বইগুলি না হয় তিনি শারীরিক কারণে পড়তে পারছেন না ।বহু ক্ষেত্রেই তাঁর রাজনৈতিক সতীর্থরা এসে বই পড়ে শোনাচ্ছেন ।কিন্তু বইগুলি তাঁর পাশে আছে ।এই সাহচর্যই হয়তো অনেক মন খারাপ ভালো করে দিত বুদ্ধদেব বাবুর।

  • সম্পাদকীয়