ভিন্ন রুচির অধিকারকে অস্বীকারের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে ফ্যাসিবাদের বীজ

 
মননশীলতার চর্চা যখন একটা যতি চিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়,' সময়' , তখন তাকে অতিক্রমের সাহস যাঁর দেন, তাঁরাই যথার্থ মানবপ্রকৃতি বেত্তা
 
 
এমন একটা সময় আমরা এখন বাস করছি, যখন মেধা আর মনন চর্চার বড় রকমের সংকটের মধ্যে এসে পড়েছি ,কি পড়ি নি ,বা পড়ব কিনা--এই বিতর্কটা ক্রমশই প্রবল হয়ে উঠছে। মেধা চর্চার ক্ষেত্রে আমরা এই সময়ের মানুষ, সেটা নিয়ে কখনো কখনো সন্দিগ্ধ হয়ে পড়ি ।আমরা মেধা চর্চার অনুশীলনের জন্য আগের প্রজন্ম যে  সমস্ত মানুষরা এই মুহূর্তে আর আমাদের মধ্যে নেই ,তাঁদের সৃষ্টির প্রতি আমরা একটু বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ি ।
             এই মুহূর্তে রক্ত মাংসের শরীরে মানব সমাজে, বিশেষ করে বাঙালি সমাজে উপস্থিত রয়েছেন, এমন মানুষজন, যাঁরা মেধা চর্চার ক্ষেত্রে একটা আলোকবর্তিকা নিয়ে আমাদের পথ দেখাতে পারেন ,সেই ক্ষেত্রটা তে কেমন যেন একটা আলো আঁধারির খেলা চলতে থাকে। আমরা উত্তরণের জন্য সাঁতার কাটতেই থাকি। কাটতেই থাকি ।কিন্তু উত্তোরিত হতে পারি কিনা, তা ঘিরে সংশয় কিন্তু থেকেই যায়। 
                 সংশয়ের এই দোলা চালের মধ্যে যখন আমাদের হাতে আসে আশিষ লাহিরীর লেখা কোন ও আলোকবর্তিকা ,সেটা কেবল আমাদের মনের আনন্দ ,প্রাণের আরাম ই যোগান দেয় না। আমাদের মেধা চর্চার ক্ষেত্রটিকে  কেবল স্বাস্থ্যবান করে না। আগামী দিশা দেখবার ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে বাঙালি সমাজে যাঁদের উপরে আমরা বিশেষভাবে নির্ভর করে রয়েছি, তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রাতস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব আশীষ লাহিড়ী।
              তিনি  তাঁর কলমের ভেতর দিয়ে আমাদের চেতনালোককে যে উদ্ভাসনের পথে নিয়ে যান ,তা নিঃসন্দেহে এই ত্রস্ত  সময় আর ধ্বস্ত  সংস্কৃতির যুগে যে একটা সুস্পষ্ট প্রদীপ শিখা। সেখান থেকে আমরা আলো পাই। সেখান থেকে আমরা অন্ধকার হতে  উত্তোলিত হবার শক্তি অর্জন করি।
আশীষবাবুর অতি সাম্প্রতিক গ্রন্থ ,'তবু জ্বলুক প্রদীপখানি 'এমনই একটি সংকলন ,যেখানে অল্প কয়েকটি প্রবন্ধের মধ্যে দিয়ে , সময় এবং সময়ে দিপ্যমান কিছু ব্যক্তিত্ব,  আমাদেরকে জানান দেয় ,সবকিছু এখনো শেষ হয়ে যায়নি ।বিহঙ্গ এখনো অন্ধতার আবরণে তার পাখাকে বন্ধ করেনি। বিহঙ্গে সেই উড়ে যাওয়ার গতিময়তা, সেগুলি যেন আমরা হিমানীশ গোস্বামী থেকে শুরু করে রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য হয়ে ডাক্তার স্থবির দাশগুপ্ত-- এই যে মানুষগুলির সৃষ্টি এবং যাপনচিত্র ,তা ঘিরে আশীষ বাবুর কলম, ভাবনার শেকর বাকরকে যেভাবে রস সঞ্চার করে ,তা থেকেই জেগে ওঠে মনন শীলতার অবিনশ্বরতা ।
যে সমস্ত মানুষজনের ভাবনার কথা ,সৃষ্টির কথা ,কর্মের কথা ,এই ছোট গ্রন্থটিতে মলাট বদ্ধ হয়েছে আশীষ বাবুর কলমে ,তার মধ্যে প্রত্যেকেই যে কেবলমাত্র কলমকেই নিজের জীবনের একমাত্র অঙ্গ করে নিয়েছিলেন তা কিন্তু নয়। কলম থেকে তুলি ।তুলি থেকে মেধা। আর সেই মেধাকে প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে কিভাবে মানুষের মধ্যে শুভ চিন্তাকে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, তার যেন এক উজ্জীবিত চলচ্চিত্র এই গ্রন্থখানি। 
প্রখ্যাত কার্টুনিস্ট কুট্টি ।আজকের প্রজন্ম খুব বেশি তাঁকে জানেনা ।কিন্তু সেই মানুষটি তাঁর অসাধারণ মননশীলতা ,রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং তীব্র রসবোধের মধ্যে দিয়ে কিভাবে চলমান জীবনের প্রতিচ্ছবি এঁকেছেন ,আর সেই ক্যানভাস রচনার ক্ষেত্রে কিভাবে জীবন- যৌবনকে এক বহমান নদীতে ভাসিয়েছেন, তার যে অনবদ্য বিবরণ একটি নাতি দীর্ঘ প্রবন্ধে আশীষ বাবু উপস্থাপিত করেছেন, সেটিকে নিছক একটি প্রবন্ধ বললে বোধহয় তার প্রতি খানিকটা অবিচার করা হবে। একটি প্রবন্ধের মধ্যে দিয়ে একটি মানুষ এবং তাঁর সমকাল --এই গোটা পরিপ্রেক্ষিত টিকে আশীষ বাবু যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন --এই মুন্সিয়ানার জন্যই বলতে হয় বারবার উচ্চকণ্ঠে, লেখক টির নাম আশিস লাহিড়ী।
                  একটা প্রগতিশীল রাজনৈতিক ভাবনার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করে, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সংস্কৃতিক- সমস্ত প্রেক্ষাপটকে কার্টুনের ভাষায় যেভাবে কুট্টি মেলে ধরেছিলেন, আজকের দিনে হয়তো তেমনটা মেলে ধরবার সুযোগ নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের খুব একটা থাকে না ।
কারণ ,রাষ্ট্রশক্তি এখন অনেক ক্ষেত্রেই ব্যঙ্গাত্মক সমালোচনা পছন্দ করেনা ।সে কারণেই হয়তো প্রতুল চন্দ্র লাহিড়ী , যিনি কাফি খাঁ , পি সি এল -- এমনসব  নামে অসামান্য সৃষ্টি করে গেছেন প,রবর্তীকালে কুট্ঠির সমসাময়িক আর একজন প্রখ্যাত কার্টুনিস্ট চন্ডী লাহিড়ী --এই সমস্ত মানুষগুলির ভাবধারা, তুলির ভাষায় আজকাল বড় একটা দেখতে পাওয়া যায় না। কিন্তু তাঁরা যখন তুলিতে সময়ের ধারাভাষ্য রচনা করতেন ,সেই ধারাভাষ্য রচনার সঙ্গে সমসাময়িকতার সম্পর্ক এবং অবশ্যই লেখক আশীষ বাবুর সেই সমসাময়িকতার সঙ্গে সংযোগ--  এ সমস্ত কিছুই এই গ্রন্থে  একটি নাতি দীর্ঘ প্রবন্ধের মধ্যে দিয়ে অঙ্কিত হয়েছে। সেই অঙ্কনকে কুট্টির কার্টুনের থেকে আমরা কিছুতেই যেন আলাদা করতে পারি না। আমাদের ভাবতে ভালো লাগে' আজকাল'  পত্রিকায় একটা সময় কুট্টির  আঁকা কার্টুন ছিল অন্যতম বড় একটি আকর্ষণের বিষয়।
 আশীষ বাবুর এই ছোট্ট প্রবন্ধে কুট্টির আঁকা কিছু কিছু কার্টুন, বইটির জন্য একটি নতুন ধরনের ব্যাঞ্জনা তুলে ধরেছে।
গৌরীপ্রসাদ ঘোষ --এই মানুষটিকে আজকের প্রজন্ম প্রায় চেনেই না বলা যেতে পারে। তাঁর প্রয়াণকে আশীষ বাবু অভিহিত করেছেন,  বাঙালি বিদ্যা চর্চার একটা পুরনো ঘরানার  অবসান হিসেবে।
 আসলে কেমন ছিল সেকালের বিদ্যা চর্চার পরম্পরা, সেটা বুঝতে গেলে এই গ্রন্থে আশীষবাবুর ;' ছ্যাঁদাওয়ালা ছাতা মাথায় একাকী এক ভিক্ষু' --আমাদের পড়তে হবে। বারবার পড়তে হবে। সময়ের বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে বিদ্যা চর্চার ধারাও কিভাবে বিবর্তিত হচ্ছে ,আর সেই বিবর্তন সমাজের বুকে, সময়ের বুকে, কি ধরনের পদচিহ্ন আঁকছে, সেই গতিপ্রকৃতি যেভাবে আশীষবাবু বর্ণনা করেছেন ,তার ভেতর দিয়েই আমরা বুঝতে পারি ,অনেকটা যেন সেই বঙ্কিমের উক্তির মত; মা কি ছিলেন, কি হইয়াছেন ।
মেধা চর্চার ক্ষেত্রে পল্লবগ্রাহি  মানসিকতা কিভাবে মেধা চর্চার সামগ্রিক দুনিয়াটাকে কমজোরি করে দিয়েছে, রুগ্ন করে দিয়েছে-  প্রবন্ধটি পড়বার পর, সে কথা যেন আমাদের বারবার মনে হতে থাকে।
 সেকালের প্রেসিডেন্সি কলেজ। সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, তারকনাথ সেন, সোমনাথ মৈত্র-- এই সমস্ত মানুষগুলির স্নেহ পাওয়া গৌরীপ্রসাদ ,কিভাবে নিজের ভাবনার জগতকে কোন ও ব্যক্তির প্রভাব ব্যতিরেকে, নিরপেক্ষভাবে বিকশিত করতে পেরেছিলেন ,যে ধারাটি আশীষ বাবুর মধ্যেও অত্যন্ত প্রবাল ভাবে আছে-- এই আলোচনাগুলি আমাদেরকে মেরুদন্ড শক্ত রাখতে সাহায্য করে।
সাম্প্রতিক অতীতে চলে গেছেন রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। বস্তুবাদী দর্শনের চর্চায় রামকৃষ্ণ বাবুকে প্রয়াত দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের সার্থক উত্তরসুরি বলা যায়। তাঁকে ঘিরে আশীষবাবুর প্রবন্ধ,' যুগপুরুষ রামকৃষ্ণ ও একালীন বঙ্গসমাজ ' পড়তে পড়তে বারবার মনে হয়েছে।
 সত্যিই কি একালীন বঙ্গ সমাজ এতোটুকু চেনবার  চেষ্টা করেছে এই যুগপুরুষকে? প্রবন্ধটির প্রায় সূচনা পর্বে আশীষ বাবু রবীন্দ্রনাথের ১৯১৬ সালে প্রকাশিত 'চতুরঙ্গ'  উপন্যাসের  যে উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন, তার মধ্যে দিয়ে যেন বারবার বেরিয়ে আসে ,যুগপুরুষ রামকৃষ্ণ বাবুর মেধা চর্চার সার্বিক দিকটি ।
বড় সুন্দরভাবে আশীষবাবু লিখেছেন;  রবীন্দ্রনাথ হয়তো ভবিষৎতে বিকশিত হওয়া  রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের কথা ভেবেই জ্যাঠামশাই চরিত্রটিকে অঙ্কন করেছিলেন। নইলে রামকৃষ্ণ বাবুর  চরিত্রের এই বর্ণনা ,এমন করে দিলেন কি করে ?
এরপর তিনি উদ্ধৃত করেছেন 'চতুরঙ্গ 'উপন্যাসের নানান অংশ ।একটি উদ্ধৃতি এখানে উপস্থাপিত করছি;" কার ও  কাছে তিনি লেশমাত্র সুবিধা প্রত্যাশা করেন এমন সন্দেহমাত্র পাছে কার ও  মনে  আসে এই ভয়ে ক্ষমতাশালী লোকদিগকে তিনি দূরে রাখিয়া চলিতেন ।তিনি যে দেবতা মানিতেন না তার মধ্যেও তাঁর ওই ভাবটা ছিল। লৌকিক বা অলৌকিক কোনো শক্তির কাছে তিনি হাতজোড় করিতে নারাজ (পৃষ্ঠা -৬০)।" 
                     নির্দিষ্ট কোন ও  দলীয় বৃত্তে অবস্থান না করে ,সমাজ বদলের বস্তুবাদী দর্শনের চর্চা রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য যেভাবে করে গেছেন , তার সম্যক  চর্চা বাংলা ভাষায় প্রায় হয় নেই  ই বলা যেতে পারে। রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যকে ,আশীষবাবু সর্ব অর্থে মার্কসবাদী বলেই থেমে যাননি। আবারও বলেছেন সর্ব অর্থ কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ।
এখানে রামকৃষ্ণ বাবুর ব্যক্তি জীবন একটু আলোচনা করেছেন ।সেই আলোচনার মধ্যে তাঁর প্রথম জীবনে সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতি করা এবং একটি দলীয় পরিবৃত্তের মধ্যে অবস্থান সবটাই বলেছেন। তবে সেই জায়গা থেকে কোন ও একটি বিশেষ পত্রিকা গোষ্ঠীর প্রতি যে ধরনের অসুয়া উচ্চারিত হয়েছে আশীষ বাবুর কলমে এবং রামকৃষ্ণ বাবুর মানসিকতার কথা উদ্ধৃত করে , তাতে একটা কথাই বলতে হয় ; বিপক্ষ মতকে মর্যাদা দেওয়া -নিজের মত স্থিত থেকে , সেটিও কিন্তু একজন স্রষ্টার খুব বড় বৈশিষ্ট্য ।
বিপক্ষকে নিজের আঙ্গিকে নিয়ে আসা চেষ্টা যেমন গুরুত্বপূর্ণ , তেমনি ই  দরকার বিপক্ষের প্রতি ব্যক্তি অসূয়া বর্জিত মানসিকতা। তেমনটা যদি না থাকে, তাহলে সেই সৃষ্টি র কালোত্তীর্ণতা ঘিরে আমাদের একটা সংশয় থেকেই যাবে।
 আমাদের এ প্রসঙ্গে বারবার উল্লেখ করতে হয় প্রয়াত অর্থনীতিবিদ ডক্টর অশোক মিত্রর কথা। আপাদমস্ত কমিউনিস্ট এবং একটা দলীয় পরিবৃত্তে দীর্ঘদিন থাকা মানুষটি কিন্তু কোন ও বিশেষ সংবাদপত্র গোষ্ঠীর প্রতি একটি দিনের জন্যেও  ওই ধরনের সংবাদ পত্রে লিখতে গিয়ে , নিজের ব্যক্তি মতটা কেউ বিসর্জন দেননি। ভিন্ন রুচির অধিকার কে স্বীকৃতি দেওয়া --এটা কিন্তু কমিউনিস্টদের বৈশিষ্ট্য যখনই দেখা গেছে ।ভিন্ন রুচিকে স্বীকৃতি দিতে ,দ্বিধা দ্বন্দ্ব সংকোচ--  তখনই কিন্তু উঁকি দিয়েছে ফ্যাসিবাদ ।
সে দিক থেকে কমিউনিস্ট পার্টি তাদের শত ধরনের রেজিমেন্টেশন সত্ত্বেও আভ্যন্তরীণ কাঠামোতে যে ধরনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখতে পারে, সেটা কিন্তু একটা শিক্ষনীয় বিষয়। এই শিক্ষনীয় বিষয় যদি কোন ও ব্যক্তি অনুসরণ করতে না পারেন, তাহলে সেটা তাঁর ব্যক্তিগত সমস্যা বলেই সমাজে গণ্য হবে ।কমিউনিস্ট মানসিকতার সমস্যা বলে কখনোই সেটি গণ্য হতে পারে না।
 
তবু জ্বলুক প্রদীপখানি
আশীষ লাহিড়ী
ঋতাক্ষর
২৫০ টাকা

  • শঙ্খদীপ্ত ভট্টাচার্য